জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে ছিটকে গেছে ডা. এ কিউ এম বি. চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বিকল্পধারা বাংলাদেশ। রাজনৈতিক মহলে এ নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে সব জায়গাতেই ডালপালাও মেলছে নানা কথাবার্তা। এরই মধ্যে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নার সঙ্গে বিকল্পধারার মাহী বি. চৌধুরীর একটি ফোনালাপ ভাইরালও হয়েছে। সেখানে দুজনের মধ্যে উত্তপ্ত বাগবিতণ্ডা শোনা গেছে। বি. চৌধুরীকে বাদ দিয়ে ঐক্যফ্রন্ট ঘোষণার পেছনে ষড়যন্ত্রের অভিযোগও তুলেছেন মাহী।
রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনা ও সরকারের বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক জোট গড়ে তোলার জন্য গত বছরের শেষপ্রান্তে নানা তৎপরতা শুরু করে বিকল্পধারা। দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর গত বছরের ডিসেম্বর মাসে বি. চৌধুরীর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে নতুন রাজনৈতিক জোট যুক্তফ্রন্ট। এ জোটের অন্য তিন সঙ্গী হয়েছিল আ স ম আবদুর রবের জেএসডি, মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য এবং কাদের সিদ্দিকীর কৃষক-শ্রমিক জনতা লীগ। পরবর্তী সময়ে কাদের সিদ্দিকী আর এ জোটে থাকেননি।
গত বছরের ডিসেম্বরে গঠিত হলেও এ জোট প্রথমদিকে রাজনীতির ময়দানে তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। গত জুলাই মাসে জোটের পরিধি বৃদ্ধির নানা তৎপরতা শুরু হয়। একদিকে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনকে সেখানে যুক্ত করার চেষ্টা চলে, আবার বিএনপিপন্থী বেশ কয়েকজন বুদ্ধিজীবী বিএনপিকে ওই জোটের সঙ্গে যুক্ত করার তৎপরতা শুরু করেন। আগস্ট মাসের শুরুতেই কামাল হোসেন যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করার ঘোষণা দেন। পরবর্তী সময়ে ‘জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া’ নামে একটি প্লাটফর্মে তারা মিলিত হন। সেখান থেকে সংবাদ সম্মেলন করে নিরপেক্ষ-নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ ৫ দফা দাবি ঘোষণা করা হয়। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যকার ক্ষমতার ভারসাম্য আনাসহ রাষ্ট্র পরিচালনার ৯টি লক্ষ্যও ঘোষণা করেন তারা। ‘জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া’র ওই আত্মপ্রকাশের দিনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুলসহ বেশ কয়েকজন নেতা সেখানে বক্তব্য দেন। নতুন ওই জোটে বিএনপি যে আসছে সেটা ছিল সময়ের ব্যাপারমাত্র।
সরকারবিরোধী এই জোটে বিএনপির যুক্ত হওয়ার সময় যতই ঘনিয়ে আসছিল ততই বিকল্প ধারার সঙ্গে যেন দূরত্ব বাড়ছিল। এ নিয়ে নানা কানাঘুষাও চাউর হয়। বিএনপির সঙ্গে বি. চৌধুরীর পুরনো বিবাদকে কেন্দ্র করে শুরু হয় আলোচনা। অনেকের মনেই প্রশ্ন তৈরি হয় শেষপর্যন্ত বিকল্পধারা কি এ জোটে থাকবে? ‘অসুস্থতা’র কারণে আত্মপ্রকাশের অনুষ্ঠানে বি. চৌধুরী না আসায় নতুন করে প্রশ্নেও জন্ম দেয়। যদিও ‘জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া’ আত্মপ্রকাশের আগে মির্জা ফখরুলসহ বিএনপির নেতারা বি. চৌধুরীর বাসায় গিয়ে তার কাছে পুরনো ঘটনার জন্য ক্ষমাও চান।
নতুন জোটে বিএনপির যুক্ত হওয়ার পথ যত খুলছিল, বিকল্পধারা ততই যেন ছাড় না দেওয়ার বা নিজেদের অবস্থানে অনমনীয় থাকার মনোভাব দেখাচ্ছিল। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে স্বাধীনতাবিরোধী কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ঐক্য না করার ব্যাপারে তারা শক্ত অবস্থান নেয়। তারা চাইছিল বিএনপি যেন ২০-দলীয় জোট থেকে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামীকে বাদ দেয়। এ ছাড়া তারা চাইছিল বিএনপি ও নতুন জোটের মধ্যে আসনের ভাগাভাগির বিষয়টা যেন আধাআধি থাকে। যাতে করে ক্ষমতায় গেলে বিএনপি ও অন্যদের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য থাকে।
গত পরশু সন্ধ্যায় জাতীয় প্রেসক্লাবে বিএনপিকে নিয়ে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বের নতুন জোট আত্মপ্রকাশ করে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামে ওই জোটের সাত দফা ঘোষণা পড়ে শোনান মাহমুদুর রহমান মান্না। বি. চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টের সদস্য সচিব ছিলেন তিনি। তবে জোট আত্মপ্রকাশের ঘোষণার আগে দিনভর চলে নাটকীয়তা। বি. চৌধুরী ও তার ছেলে দুপুরে বেইলি রোডে ড. কামালের বাসায় গিয়ে কাউকে না পেয়ে ফিরে আসেন। অন্যদিকে, সে সময়ে মতিঝিলে কামাল হোসেন তার চেম্বারে অন্য নেতাদের নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের রূপরেখা চূড়ান্ত করছিলেন। পরে সন্ধ্যায় বি. চৌধুরীকে বাদেই নতুন রাজনৈতিক জোটের আত্মপ্রকাশ হয়।
বি. চৌধুরী কেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে নেই এ নিয়ে নতুন জোটটির নেতারা কোনো পরিষ্কার তথ্য দেননি। এ বিষয়ে তাদের সঙ্গে পরে আলোচনা হবে বলে ইঙ্গিত দেন মান্না। অন্যদিকে সংবাদ সম্মেলন করে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে এক রকম সম্পর্ক ছেদের ঘোষণা দেন বিকল্পধারা বাংলাদেশের সভাপতি ও যুক্তফ্রন্ট চেয়ারম্যান, সাবেক রাষ্ট্রপতি বি. চৌধুরী। তবে তিনি সরকারবিরোধী রাজনৈতিক জোটের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ক্ষীণ সম্ভাবনার কথাও বলেন। এ জন্য দুটি শর্ত দেন। বি. চৌধুরী বলেন, যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে কোনো ঐক্য প্রক্রিয়ায় আমরা যুক্ত হব না। আমরা ভারসাম্যের রাজনীতি চাই। কোনো একক দলের আধিপত্য চাই না। এ দুটি বিষয়ে আমরা বিএনপির সঙ্গে একমত হতে পারিনি।’
গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের বিরুদ্ধে অসৌজন্যমূলক আচরণের অভিযোগ আনেন তিনি। বি. চৌধুরী বলেন, আমরা অনেক আগে থেকেই ঐক্য প্রক্রিয়ার কাজ করে যাচ্ছিলাম। তারই ধারাবাহিকতায় বিকালে ড. কামাল হোসেনের বেইলি রোডের বাসায় আমন্ত্রণ জানানো হয় বৈঠকের। সেই বৈঠক শেষে জাতীয় ঐক্যের ঘোষণা দেওয়ার কথা। কিন্তু বিকালে আমি তার বাসার সামনে গিয়ে ১৪ থেকে ১৫ মিনিট অপেক্ষা করেছি। কিন্তু তিনিও বাসায় ছিলেন না, দরজা খোলারও কোনো লোক ছিল না। ভেতরে নিয়ে বসিয়ে যে এক কাপ চা খাওয়াবে সে লোকটাও পর্যন্ত ছিল না।’
অন্যদিকে বিকল্পধারার যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি. চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের কথা পরিষ্কার, বিএনপি বা কোনো দলকে এককভাবে ক্ষমতায় বসানোর লক্ষ্য নিয়ে আমরা কোনো ঐক্য করব না।’
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গড়ে তোলার ক্ষেত্রে শুরু থেকেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার পরও শেষপর্যন্ত সেখান থেকে ছিটকে পড়ায় রাজনৈতিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়ল বিকল্পধারা- এমনটাই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম নেওয়া বি. চৌধুরী সাবেক সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের হাত ধরে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ব্যক্তিগত জীবনে সফল এ চিকিৎসক জিয়ার শাসনামলে উপ-প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন। ওই বছরেই তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন। এর পরের বছর সরকারের সঙ্গে টানাপড়েনের জেরে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। পরবর্তী সময়ে বিকল্পধারা বাংলাদেশ গঠন করেন।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দলগতভাবে বিকল্পধারা বাংলাদেশের তেমন কোনো প্রভাব নেই। বি. চৌধুরীর ব্যক্তিগত ইমেজ দলটির প্রধান পুঁজি। কিন্তু বয়স হওয়ার কারণে ছেলে মাহীর ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। নানা ধরনের কর্মকাণ্ড নিয়ে মাহী তরুণদের মাঝে প্রভাব সৃষ্টি করার চেষ্টা করলেও কোনো সময়েই সেগুলো দাগ কাটতে পারেনি। এর মাঝে তার কোনো কোনো কর্মকাণ্ডে বিতর্কও তৈরি হয়েছে। দলীয় কর্মকাণ্ডও শুধু ঢাকা ও দুয়েকটি জেলায় সীমাবদ্ধ। নির্বাচনের ক্ষেত্রেও দলটির কোনো সাফল্য নেই। তাই নতুন জোট থেকে ছিটকে পড়ায় নৈতিকভাবে বিকল্পধারা লাভবান হলেও নির্বাচনী রাজনীতিতে ক্ষতির মুখোমুখি হতে হবে। দেশের বেশিরভাগ মানুষ ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে বড় দুই দল ও তাদের প্রতীককেই বিবেচনা করে সবার আগে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন