তৃণমূলের মতামতকে অগ্রাধিকার দিয়ে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ার কথা আওয়ামী লীগের। তবে চট্টগ্রাম মহানগরে নানা কারণে মনোনয়ন প্রক্রিয়া বেশ জটিল হয়ে উঠেছে। দলের নেতাকর্মীরা মনে করছেন, দলীয় মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত হলেও পরে আর দলকে পাত্তা দেন না এমপিরা। কাজেই মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। তবে এমপিদের দাবি, দলের হয়েই কাজ করছেন তারা। তবে সংসদ অধিবেশনসহ বিভিন্ন কারণে তাদের অনেক সময়ই ঢাকায় থাকতে হয়। তাই দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া হয়ে ওঠে না। পর্যবেক্ষকদের মতে, সব মিলিয়ে চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি এমন যে- দল যদি ডানে থাকে, সাংসদ যান বামে।
এরই মধ্যে মহানগরের তিন সাংসদের বিরুদ্ধে অসহযোগিতা ও দলীয় কার্যক্রমে নিষ্ফ্ক্রিয় থাকার অভিযোগ এনে কেন্দ্রে অভিযোগ করেছে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ।
দল ও সাংসদদের এমন পরস্পরবিরোধী অবস্থানের কারণে সাংগঠনিকভাবে দলের ক্ষতি হচ্ছে। চট্টগ্রামে চলমান ৯৬ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন কাজের খবরও যথাযথভাবে প্রচারিত হচ্ছে না।
চট্টগ্রাম মহানগরের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছয়টি সংসদীয় আসন। তবে তিনটিতে এমপি হিসেবে রয়েছেন মহাজোটের শরিকরা। অন্য তিনটি আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে দলকে অসহযোগিতার অভিযোগ পাঠানো হয়েছে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কাছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন চট্টগ্রাম-১০ (ডবলমুরিং ও খুলশী) আসন থেকে নির্বাচিত ডা. আফছারুল আমীন, চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর) আসনের এম এ লতিফ এবং চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড) আসনের দিদারুল আলম।
যেভাবে দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে এলো :মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খোরশেদ আলম সুজন বলেন, 'চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে তিন এমপির কাছে প্রকল্পের তালিকা চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা এ-সংক্রান্ত চিঠির কোনো জবাবই দেননি।' তিনি জানান, গত ২১ এপ্রিল চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সভায় তিনি সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের কাছে এ বিষয়ে জানার জন্য প্রশ্ন করেন। উত্তরে সিটি মেয়র আ জ ম নাছির জানান, বারবার চিঠি দেওয়ার পরও তিন এমপি কোনো তালিকা দেননি। তাদের অসহযোগিতার বিষয়টি তিনি কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন। নগরীর দারুল ফজল মার্কেটের দলীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এ সভায় সভাপতিত্ব করেন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী। এভাবে এ দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে চলে আসে।
এ প্রসঙ্গে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ও সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, সাংসদরা তাদের সম্পন্ন বা প্রক্রিয়াধীন উন্নয়ন প্রকল্পের তালিকা দিলে দলীয় সভা-সমাবেশে সেসব প্রচার করা যেত। দুঃখজনক তারা চিঠির উত্তরই দেননি। সংগঠনের কোনো কর্মসূচিতেও অংশ নেন না তারা। দলের সাধারণ সম্পাদককে আমি বিষয়টি লিখিতভাবে জানিয়েছি। এখন বিষয়টি কেন্দ্রের ওপর নির্ভর করছে।
এমপিরা যা বলেন :নগরীর ডবলমুরিং-হালিশহর আসনের এমপি ডা. আফছারুল আমীন বলেন, তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে মহানগরীর একটি আসনের এমপি হয়েছেন। এ মহানগরীতে প্রকল্প বাস্তবায়নের এখতিয়ার সিটি করপোরেশনের। তাদের পরিচালিত উন্নয়ন কার্যক্রম এ সরকারেরই প্রকল্প। সেটি প্রচার করলেই সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রমের প্রচার হয়। এসবের তালিকা চাওয়া অপ্রয়োজনীয় কাজ। তা ছাড়া এ-সংক্রান্ত কোনো চিঠিও তার কাছে যায়নি বলে জানান তিনি।
একই মন্তব্য করে বন্দর-পতেঙ্গা আসনের এমপি এমএ লতিফ বলেন, সংসদ অধিবেশন ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটিতে থাকায় সাংসদদের বেশিরভাগ সময়ই ঢাকায় থাকতে হয়। তারপরও সপ্তাহে অন্তত তিন দিন এলাকায় থাকার চেষ্টা করেছি। এলাকার বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কথা বলেছি সংসদে। যেসব প্রকল্প নেওয়া হয়েছে সেগুলো তো এমপিদের দাবিরই ফসল। এসব প্রকল্পের তত্ত্বাবধান করেছে সিটি করপোরেশন। সাংসদরা কী উন্নয়ন কাজ করেছেন, সেটি তো ভালো জানার কথা করপোরেশনেরই।
সীতাকুণ্ড ও আকবরশাহ আসনের এমপি দিদারুল আলম বলেন, তার সংসদীয় আসনের বড় অংশটি উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণাধীন। মহানগরের ছোট একটি অংশ তার সংসদীয় আসনে যুক্ত। সংসদ নিয়ে ব্যস্ত থাকায় দলীয় সব কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া সম্ভব হয় না। দল এটি না বুঝলে বিষয়টি দুঃখজনক।
ক্ষতি হচ্ছে সংগঠনের :চট্টগ্রাম মহানগরীতে দলের সঙ্গে এমপিদের এ দূরত্বে ক্ষতি হচ্ছে সংগঠনের। দলীয় এমপিদের ব্যাপারে দলীয় সদস্যদের সমালোচনার বিরূপ প্রভাব পড়ে জনমনে। উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর ব্যাপারেও জোর কোনো আলোচনা নেই।
এরই মধ্যে চলতি বছর ২০টি মেগা প্রকল্পের জন্য চট্টগ্রামে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ৯৬ হাজার কোটি টাকা। ২০ হাজার কোটি টাকার নতুন বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে বাঁশখালীতে। এ ছাড়া ১৮ হাজার কোটি টাকায় চট্টগ্রাম-ঘুনধুম রেললাইন স্থাপন প্রকল্প, ১৬ হাজার কোটি টাকায় আনোয়ারায় অর্থনৈতিক অঞ্চল, ১১ হাজার কোটি টাকায় মিরসরাইয়ে দেশের সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক অঞ্চল, সাড়ে চার হাজার কোটি টাকায় প্রায় ১৯ কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, নয় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল, পাঁচ হাজার ৬০০ কোটি টাকায় জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প, দুই হাজার কোটি টাকায় চট্টগ্রাম বন্দরে বে-টার্মিনাল, ৩১০ কোটি টাকায় বহদ্দারহাট থেকে কর্ণফুলী নতুন ব্রিজ পর্যন্ত সড়ক ফোর লেন করার প্রকল্প, ৩২০ কোটি টাকায় ডিটি-বায়েজিদ সংযোগ সড়ক, ২৮০ কোটি টাকায় নদীতীর সংরক্ষণ, সড়ক ও ড্রেনেজ সিস্টেম সংস্কারে ৭১৬ কোটি টাকার প্রকল্প, তিন হাজার কোটি টাকার কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প-১ বাস্তবায়ন, চার হাজার ৪৯১ কোটি টাকায় কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প-২, এক হাজার ৭৮ কোটি টাকার চিটাগাং ওয়াটার সাপ্লাই ইমপ্রুভমেন্ট অ্যান্ড স্যানিটেশন প্রকল্প, ১১শ' কোটি টাকার ভাণ্ডারজুরি পানি সরবরাহ প্রকল্প, দুই হাজার ৪২৬ কোটি টাকার আউটার রিং রোড প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং ৪৬২ কোটি টাকায় নগরীতে আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভার নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়েছে এ সরকারের আমলেই। তবে এসব উন্নয়নকাজকে ছাপিয়ে জনমনে আলোচনার বিষয়বস্তু হচ্ছে দলীয় দ্বন্দ্ব।
দূরত্বের নেপথ্যে :এমপিদের সঙ্গে মহানগর আওয়ামী লীগের দূরত্ব তৈরি হয় এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি থাকার সময়। মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি হলেও ডবলমুড়িং আসনের এমপি ডা. আফছারুল আমীন এ সময় দলীয় কোনো কর্মসূচিতে অংশ নিতেন না। দলে গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদে না থাকলেও একই কারণে দলের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছে অন্য দুই এমপি এমএ লতিফ ও দিদারুল আলমের।
মহিউদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুর পরও এ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। কারণ, এখন সাংসদদের সঙ্গে দূরত্ব দেখা দিয়েছে নগরের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছিরের। নগরের বিভিন্ন আসনে মনোনয়ন পেতে আগ্রহী অথচ বর্তমান এমপি নন, এমন নেতাদের সঙ্গে সিটি মেয়র নাছিরের সখ্য রয়েছে, যা এমপিদের সঙ্গে তার দূরত্বের অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। এ দূরত্ব মেটানো না হলে আসন্ন নির্বাচনে দলের ক্ষতি হতে পারে। এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি অধ্যাপক সিকান্দার খান বলেন, 'দলের মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচিত এমপিদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হলে ভুল বার্তা পৌঁছায় জনগণের কাছে। সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রমের প্রচারও যথাযথ হয় না। তাই এ দূরত্ব না ঘুচলে নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।'
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন