বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা আমেরিকায় রাজনৈতিক আশ্রয় লাভ করেছেন। তাঁর রাজনৈতিক আশ্রয় লাভের আবেদন অতি দ্রততার সাথে মঞ্জুর করে আমেরিকা সরকার। রাজনৈতিক আশ্রয় লাভের আবেদন মঞ্জুরের পর তিনি ট্রাভেলস্ ডকুমেন্টের জন্য আবেদন করেছেন। ট্রাভেলস্ ডকুমেন্টস হাতে পেলেই তিনি ইন্ডিয়া সফরে যাবেন। ডিসেম্বরের আগেই তিনি ইন্ডিয়া সফর করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাথে সাক্ষাৎ করতে চান। আমেরিকার নিউ জার্সিতে তিনি বর্তমানে বসবাস করছেন। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র এই তথ্য নিশ্চিত করেছে।
সুরেন্দ্র কুমার সিনহা আপাদ মস্তক আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে বিশ্বাসী। ২০০১ সালে ক্ষমতা থেকে বিদায়ের আগে তাঁকে সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারপতি হিসাবে নিয়োগ দিয়েছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। অতিরিক্ত বিচারপতি হিসাবে দায়িত্ব পালনের মেয়াদ যখন শেষ তখন ক্ষমতায় চার দলীয় জোট সরকার। চার দলীয় জোট সরকারের আমলে তিনি স্থায়ী বিচারপতি হিসাবে নিয়োগ লাভ করেন। আবারো ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব গ্রহনের পর তাঁকে আপিল বিভাগে নেওয়া হয়। এজন্য আপিল বিভাগে অতিরিক্ত বিচারপতির পদ সৃষ্টি করা হয়েছিল। শেখ মুুজিবুর রহমান হত্যা মামলা শুনানীর জন্য তখন আপিল বিভাগের বিচারপতির সংখ্যা ১১ জনে উন্নীত করা হয়েছিল। এর আগে আপিল বিভাগের বিচারপতির নির্ধারিত সংখ্যা ছিল ৭জন। আরো ৪ জনের পদ বাড়িয়ে সুরেন্দ্র কুমার সিনহা সহ কয়েকজনকে আপিল বিভাগে নিয়োগ দেওয়া হয়। শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলার আপিল শুনানী শুরু হওয়ার আগে প্রায় ৪০ লাখ টাকা ব্যয় করে তাঁকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য পাঠায় শেখ হাসিনার সরকার। চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে আসার পরপরই তাঁকে শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলার আপিল শুনানীর জন্য গঠিত ৫ বিচারপতির বেঞ্চে বিচারক হিসাবে মনোনীত করা হয়। তখন তিনি ছিলেন আপিল বিভাগের সর্ব কনিষ্ঠ বিচারপতি।
শেখ হাসিনার সরকারের সময়ই রাষ্ট্রপতি তাঁকে প্রধান বিচারপতি হিসাবে নিয়োগ দেয়। প্রধান বিচারপতি হিসাবে নিয়োগের পর কিছু বিষয় নিয়ে সরকারের সাথে তাঁর দূরত্ব তৈরি হয়। এর মাঝে তিনি সুপ্রিমকোর্টের প্রধান ভবনের সামনে মূর্তি স্থাপন করে বিতর্কের ঝড় তুলেছিলেন। মূর্তি সরানোর জন্য আন্দোলনে নেমেছিল দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ। সর্বশেষ মূর্তিটি এখন থেকে সরাতে বাধ্য হলেও পরবর্তীতে এনেক্স ভবনের সামনে আবার স্থাপন করা হয়।
বিচারপতিদের চাকুরিচ্যুত করার ক্ষমতা সংসদকে দিয়ে একটি আইন পাস করে বর্তমান দখলদার সরকার। এই আইনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ হয়েছিল হাইকোর্ট বিভাগে। হাইকোর্ট আইনটিকে অসাংবিধানিক হিসাবে ঘোষণা করে। আপিল করে সরকার। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগে ৫ বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ হাইকোর্টের রায় বহাল রাখে। সুরেন্দ্র কুমার সিনহার রায়ে সরকারের কর্মকান্ড এবং বর্তমান জাতীয় সংসদের সমালোচনা করা হয়। এতেই সরকারের সাথে তাঁর দূরত্ব চরম আকারে রুপ নেয়। এর জের ধরে সুরেন্দ্র কুমার সিনহার দুর্নীতি সামনে আসতে থাকে। সরকার সমর্থক একটি টেলিভিশন চ্যানেলে তাঁর অবৈধভাবে নির্মীতি বাড়ি ব্যাংকের অস্বাভাবিক লেন-দেন ও আয়কর নথির হিসাব ও সম্পদের হিসাবে গড়মিল নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তবে এটাও ঠিক সুরেন্দ্র কুমার সিনহার দুর্নীতি সুপ্রিমকোর্টে সবার মুখে মুখে প্রচারিত ছিল। সেটা মিডিয়ায় আসে সরকারের সাথে দূরত্ব তৈরির পর।
সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে নিয়েও সরকার পতনের নানা স্বপ্নের কথা গত বছরের শেষভাগে বেশ আলোচিত ছিল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি মহল এনিয়ে নানা রুপকল্প প্রচার করে আসছিল। এছাড়া বিরোধী জোটের অনেক রাজনীতিকের মুখেও শোনা গেছে সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ভরসার কথা।
এখানে উল্লেখ্য, সুরেন্দ্র কুমার সিনহাই আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশের বিষয়ে আপিল বিভাগে আইনজীবীর জবাবে বলেছিলেন, একজন মাত্র সাক্ষীর বিতর্কিত বক্তব্যের একটি বিশ্বাস হয়েছে। তাই তাঁকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। রিভিও আবেদন শুনানীর সময় আইনজীবীর প্রশ্ন ছিল একজন মাত্র সাক্ষীর বয়ানের ভিত্তিতে তাঁকে ফাসির আদেশ দেয়া হল। অথচ ওই সাক্ষী ৩ জায়গায় একই ঘটনাকে ৩ রকমের বর্ণনা করেছেন। কোনটি সত্য এটা নির্ধারণ করা হবে কিভাবে? তখন সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছিলেন ওই ৩টি বক্তব্যের একটি আমরা বিশ্বাস করেছি এবং ফাঁসির আদেশ দিয়েছি! অথচ ফৌজদারি আইনের দুনিয়াব্যাপি চিরন্তন নীতি হচ্ছে কোন ব্যক্তিকে চুড়ান্ত দন্ড দেওয়ার আগে সন্দেহাতীত প্রমানিত হওয়া লাগবে।
এই সুরেন্দ্র কুমারের নেতৃত্বে গঠিত আপিল বিভাগেই কিন্তু সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পক্ষে দায়ের করা আবেদন পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়াই প্রত্যাখান করা হয়েছিল। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানে পঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছিলেন। সেটার প্রমান হিসাবে তাঁর পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ দাখিল করেছিল। সেটাকে কোন রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়াই সরাসরি খারিজ করে দেওয়া হয়। বিশ্বাস অবিশ্বাস তারা করতেই পারেন। তবে একজনকে চুড়ান্ত দন্ড দেওয়ার আগে সনদ সঠিক নাকি বেটিক সেটা পরীক্ষা করারও প্রয়োজন মনে করা হয়নি।
এছাড়া সুপ্রিমকোর্টে কর্মরত বিচারপতি শামিম হাসনাইন আদালতে আবেদন করেছিলেন তিনি সাক্ষ্য দিতে চান। একই সাথে তারা তখন পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেছেন সেটা তিনি স্বপ্রণোদিত হয়ে আদালতে উপস্থিতির মাধ্যমে সাক্ষ্য দিতে চান। সুপ্রিমকোর্টের একজন বিচারপতির আবেদনও নাকচ করে দিলেন সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে গঠিত আপিল বিভাগ। এই সুরেন্দ্র কুমারকে ভর করেই সরকার পতনের স্বপ্নের বাণী শুনতে হয়েছে বিরোধী দলের নেতাদের মুখে। দোর্দন্ড প্রতাপশালী সুরেন্দ্র কুমার সিনহা এখন নিজেই রাজনৈতিক আশ্রয়ে আমেরিকায় আশ্রিত। তিনি একদিন ট্রাইব্যুনালের চ্যারম্যান নিজামুল হক নাসিমকে বলেছিলেন, আপনি ৩টাকে দিয়া দেন। মানে ৩জন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, অধ্যাপক গোলাম আজম এবং আল্লামা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীকে ফাঁসির আদেশ দিয়া লন। তারপর আপনাকে এখানে (আপিল বিভাগে) নিয়া আসি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন