ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, বিরোধী দল জাতীয় পার্টি এবং মাঠের বিরোধী দল বিএনপির নেতৃত্বাধীন সব কটি জোটেই আছে এক বা একাধিক ইসলামী দল। পাশাপাশি জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নিবন্ধিত কী অনিবন্ধিত ইসলামী দলগুলো জোটভুক্ত হতে চালাচ্ছে নানা তৎপরতা। গড়ছে নিত্যনতুন জোট।
লক্ষ্য ক্ষমতার অংশীদার হওয়া। যে কোনো উপায়ে আগামী সংসদে নিজেদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা। রাজনীতির মাঠে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখার পাশাপাশি বিভিন্ন জোটে শক্ত অবস্থান তৈরিতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে এসব ইসালামী দল।
বিশ্লেষকদের মতে, ভোটের রাজনীতিতে ইসলামী দলগুলো একটা বড় ফ্যাক্টর। নির্বাচন এলেই বড় দলগুলো ভোটের প্রত্যাশায় ছক কষে। একটাই কারণ- ইসলামী দলগুলোর আলেম-ওলামাদের নিয়ে সারা দেশেই একটা ভোটব্যাংক আছে।
অনেক দিন ধরে একটা প্রচলিত ধারণা আছে, জাতীয় নির্বাচনে ইসলামপন্থী দলগুলোর ভোট বিএনপির দিকেই বেশি যায়। এবার এই ‘ভোটব্যাংক’-এর দিকে নজর বাড়িয়েছে আওয়ামী লীগ ও এর মিত্র জাতীয় পার্টি (এরশাদ)। ইসলামপন্থীদের বেশি করে কাছে টানা গেলে বিএনপি-জামায়াতের ভোট কমবে- এ কৌশল থেকে ধর্মভিত্তিক দল, সংগঠন ও ব্যক্তিদের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানোর চেষ্টা করছে ক্ষমতাসীনরা।
নির্বাচন কমিশনে এখন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৪০টি। এর মধ্যে ইসলামপন্থী দল ১০টি। এ ছাড়া অনিবন্ধিত অর্ধশত ইসলামিক দল রয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অসাম্প্রদায়িক আদর্শ নিয়ে পথচলা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট এখন ইসলামী দলগুলোকে টার্গেট করেছে। ইসলামপন্থী দল- সুফিবাদী তরিকত ফেডারেশনকে গত নির্বাচনের আগে এই জোটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এবার আরও কয়েকটি দলকে জোটে সম্পৃক্ত করার চিন্তাভাবনাও চলছে। বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মিছবাহুর রহমানের নেতৃত্বে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স নামে নতুন জোটের আত্মপ্রকাশ হয়।
এ জোটে নামসর্বস্ব ১৫টি ইসলামী দল রয়েছে। নতুন এ জোটটি আওয়ামী লীগের সঙ্গে যাওয়ার চেষ্টা করছে। জাকের পার্টিও যেতে চায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে। ইসলামিক ফ্রন্টও মহাজোটে ভিড়তে চাচ্ছে। এ ছাড়াও গত কয়েক বছরে সরকার হেফাজতে ইসলামসহ কওমি আলেমদের সঙ্গে যোগাযোগ ও সম্পর্ক বাড়িয়েছে।
ইসলামিক দলগুলোকে সরাসরি জোটে অন্তর্ভুক্ত না করালেও তাদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা চলছে। যেসব দল বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটে রয়েছে, সেগুলোকে জোট থেকে বের করে আনতে নানা তৎপরতা চলছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। মুফতি ফজলুল হক আমিনীর প্রতিষ্ঠিত ইসলামী ঐক্যজোটের মূল অংশ বিএনপি জোট থেকে বেরিয়ে গেছে। তারা কোনো জোটে এখনও যোগ দেয়নি। তবে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে তাদের সুসম্পর্ক রয়েছে।
জানতে চাইলে ১৪ দলের মুখপাত্র ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, জোটে অনেকেই আসতে চায়। তবে আমরা বলেছি, জোটের আদর্শ ‘ধর্মনিরপেক্ষ, প্রগতিশীল ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’য় বিশ্বাসী যে কোনো দল জোটে আসতে পারে। সেটা ইসলামী দল হলেও হতে পারে। এর বাইরে নির্বাচনী মহাজোট তো আছেই। আগামী নির্বাচনের আগে নির্বাচনী মহাজোটের পরিধি বাড়বে। তবে এটি এখনই বলা যাচ্ছে না। দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলাপ করেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে জামায়াতসহ চারটি ইসলামপন্থী দল আছে। নিবন্ধিত দলগুলোর মধ্যে ইসলামী ঐক্যজোট, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন- এই দল তিনটি সম্প্রতি ভেঙে ছয়টি হয়েছে। এর মধ্যে ইসলামী ঐক্যজোটের মূল অংশটি বিএনপির জোট ছেড়ে গেলেও আবদুর রকিবের নেতৃত্বে খণ্ডিত একটি অংশ ২০ দলে থেকে গেছে। আর ভেঙে যাওয়া জমিয়তের দুটি অংশই এখনও ২০ দলে আছে। খেলাফত মজলিস ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম সরাসরি বিএনপির সঙ্গে সম্পৃক্ত।
জানতে চাইলে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের শরিক খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের যুগান্তরকে বলেন, দেশে বেশকিছু ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল আছে। ওইসব দল বিভিন্ন জোটে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। জোটের বাইরেও ইসলামী দল আছে। প্রকৃত ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আদর্শগত কোনো পার্থক্য নেই।
কোনো মতবিরোধও নেই। কেননা, সবাই ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে ইসলাম প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে দলগুলোর প্রয়োগ পদ্ধতির চিন্তা আলাদা। প্রয়োগের ক্ষেত্রে ইসলামের কোন দিকটা আগে বা কোনটা পরে নেবে সেটা নিয়ে দলগুলোর মধ্যে যা মতপার্থক্য আছে।
জানতে চাইলে ২০ দলীয় জোটের শরিক ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান যুগান্তরকে বলেন, বিএনপি সব সময় জাতীয়তাবাদী ইসলামী আদর্শে বিশ্বাসী একটি দল। ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে সব সময় আমাদের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। তাই নির্বাচনকে সামনে রেখে ইসলামী দলগুলোকে নিয়ে টানাটানির কোনো চেষ্টা কখনও করিনি, ভবিষ্যতেও করব না।
তিনি বলেন, যারা অসাম্প্রদায়িকতার আওয়াজ তোলে, নির্বাচন ঘনিয়ে এলেই তারা ইসলামী দল ও বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে চেষ্টা চালায়। নানা চুক্তি করতেও তারা দ্বিধাবোধ করেন না।
বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট (মান্নান)-সহ কয়েকটি ইসলামী দল মিলে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদের নেতৃত্বে ‘সম্মিলিত জাতীয় জোট’ গঠন করে। শনিবার তারা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশাল সমাবেশ করেছে।
এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেন, জাতীয় পার্টির একটি নীতি-আদর্শ আছে। সেই আদর্শের সঙ্গে ইসলামী দলগুলোর অনেকেই একমত বা তাদের আদর্শের সঙ্গে মিল আছে। এ জন্য সমমনা দলগুলোকে নিয়েই সম্মিলিত জাতীয় জোট গঠন করা হয়েছে। আগামী নির্বাচনে সম্মিলিত জোটের ব্যানারে জোটের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ৩শ’ আসনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের মহাসচিব এমএ মতিন বলেন, ক্ষমতার পালাবদলে বৃহৎ দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ-বিএনপির প্রতি মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তাদের প্রতিহিংসার রাজনীতির কারণে জনগণ এখন বিকল্প খুঁজছে। আমরা জাতীয় পার্টির নেতৃত্বে সেই বিকল্প ‘সম্মিলিত জাতীয় জোট’ গঠন করেছি। তিনি বলেন, এটি জনগণের জোট। এখানে কোনো হিংসা-প্রতিহিংসা নেই। এখানে জনগণের ক্ষমতায়নেই আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছি।
ভোটের হিসাবে প্রথম ইসলামী দল জামায়াতে ইসলামী। এ দলটি বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে রয়েছে। তবে বর্তমানে দলটির নিবন্ধন স্থগিত রয়েছে। আর ভোটের হিসাবে দ্বিতীয় ইসলামী দল চরমোনাইর পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত কোনো জোটে না গিয়ে ৩০০ আসনে এককভাবে নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে চরমোনাই পীরের নেতৃত্বে বিকল্প একটি জোট গঠনের চিন্তাভাবনা চলছে বলে জানা গেছে। মুফতি ফজলুল হক আমিনীর প্রতিষ্ঠিত ইসলামী ঐক্যজোট, হাফেজ্জি হুজুর প্রতিষ্ঠিত খেলাফত আন্দোলন এবং শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসসহ আরও কয়েকটি দল নিয়ে এ জোট গঠনের কথা শোনা যাচ্ছে।
জানতে চাইলে দলটির চেয়ারম্যান সৈয়দ রেজাউল করিম যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচনী দাবি-দাওয়া ড. কামাল হোসেনের জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও বিএনপির সঙ্গে মিলে গেলেও আদর্শিক কারণে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ কোনো জোটভুক্ত হবে না। আমাদের নীতি-আদর্শের সঙ্গে যেসব দল একাত্মতা ঘোষণা করবে, একমত পোষণ করবে আমরা কেবল তাদের সঙ্গে নিয়ে জোট করব।
জানতে চাইলে ইসলামী ঐক্যজোটের (একাংশ) চেয়ারম্যান মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামী বলেন, বিদ্যমান জোটগুলোর বাইরে আমরা আলাদা একটি প্লাটফর্ম তৈরি করতে চাই। শেষ পর্যন্ত জোট না হলেও নির্বাচনী সমঝোতা গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে। এতে ইসলামী আন্দোলনসহ বেশ কয়েকটি ইসলামী ও সমমনা দলকে যুক্ত করার কথাবার্তা হচ্ছে। তবে এখনও কিছুই চূড়ান্ত হয়নি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন