অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। লেখক, গবেষক, শিক্ষাবিদ ও বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী। লিখছেন সমাজ, রাজনীতির নানা প্রসঙ্গ নিয়ে। নির্বাচন, রাজনীতি, চলমান সংকট নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। নির্বাচন ঘিরে দুই জোটের রাজনীতিকে ‘বুর্জোয়া মেরুকরণ’ বলে উল্লেখ করেন। এ মেরুকরণের মূল উদ্দেশ্য ‘ক্ষমতা’ হলেও জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের কোনো ভূমিকা রাখবে না বলে উল্লেখ করেন।
আসন্ন নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে চলমান সংকট আরও বাড়বে বলেও মত দেন তিনি। জনগণের ক্ষমতায়নে এই সমাজচিন্তক বাম ধারার শক্তির ওপর ভরসা রাখেন। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে শেষটি।
পুঁজিবাদের সংকটের কারণেই আদর্শবাদী রাজনীতি হুমকির মুখে
জাগো নিউজ : অর্ধশত বছরের বাংলাদেশ। নির্বাচন প্রশ্নে আজও স্থির কোনো ব্যবস্থা দাঁড় করানো গেল না। দ্বিধা বাড়ছে রাজনীতিতে। আসলে রাজনীতির মূল সংকট কোথায়?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : এ সংকট পুঁজিবাদের। জনগণের মধ্য থেকে এ সংকট তৈরি করা হয়নি। জনগণ রাজনীতি বোঝে না, তারা ভোট দিতে চান। বুর্জোয়া রাজনীতি জনগণকে দমিয়ে রাখে। পুঁজিবাদের সংকটের কারণেই আদর্শবাদী রাজনীতি হুমকির মুখে।
জাগো নিউজ : কিন্তু জনগণও তো এ সংকটের পথে হাঁটে। দায় তাদেরও…
আদর্শহীন রাজনীতি কখনও স্থায়ী হতে পারে না। তারা জোট গড়ছে মানে ভাঙনের লক্ষণও স্পষ্ট
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : পুঁজির শক্তির কাছে জনগণ হতাশ। জনগণ কেন বিকল্প পথে হাঁটতে পারেনি বা বাম বিকল্প শক্তি কেন জনগণের ঐক্য ধারণ করতে পারেনি, তার ঐতিহাসিক কারণ আছে। হঠাৎ করে আজকের পরিস্থিতি দাঁড়ায়নি। আবার হঠাৎ করেই বিকল্প শক্তি খুঁজে পাওয়া যাবে না।
বুর্জোয়া সংগঠনগুলো নিজেরা নিজেরা লড়াই করলেও তারা জনগণ থেকে ক্রমশই দূরে সরে যাচ্ছে। এ কারণে বিকল্প খুঁজে বের করা তাদের জন্য সহজ হবে। রাজনীতির নতুন মেরুকরণে বিকল্প শক্তি প্রকাশের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
আদর্শহীন রাজনীতি কখনও স্থায়ী হতে পারে না। তারা জোট গড়ছে মানে ভাঙনের লক্ষণও স্পষ্ট। আমরা ভাঙা-গড়ার রাজনীতি তো দেখতেই পাচ্ছি।
জাগো নিউজ : ভাঙা-গড়ার এ রাজনীতি সমাজের ওপর কী প্রভাব ফেলছে?
জোর করে যেমন উন্নয়ন করা যায় না, তেমনি ক্ষমতায়ও থাকা যায় না
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : আমরা চরম খারাপ অবস্থার মধ্যে আছি। রাজনীতির মেরুকরণ সংকট আরও বাড়াবে। ক্ষমতা, পুঁজি এখন শতকরা দশজনের হাতে। বাকি নব্বইজন হতাশার সাগরে। তারা ক্ষমতার বাইরে। এ চিত্র গোটা বিশ্বের। নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় যারা, তারা ওই দশজন মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেই আসছে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, বঞ্চিত ও শোষিত শতকরা নব্বইজন মানুষ আজও সংগঠিত হতে পারেনি। এ কারণে আমেরিকার নির্বাচনে যে ফল বাংলাদেশের নির্বাচনেও সেই ফলাফল। এমন নির্বাচন বা ভোটের আয়োজন সংকট আরও বাড়ায়। শুধু বাংলাদেশে নয়, সামাজিক অস্থিরতা এখন পশ্চিমেও তীব্র হচ্ছে।
জাগো নিউজ : আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে কী ফলাফল আসতে পারে সমাজের জন্য?
সমাজ পরিবর্তনে সুশীলরা বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারবে- এ বাস্তবতা আর নেই
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : এ নির্বাচন সমাজের ওপর কী প্রভাব ফেলবে তা সবাই আঁচ করতে পারছি। একজন ক্ষেতমজুরও এখন বলতে পারছে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কী। জোর করে যেমন উন্নয়ন করা যায় না, তেমনি ক্ষমতায়ও থাকা যায় না। সমস্যা হচ্ছে, পরিবর্তন হয় বটে তবে তা জনগণের ভাগ্য উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে না। এ কারণেই আমি মনে করি, বুর্জোয়া নয়; সমাধান হতে হবে বাম শক্তি থেকে।
জাগো নিউজ : বাম শক্তিও তো বারবার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। চরম সংকট মুহূর্তেও তারা হাল ধরতে পারেনি। আপনি কেন এত আস্থা রাখছেন?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : বাম শক্তিতে আস্থা রাখতেই হবে। বাম শক্তি ব্যর্থ হচ্ছে বলেই তো বুর্জোয়া রাজনীতিতে আস্থা রাখতে পারেনি। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এখন লড়াই চলছে। এ লড়াইয়ে বিকল্প শক্তি হতে পারে বাম রাজনীতি। বাঙালির জীবনে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা মুক্তিযুদ্ধ। কিন্তু সেই যুদ্ধ এখনও পূর্ণতা পায়নি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল একটি সামাজিক বিপ্লব হবে এবং সে বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সমাজের বৈষম্য দূর হবে। ন্যয় বিচার প্রতিষ্ঠা পাবে। কিন্তু সেটি প্রতিষ্ঠা পায়নি।
মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন লুট করেছে বুর্জোয়ারা। অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধকে সমাপ্ত করতে পারে একমাত্র বামপন্থীরাই। যদিও ঐতিহাসিকভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছেন তারা। জনগণ মুক্তিযুদ্ধ করেছিল যে চেতনা ধারণ করে, তা মূলত বামপন্থীদের চেতনা। জনগণের সেই চেতনাকে ধারণ করতে ব্যর্থ হয়েছে তারা।
জাগো নিউজ : মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়েও সামাজিক বিপ্লব প্রতিষ্ঠা পেল না। তাহলে কী মুক্তিযুদ্ধের মধ্যকার চেতনা বা নেতৃত্বে সংকট ছিল?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বের বিষয়টি ঐতিহাসিক, সেটি দীর্ঘ আলোচনার বিষয়। কিন্তু সামাজিক বিপ্লব সম্পন্ন হয়নি এটিই বাস্তবতা। এ বাস্তবতার মধ্যে আমরা ক্ষমতার লড়াই দেখছি। এ লড়াইয়ে যারাই বিজয়ী হোক না কেন, তারা অন্তত জনগণের পক্ষের শক্তি না। তাদের বিজয়ে জনগণ হেরে যায়। সমাজের পচন থেকে জনগণের এ হেরে যাওয়া।
এর একটি ভালো দিক হচ্ছে, পুঁজির প্রতি মানুষের তিক্ততা তীব্র হচ্ছে। আরেকটি ভালো দিক হলো, মানুষ ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য অস্থির হচ্ছে।
জাগো নিউজ : জনগণ এখনও ঐক্যবদ্ধ হলো না। এবার নির্বাচন ব্যর্থ হলে কী ঘটবে?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : আসন্ন নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে বিপর্যয়ের সব মাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। সমস্যা হচ্ছে, এ দুর্দিনেও বাম শক্তি প্রস্তুত হতে পারেনি। পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য যে চেষ্টা সেটাও আমরা বামপন্থীদের মধ্যে লক্ষ্য করছি না। অর্থাৎ রাষ্ট্রের চরিত্র উন্মোচন করতে পারছে না। পুঁজিবাদীরা যে শুধু নামে বা পোশাকে ভিন্ন এবং কাজে অভিন্ন, এটি জনগণের কাছে তুলে ধরতে পারছে না।
মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে রাষ্ট্র গঠন করার কথা, তা হয়নি বলেই আজ রাজনীতির সংকট তীব্র। নামে ভিন্ন হলেও এ অঞ্চলে ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ ধারার শাসন ব্যবস্থা একই। এ তিন রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। বরং স্বৈরাচারে ব্রিটিশ, পাকিস্তান আমলকেও ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ আমল।
জাগো নিউজ : সংকট উত্তরণে আপনার পরামর্শ কী?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : আমার কোনো পরামর্শ নেই। তবে উপলব্ধি আছে। উপলব্ধি হচ্ছে মানুষ পরিবর্তন চায়। জনগণের সমাজ বিনির্মাণ করতে হলে জনগণের শক্তিকেই সামনে আসতে হবে।
জাগো নিউজ : পরিবর্তনের এ প্রশ্নে সুশীল সমাজের ভূমিকা নিয়ে কী বলবেন?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : যারা সমাজ নিয়ে ভাবেন, তাদের বড় অংশ এখন বুর্জোয়া গোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে গেছে। ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় সুশীলরাও বড় ভূমিকা রাখছে। টিকে থাকার নীতি অবলম্বন করে সুশীলরাও আজ জনগণ থেকে অনেক দূরে। সুতরাং সমাজ পরিবর্তনে সুশীলরা বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারবে- এ বাস্তবতা আর নেই।
এ কারণে আমি মনে করি, জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে জনগণকেই এগিয়ে আসতে হবে। আর বাম শক্তি জনগণের সারিতে এসে দাঁড়াতে পারলেই মুক্তি মিলবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন