আশির দশক থেকে স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের মৃত্যুদিবসে তার জন্মস্থান গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় মেজবানের আয়োজন করতেন বর্ষীয়ান রাজনীতিক ও চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী।মাথায় হুলিয়া নিয়ে আত্মগোপনে থাকা অবস্থায়ও ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে গিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপাশি সাধ্যমতো সাধারণ মানুষের জন্য আপ্যায়নের আয়োজন করতেন এই নেতা।
গত বছর বর্ষীয়ান এই রাজনীতিকের জীবনাবসান ঘটেছে। কিন্তু থেমে থাকছে না মেজবান আয়োজন। বাবার দেখানো পথে এবার টুঙ্গিপাড়ায় মেজবানের আয়োজন করবেন মহিউদ্দিনপুত্র ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল।
এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী চ্যারিটেবল ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ১৫ আগস্ট দুপুরে টুঙ্গিপাড়ায় ৪০ হাজার মানুষের জন্য মেজবানের আয়োজন করা হয়েছে।
নওফেল বলেন, ‘সত্তরের দশকের শেষদিকে আমার বাবা যখন ভারত থেকে দেশে ফেরেন, তখন থেকেই প্রতিবছর তিনি বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদিবসে টুঙ্গিপাড়া যাচ্ছেন। আশির দশকের মাঝামাঝি, সম্ভবত ৮৪ সাল থেকে বাবা টুঙ্গিপাড়ায় মেজবানের আয়োজন করে আসছিলেন। তখন টুঙ্গিপাড়ায় রাস্তাঘাট উন্নত ছিল না। বড়ো আকারের আয়োজন করা যেত না। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় জেলেও ছিলেন। আবার রাজনৈতিক হুলিয়া মাথায় নিয়েও গেছেন। দুয়েক বছর ব্যতিক্রম বাদে বাবা প্রতিবছরই টুঙ্গিপাড়া গেছেন।’
তিনি বলেন, ‘১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর টুঙ্গিপাড়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হয়। ১৯৯৮ সাল থেকে বাবা প্রতিবছরই টুঙ্গিপাড়ায় বড় আকারের মেজবান আয়োজন করে আসছেন। যারা বঙ্গবন্ধুর মাজারে শ্রদ্ধা জানাতে যান তাদের এবং গ্রামবাসী মিলিয়ে প্রতিবছর প্রায় অর্ধলক্ষ লোককে তিনি খাইয়েছেন। এই কাজটা আমাদের পরিবারের কাছে আমার বাবার স্মৃতি। এই স্মৃতিটুকু আমরা বাঁচিয়ে রাখতে চাই।’
১৫ আগস্ট দুপুরে টুঙ্গিপাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কলেজ ও বালিয়াডাঙ্গা স্কুল মাঠে মেজবান অনুষ্ঠান হবে।
সার্বিক বিষয় তদারকির জন্য মহিউদ্দিনের ছেলে বোরহানুল হাসান চৌধুরী সালেহীন এবং একান্ত সহকারী ওসমান গণি গত শনিবার টুঙ্গিপাড়ায় পৌঁছেছেন। তাদের সঙ্গে গেছেন চট্টগ্রামের মোহাম্মদ হোসেন বাবুর্চির নেতৃত্বে ৪০ সদস্যের একটি টিম।
ওসমান গণি বলেন, ‘এবারও ৪০ হাজার মানুষের জন্য মেজবানের আয়োজন করা হয়েছে।৩০ হাজার মুসলিম এবং ১০ হাজার অমুসলিমের জন্য খাবারের আয়োজন করা হচ্ছে। ২০টি গরু কেনা হয়েছে।৩ হাজার পিস মুরগিও কেনা হয়েছে। প্রতিবছর স্যারের (এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী) নির্দেশে শোক দিবসের এক সপ্তাহ আগে আমরা মেজবানের আয়োজন করার টুঙ্গিপাড়ায় চলে আসি। এবারও এসেছি। প্রতিবছর স্যার টেলিফোনে সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখতেন। বিভিন্ন নির্দেশনা দিতেন। এবার স্যার নেই। স্যারের অভাববোধ করছি।’
প্রতিবছর মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা টুঙ্গিপাড়ায় যেতেন। এবার চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের প্রায় ৫০০ নেতাকর্মী টুঙ্গিপাড়ায় যাবার প্রস্তুতি নিয়েছেন। সঙ্গে যাবেন মহিউদ্দিনের স্ত্রী হাসিনা মহিউদ্দিন ও পরিবারের সকল সদস্য।
মঙ্গলবার (১৪ আগস্ট) বিকেল তিনটায় নগরীর জমিয়াতুল ফালাহ জাতীয় মসজিদ ময়দান থেকে দুটি বাস, তিনটি জিপ এবং কয়েকটি মাইক্রোবাসে করে নেতাকর্মীরা রওনা দেবেন টুঙ্গিপাড়ার উদ্দেশে।
চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ফরিদ মাহমুদ জানান, ১৫ আগস্ট সকালে নেতকর্মীরা বঙ্গবন্ধুর মাজারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাবেন। এর পর মেজবান অনুষ্ঠিত হবে। তিনি বলেন, ‘প্রতিবছর আমাদের নেতা (এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী) নেতৃত্বে আমরা জাতির জনকের মাজারে যেতাম। এবার নেতা নেই। নেতার স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতে প্রতিবছর আমরা টুঙ্গিপাড়ায় যাব। প্রতিবছর মেজবানের আয়োজন হবে।’
চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিক আদনান ও প্রচার সম্পাদক শফিকুল ইসলাম ফারুক, নগর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ফরিদ মাহমুদ ও মাহবুবুল হক সুমন, নগর ছাত্রলীগের সভাপতি ইমরান আহমেদ ইমু ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীরসহ বিভিন্ন থানা-ওয়ার্ থেকে নেতাকর্মীরা টুঙ্গিপাড়ায় যাবেন বলে জানিয়েছে দলীয় সূত্র।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলে এর প্রতিবাদে তৎকালীন শ্রমিক নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী দেশে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। বিষয়টি তৎকালীন সামরিক সরকার জানার পর তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করা হয়। তখন মহিউদ্দিন নিজের অনুসারীদের নিয়ে ভারতে পাড়ি জমান এবং সেখান থেকে সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করেন।
তবে ভারতে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তিনি দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হন। ১৯৭৭ সালে তিনি টুঙ্গিপাড়ায় গিয়ে বঙ্গবন্ধুর কবরটি পাকা করে দেন। এর পর থেকে প্রতিবছর তিনি ১৫ আগস্টে টুঙ্গিপাড়া চলে যান। ১৯৯৮ সালের ১৫ আগস্ট থেকে সেখানে বড় পরিসরে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মেজবানের আয়োজন করে আসছেন মহিউদ্দিন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন