একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আর বাকি কয়েকটি মাস। সংবিধান অনুযায়ী আগামী বছরের জানুয়ারির মধ্যে জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন করার বাধ্যবাধকতা আছে।
সে হিসাবে আগামী অক্টোবরেই ঘোষণা হতে পারে নির্বাচনী তফসিল। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সব ধরনের রাজনৈতিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করছে। কিন্তু ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি কোনো প্রস্তুতির দিকেই এগুতে পারছে না। কোনো কৌশলেই দাঁড়াতে পারছে না দলটি। অথচ দলটির শীর্ষনেতারা গত ঈদুল ফিতরের আগেই বলেছিলেন ঈদের পর তারা আন্দোলনের কৌশল পাল্টাবেন। কিন্তু ঈদ শেষে আরেকটি ঈদ সমাগত। বিএনপি তার কৌশল এখনো বাতলাতে পারেনি রাজনীতিতে। এমনকি দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলনও গড়ে তুলতে পারেননি তারা।
দেশের রাজনীতিতে বিএনপির মতো একটি দল তিন তিনবার রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল। দলটির জনপ্রিয়তা কোনো অংশে কম নয়। কিন্তু আত্মঘাতমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে দলটি আজ স্মরণকালের সবচেয়ে দুর্যোগপূর্ণ সময় পার করছে। জামায়াতের মতো যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত দলকে রাজনৈতিক সহগামী হিসেবে বেছে নেওয়া, দলের প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমান এবং তার সাঙ্গপাঙ্গদের বেপরোয়া ঘুষ, দুর্নীতি, লুটপাটে লাগাম পরাতে না পারা, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দানসহ বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য অপকর্ম বিএনপির মতো দলকে আজকের দুঃসময়ে পতিত করেছে বলে অভিমত রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের। তার ওপর সম্প্রতি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কারান্তরীণ হওয়ার ঘটনা দলটিকে আরও বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, সব ধরনের দুর্যোগই সামাল দেওয়া যেত যদি খালেদা জিয়া জেলের বাইরে থাকতেন, কিংবা সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশের বাইরে পালিয়ে না থেকে দেশেই অবস্থান করতেন। কিন্তু এই দুই অঘটনই দলটির ভবিতব্য নির্ধারণ করে দিয়েছে।
আওয়ামী লীগ টানা দ্বিতীয় মেয়াদের ক্ষমতা শেষ করতে চলেছে। এর মধ্যে বিভিন্ন ইস্যুতে বিএনপি আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তুলতে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছে বারবার। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বিএনপি গত ১০ বছরে জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোনো ইস্যুতে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করেনি। বারবার জিয়া পরিবারের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে সবচেয়ে বেশি মনোযোগী ছিল। আর এসব আন্দোলন গড়ে তুলতে গিয়ে দলটির তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত লাখ লাখ কর্মীকে মামলা, হামলার মুখে পড়তে হয়েছে। গত এপ্রিল মাসে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের দেওয়া তথ্যমতে, সারা দেশে ৭৮ হাজার মামলায় বিএনপির ১৫ লাখ নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। দমন-পীড়নের মুখে বিএনপি উঠেই দাঁড়াতে পারছে না। এ সময় বিএনপির সাধারণ মানুষকে পাশে পেত-যদি দলটি সাধারণ মানুষের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ইস্যুতে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারত।
সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি বলেই আজ দেউলিয়াত্বের দিকে অগ্রসর হচ্ছে দলটি।
মামলা হামলার ভয় নিয়ে সারা দেশে বিএনপির লাখ লাখ কর্মী অসহায় ও নিষ্ক্রিয় অবস্থায়। গত ঈদুল ফিতরের আগে বিএনপির শীর্ষনেতাদের অনেকেই বলেছিলেন ঈদের পর আন্দোলনের কৌশল পাল্টে বিএনপি রাজপথে সক্রিয় হবে। কিন্তু ঈদুল ফিতর শেষে ঈদুল আজহাও চলে এলো। ঈদুল আজহার পর জন্মাষ্টমী, দুর্গাপূজাসহ নানা ধর্মীয় উৎসব আছে। এর পরপরই জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা নিয়ে তোড়জোড় শুরু হয়ে যাবে নির্বাচন কমিশনের। তখন নির্বাচনী প্রচারণা ছাড়া আর কোনো কাজ থাকবে না রাজনৈতিক দলগুলোর। অথচ বিএনপি এখনো সিদ্ধান্তই নিতে পারেনি তারা আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেবে কি নেবে না। তারা ইতোমধ্যে সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন নির্দলীয় সহায়ক সরকারের অধীনে স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের। সে দাবিকে থোড়াই কেয়ার করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ স্পষ্ট বলে দিয়েছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এবং বর্তমান সরকারের অধীনেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশন তার দায়িত্ব পালন করবে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং মাঠে বিরোধী দল বিএনপি যখন মুখোমুখি অবস্থানে, এ দুই দলের মধ্যে যখন কোনো সমঝোতার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না, তখন বিভিন্ন জায়গা থেকে দুই দলের মধ্যে সংলাপের কথা বলা হলেও ক্ষমতাসীনরা বিএনপির সঙ্গে যে কোনো ধরনের সংলাপকেই নাকচ করেছে। এ অবস্থায় বিএনপি কোনো কার্যকর ফোরামেই দাঁড়াতে পারছে না। ফলে তার মাঠ গরমের পরিস্থিতি যেমন নেই তেমনি সরকারের সঙ্গে ‘দরকষাকষির’ বাস্তবতা বা অবস্থান তৈরি করতেও অক্ষমতার পরিচয় দিচ্ছে। এ জন্য দলটি বারবার আশ্রয় নিচ্ছে বিদেশি বন্ধুদের। বিএনপি সম্প্রতি বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরিতে সরকারকে চাপ প্রয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন তারা। এর আগে দলটির একটি প্রতিনিধি দল ভারত সফর করে একই বক্তব্য দিয়ে এসেছে সে দেশের নীতিনির্ধারকদের কাছে। সরকারের সঙ্গে এক টেবিলে বসে যে প্রস্তাবনা তারা দিতে পারছে না সেটা বিদেশি বন্ধু, কূটনীতিকদের মাধ্যমে সরকারের কাছে পৌঁছাচ্ছে। যদিও এসব কৌশল শেষ বিবেচনায় ফলপ্রসূ হবে কি না তা নিয়ে নানা মত রয়েছে বিশ্লেষকদের।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, বিএনপির মতো দল রাজনৈতিকভাবে কতটা ব্যর্থ ও অসহায় হলে ভিনদেশী বন্ধু ও কূটনীতিকদের শরণাপন্ন হয় তা সহজেই অনুমেয়। মাঠ ছাড়া বিএনপির কোনো গতি নেই, নির্বাচন ছাড়া তাদের কোনো উপায় নেই-এ সত্যটি তাদের অনুধাবন করা দরকার। তা হলেই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সব ধরনের প্রস্তুতির দিকে এগুতে পারে বিএনপি। অবশ্য ইতোমধ্যে অনুষ্ঠিত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিয়ে তার ভোটের মাঠের কাজ কিছুটা এগিয়েও নিয়েছে। কিন্তু সেখানেও কৌশলের ঘাটতি ছিল বলে মনে করছেন অনেকে। সিটি নির্বাচনগুলোতে বিএনপির অংশগ্রহণ পুরো নির্বাচনকে জমিয়ে তুলেছে। কিন্তু নির্বাচনে যে কারচুপি ও অনিয়ম হয়েছে বলে দাবি করেছে বিএনপি, সে ইস্যুতে কোনো আন্দোলনই গড়ে তুলতে পারলেন না তারা। তবে হারুক বা জিতুক, বিএনপি যে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে সে ধারা ধরে রাখা উচিত বলেই মনে করেন বিশ্লেষকরা।
বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, শত নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ এ ব্যাপারে বলেন, বিএনপি নির্বাচনের পথেই হাঁটছে। ইতোমধ্যে অনুষ্ঠিত হওয়া সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোতে দলটি অংশ নিয়ে তাই প্রমাণ করেছে। সরকার তার জায়গাতে অনড় থাকলেও বিএনপি মনে করে আন্তর্জাতিক বা অন্য যে কোনো চাপের কারণেই হোক সরকার শেষ পর্যন্ত কিছু ছাড় দেবে। তাই বিএনপি নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। কারণ দলটির ব্যাপক জনপ্রিয়তা আছে দেশের মানুষের কাছে। সে কারণে দলটি ঐক্যবদ্ধ। অনেক চেষ্টা করেও বিএনপিতে ভাঙন ধরানো যায়নি। জনপ্রিয়তাও কমেনি। সরকারকে এসব বিবেচনায় নিতে হবে।
বিএনপিপন্থী হিসেবে পরিচিত বিশিষ্ট নাগরিক ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, সরকার এবং বিএনপি দুই পক্ষই চাপে আছে। সরকার চাপে আছে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানে আর বিএনপি চাপে আছে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে। ফলে আগামী নির্বাচন একটি ভালো নির্বাচন হবে বলেই আমার প্রত্যাশা। আমি মনে করি বিএনপি অবশ্যই নির্বাচনে যাবে এবং এ জন্য সরকারকেও ছাড় দিতে হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, সরকার নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে যাতে বিএনপি নির্বাচনে না যায়। দলের চেয়ারপারসনকে কারাগারে নেওয়া হয়েছে এ কারণেই। অথচ বিএনপি নির্বাচনের পথেই আছে। খালেদা জিয়াকে মুক্ত করেই বিএনপি নির্বাচনে যাবে। নির্বাচনের জন্য সম্ভাব্য সব প্রস্তুতিই আমাদের রয়েছে। আন্দোলন এবং নির্বাচনের প্রস্তুতি সব একসঙ্গে চলছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন