সারা পৃথিবীর মতো বাংলাদেশেও জোরালো হচ্ছে জোটবদ্ধ রাজনীতির ধারণা।স্বাধীন বাংলাদেশে জোটবদ্ধ রাজনীতি দানা বাধে স্বৈরাচারী শাসক এরশাদের সময় থেকে। তখন অভিন্ন প্লাটফর্ম থেকে আন্দোলন করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। ইসলামি দলগুলোও জোটবদ্ধ রাজনীতির চর্চা শুরু করে এর কাছাকাছি সময়ে। ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে ইসলামী ঐক্যজোটের ব্যানারে অংশগ্রহণ করে মূলধারার ৬টি ইসলামি দল।
১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত এ ঐক্য অক্ষুণ্ন থাকে। ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচন সামনে বিএনপির সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয় ইসলামী ঐক্যজোট। তখন জোট ত্যাগ করে চরমোনাই পীরের দল ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন। এরপর থেকে একাধিক বার ভাঙ্গণের মুখোমুখী হয়ে ইসলামী ঐক্যজোট এখন একটি দল মাত্র।
ইসলামী ঐক্যজোট ভেঙ্গে যাওয়ার পর ইসলামি দলগুলোর কার্যকর কোনো জোট আর গড়ে ওঠেনি। নির্বাচন কেন্দ্রিক কিছু ঐক্য প্রচেষ্টা দেখা গেলেও আখেরে তা সময়ের স্রোতেই হারিয়ে গেছে।এ সময় নিজস্ব বলয় গড়ে তোলার বিপরীতে ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলো বৃহৎ কোনো দলের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেছে।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের বাইরে থাকা ইসলামি দলগুলোর মধ্যে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ বরাবর জোটবদ্ধ রাজনীতির প্রতি অনীহা প্রকাশ করে আসছে। এছাড়া ইসলামী ঐকজোট, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ও বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন দীর্ঘদিন ইসলামি দলগুলোর স্বতন্ত্র প্লাটফর্ম গড়ে তোলার কথা বললেও তা এখনও আলোর মুখ দেখেনি।
প্রবীণ ইসলামি রাজনীতিক ও ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মাওলানা আব্দুল লফিত নেজামি মনে করেন, ইসলামি দলগুলো কেনো নিজস্ব বলয় তৈরি করতে না পারার কারণ হলো মনোবলের অভাব। আমরা যারা ইসলামি রাজনীতি করি তাদের অধিকাংশ অপেশাদার। পেশাদারিত্ব যে কোনো ক্ষেত্রে সাফল্য লাভের অন্যতম শর্ত। আলেমরা দীনি অন্যান্য খেদমতের কারণে পেশাদারিত্বের সাথে রাজনীতি করতে পারেন না। ফলে তারা দীর্ঘদিন রাজনীতি করাও পর সাফল্য পান না। আর সাফল্য না পাওয়ার কারণে তাদের মনোবলও খুব দুর্বল।
দ্বিতীয় কারণ ঐতিহ্য। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত আলেমরা নিজেরা ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেয়ে অন্য কোনো দলকে সমর্থনই বেশি দিয়েছেন।
বেশ কিছুদিন ধরে একটি স্বয়ন্ত্র ইসলামি জোট গঠনের চেষ্টা করছিলো বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, মুসলিম লীগ ও ফরায়েজী আন্দোলন। জোটগঠনের লক্ষ্য নিয়ে দলগুলোর মধ্যে একাধিক বৈঠকও হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জোটটি আলোর মুখ দেখে নি। বরং বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস জাতীয় পার্টি (এরশাদ) এর সাথে জোটবদ্ধ হওয়ায় স্বতন্ত্র এ জোটের সম্ভাবনা হুমকির মুখে পড়েছে।
উদ্যোক্ত হওয়ার পরও কেনো পিছিয়ে গেলেন প্রশ্ন করেছিলাম বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হককে।তার কথায় মাওলানা নেজামির কথা প্রতিধ্বনি ছিলো। তিনি বলেন, দেখেন! আমরাই তো সব না। অধিকাংশ ইসলামি দলই আলোচনার বাইরে ছিলো। আমরা চাচ্ছিলাম একটি কার্যকর জোট গঠন করা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়ে উঠছে বলেই আমরা জাতীয় পার্টির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়েছি।
তার কথার পিঠে বলেছিলাম, বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় জাতীয় পার্টি না ইসলামি দলগুলোর জোট কোনটা বেশি সম্ভাবনাময়? তিনি বলেন, ইসলামি দলগুলো যদি শতভাগ আন্তরিক হয় এবং মূলধারার সব ইসলামি দল জোটবদ্ধ হয়, তবে ইসলামি দলগুলোর সম্ভাবনাই বেশি। নতুবা জাতীয় পার্টি এখনও বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্ট।
তবে এ জোটের গঠনের সম্ভাবনা এখনও শেষ হয়ে যায় নি বলে দাবি করেন বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদী। তিনি জানান, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস চলে গেলেও আমাদের মধ্যে পারস্পারিক যোগাযোগ আছে। আমরা আশা করছি একটি জোট গঠনে সক্ষম হবো।
মাওলানা মাহফুজুল হকের মতো তিনিও মনে করেন ইসলামি দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হলে কার্যকর কিছু সম্ভব। আর তারা সেটাই চেষ্টা করছেন বলে জানান তিনি।
মাওলানা হামিদী আরও জানান, আওয়ামী লীগ বা বিএনপির নেতৃত্বাধীন কোনো জোটের অংশিদার হওয়ার জন্য তারা জোট করবেন না।
২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনের সময় বিএনপির সঙ্গে জোট প্রশ্নে ইসলামী ঐক্যজোট ত্যাগ করে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। সেই থেকে একলা চল নীতি অনুসরণ করে আসছে দলটি। ঐক্যের প্রতি তাদের অনীহার কারণ জানতে চেয়েছিলাম দলটির যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমানের কাছে। তিনি অভিযোগ খানিকটা নাকচ করে দিয়েই বললেন, আমরা সব সময় ঐক্য প্রয়াসী। কিন্তু অভিযোগ করা হয় আমরা ঐক্য চাই না। ২০১৩ সালে হাটহাজারীতে সর্বদলীয় উলামা সম্মেলনে আমাদের আমির মুফতী রেজাউল করিম ইসলামি দলগুলোর স্বতন্ত্র প্লাটফর্ম গড়ে তোলার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, লেজুরবৃত্তির রাজনীতি পরিহার করে একটি নিজস্ব বলয় তৈরি করা উচিৎ। তখন একটি বিশেষ দলের ছায়াপ্রাপ্ত দলের তার কথার তীব্র বিরোধিতা করে এবং নানান অপপ্রচারে লিপ্ত হয়।
ইসলামি আন্দোলনের আমির মুফতী রেজাউল করিম কিছুদিন পূর্বে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন আদর্শিক মিল না হলে কোনো দলের সাথে ঐক্য করবো না। ইসলামি দলগুলোর সাথেও কেনো আদর্শিক মিল খুঁজে পাচ্ছে না তা ব্যাখ্যা করেন গাজী আতাউর রহমান। তিনি বলেন, ইসলাম দলগুলো যে ঘোষণা ও অঙ্গীকার নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলো তার উপর যদি অটল থাকতো, ইসলামি দলগুলোর যেসব বৈশিষ্ট্য থাকা উচিৎ ছিলো তা যদি থাকতো অবশ্যই ইসলামি দলগুলোর ভেতর ঐক্য হতো। কারণ, তখন প্রত্যাশা ও পরিকল্পনায় দূরত্ব থাকতো না। কিন্তু ক্ষমতার রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার কারণে ইসলামি দলগুলোর শুধু দৃষ্টিভঙ্গি নয়; বরং আদর্শিক জায়গাও বিরাট দূরত্ব তৈরি হয়েছে। আমরা সেটাই বোঝাতে চেয়েছি।
তাহলে কি আপনারা ক্ষমতার রাজনীতিকে অস্বীকার করছেন? আর আপনারা যা করছেন তার ব্যাখ্যাই বা কি? ‘না আমি ক্ষমতার রাজনীতিকে অস্বীকার করছি না। ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য অবশ্যই ইসলামপন্থীদের ক্ষমতায় যেতে হবে। ক্ষমতা খারাপ কিছু না। ক্ষমতার মোহ খারাপ। যখন তা আমার আদর্শ-পরিচয়, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ভুলিয়ে দেয় তাহলে তা অবশ্যই নিন্দনীয়। আপনি দেখবেন, এখন যারা বিভিন্ন দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ হচ্ছে তাদের অধিকাংশই ইসলামের স্বার্থ নিশ্চিত না করেই জোটবদ্ধ হচ্ছেন। বলেন মাওলানা গাজী আতাউর রহমান।
অবশ্য ২০০৮ সালে জাতীয় পার্টির সাথে ইসলামী আন্দোলনের জোট নিয়েও অনেকের প্রশ্ন রয়েছে। ইসলামী আন্দোলন কি পেরেছিলো ইসলামের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে? ইসলামী আন্দোলনের যুগ্ম মহাসচিবের দাবি আমরা অবশ্যই ইসলামের স্বার্থ নিশ্চিত করেছিলাম। কিভাবে? ‘প্রথমত আমরা বলবো, আমরা এরশাদের সঙ্গে জোট করিনি। এরশাদ আমাদের সাথে জোট করেছিলো। এজন্য জোটের চেয়ারম্যান ছিলেন আমাদের আমির হজরত ফজলুল করীম রহ.। দ্বিতীয়ত এরশাদ আমাদের লিখিত অঙ্গীকার করেছিলো ইসলাম ও দেশের স্বার্থরক্ষা ৮ দফা বাস্তবায়ন করবে। তৃতীয়ত জোটের নাম রাখা হয় ‘ইসলামী জাতীয় ঐক্য’। এখানে ইসলামকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়।’
তবে যে কারণেই হোক ইসলামি দলগুলোর ঐক্য না হওয়াটা অবশ্যই হতাশাজনক। মাওলানা আবদুল লফিত নেজামির ভাষায় ঐক্যবদ্ধ না হওয়ায় এ দেশে ইসলামি রাজনীতির বিপুল সম্ভাবনা নষ্ট হচ্ছে। এ দেশের মানুষ ইসলামকে ভালোবাসে, ইসলামকে চায়। কিন্তু আমাদের আত্মকলহ তাদের নিরাশ করছে।
তিনি আশা করেন, দেশ, জাতি ও ইসলামের স্বার্থে ইসলামি দলগুলো আবারও ঐক্যবদ্ধ হবে এবং এদেশ পরিচালনায় ইসলামি দলগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন