রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এতদিন বিএনপির পাশে দেখা যায়নি দলটির মিত্র জামায়াতে ইসলামীকে। জামায়াত তাদের কাউন্সিলর প্রার্থী পক্ষে ভোটের প্রচারে ছিল নীরবে। মেয়র পদে কারও পক্ষে-বিপক্ষে নামেনি। কিন্তু দলটির নেতাকর্মীদের একে একে গ্রেফতারের পর বিএনপির দিকে ঝুঁকছে জামায়াত। বিএনপির সঙ্গে যখন জামায়াতের দূরত্ব বেড়েছে, তখন দলটির নেতাকর্মীদের ধরপাকড় করে কেন ধানের শীষের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে- স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারাও এ সমীকরণ মেলাতে পারছেন না।
গত বৃহস্পতিবার রাজশাহী মহানগর জামায়াতের নায়েবে আমির আবু মো. সেলিম, মতিহার থানার আমির অলিউল ইসলাম টিপুকে গ্রেফতার করে নগর পুলিশের গোয়েন্দা দল। মহানগর পুলিশ বলেছে, নাশকতার মামলায় তাদের গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। এর দু'দিন আগে গ্রেফতার করা হয় জামায়াতের বোয়ালিয়া থানা আমির সিরাজুল ইসলাম, সেক্রেটারি আবদুল খালেক ও সহকারী সেক্রেটারি শফিকুল ইসলামকে। দল সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীর পক্ষে প্রচারে নামা জামায়াতের চার নারী কর্মী ও দুই নেতাকে ভ্রাম্যমাণ আদালত এক মাস করে কারাদণ্ড দিয়েছেন।
গতকাল শনিবার দুপুরে রাজশাহী নগরীর সাহেববাজার সংলগ্ন মোবাইল মার্কেটে ভোটের প্রচারে আসেন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। তার সঙ্গে থাকা প্রবীণ এক আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে কথা হয়। তিনি বললেন, ভোটের আগে জামায়াত নেতাদের ধরপাকড়ে আওয়ামী লীগের লাভের চেয়ে লোকসান হলো বেশি। কারণ এবার বিএনপির পক্ষে নির্বাচনে নামেনি জামায়াত।
প্রবীণ এ নেতার মূল্যায়ন, ধরপাকড়ের কারণে হয়তো সরকারের প্রতি ক্ষোভে ধানের শীষের পক্ষেই নামতে পারে জামায়াত। তিনি বলেন, তাদের জানা ছিল, জামায়াতের ভোট আওয়ামী লীগের পক্ষে আসবে না। কিন্তু বিএনপির সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে জামায়াত এবার লিটনের বিরোধিতায় নামেনি। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধর্মের দোহাই দিয়ে নৌকার ভোট নষ্ট করেনি। নির্বাচনে ক'দিন আগে ধরপাকড়ের মুখে পড়ায় হয়তো তারা নৌকার বিরুদ্ধে প্রচারণায় নামতে পারে।
সিলেটে জোটের সিদ্ধান্ত না মেনে বিএনপির বিরুদ্ধে মেয়র পদে প্রার্থী দিয়েছে জামায়াত। বরিশাল মহানগর জামায়াতের সেক্রেটারি জহির উদ্দিন বাবরকে গ্রেফতার করা হলেও সেখানে ভোটের প্রচার শুরুর ১১ দিন পর গত শুক্রবার বিএনপির পক্ষে মাঠে নেমেছে জামায়াত। কিন্তু রাজশাহীতে একেবারেই নীরব ছিল। ২০১৩ সালের সিটি নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে একাট্টা হয়ে নির্বাচন করলেও এবার ধানের শীষের প্রচারে জামায়াতকে দেখা যায়নি। দলটির কোনো পর্যায়ের নেতাকে দেখা যায়নি বিএনপির মেয়র প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলের পাশে।
জামায়াতকে গত পাঁচ বছর অবমূল্যায়ন করা হয়েছে- এ অভিযোগ তুলে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সদ্য সাবেক মেয়র বুলবুলের বিরোধিতা করেছেন দলটির অনেক নেতাকর্মী। তাদেরই একজন ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সভাপতি আশরাফ উদ্দিন ইমন জানিয়েছেন, ২০১৩ সালের নির্বাচনে জামায়াত-শিবিরের সবাই ছিলেন বিএনপির পাশে। মেয়র পদে জামায়াতকে মূল্যায়ন না করায় এবার কেউ নেই।
রাজশাহীর বিএনপি নেতারাও সমকালকে বলেছিলেন, এবার তারা পাচ্ছেন না জামায়াতকে। জোটের বৈঠকেও আসেনি তাদের কেউ। জোটের নির্বাচনী সমন্বয় কমিটিতেও জামায়াতের কোনো সদস্য নেই। সরেজমিনেও দেখা যায়, শুধু দলীয় ১৫ কাউন্সিলরের পক্ষেই ব্যস্ত ছিল জামায়াত। কিন্তু গত ক'দিনের ধরপাকড়ে অবস্থা পাল্টে যেতে পারে বলে আভাস দিয়েছেন জামায়াত নেতারা। দলটির কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগের এক সদস্য সমকালকে বলেন, ভোটে না থাকলেও জামায়াতের ওপর দমন-পীড়ন বন্ধ হয় না। তার চেয়ে ভোটে থাকাই ভালো।
একই আভাস পাওয়া গেল জামায়াতের নায়েবে আমির মিয়া গোলাম পরওয়ারের কথাতেও। তিনি সমকালকে বলেছেন, পরিবেশ পরিস্থিতির কারণেই বরিশাল ও রাজশাহীতে জোটের পক্ষে সর্বাত্মকভাবে নামতে পারেনি জামায়াত। তবে আগামী দিনগুলোতে আরও সক্রিয় হবে।
রাজশাহীতে জামায়াতের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোট রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। ১৯৯৪ সালের নির্বাচনে মেয়র পদে জামায়াত প্রার্থী ১৯ হাজার ভোট পেয়েছিলেন। এরপর আর নির্বাচনে অংশ নেয়নি দলটি, বিএনপিকে সমর্থন দিয়ে আসছে। স্থানীয় রাজনীতি বিশ্নেষকদের ধারণা, রাজশাহীতে ১৫ থেকে ২০ হাজার ভোট আছে জামায়াতের। এ ভোট বিএনপিই পাবে। নৌকায় আসবে না। মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শফিকুল হক মিলন সমকালকে বলেন, জামায়াতের সমর্থকরা যেন ধানের শীষে ভোট দিতে কেন্দ্রে না আসতে পারে, সে জন্যই ধরপাকড় করা হচ্ছে। আগেই ভয়ভীতি তৈরি করা হচ্ছে।
বিএনপি নেতাকর্মীদেরও গণগ্রেফতার করা হচ্ছে বলে দাবি করেছেন দলটির নেতারা। গতকাল রিটার্নিং কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে গণগ্রেফতার বন্ধের দাবি জানান বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মীনু। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আজ সোমবার তিনি এ দাবি নিয়ে রাজশাহী সফরে আসা নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। এতেও গণগ্রেফতার বন্ধ না হলে রাজপথেই সমাধান করা হবে।
গতকাল ভোটের প্রচারে অংশ নিয়ে মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল অভিযোগ করেন, বিএনপির নেতাকর্মীদেরও ধরপাকড় করা হচ্ছে। তবে আওয়ামী লীগ প্রার্থী খায়রুজ্জামান লিটন বিএনপির এসব অভিযোগকে অপপ্রচার আখ্যা দিয়ে উড়িয়ে দেন। তিনি বলেছেন, নৌকার পক্ষে জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। কাউকে রাজনৈতিক কারণে হয়রানি করা হচ্ছে না।
বড় দল বিএনপির প্রার্থী এখনও ভোটের ইশতেহার দিতে পারেননি। তবে গতকাল নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেন গণসংহতি আন্দোলন সমর্থিত মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট মুরাদ মোর্শেদ। তিনি বলেন, নির্বাচিত হলে জবাবদিহিতামূলক সিটি করপোরেশন গড়বেন। ভোটের প্রচারে আছেন ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী শফিকুল ইসলাম। অন্য প্রার্থী বিজেপির হাবিবুর রহমানের প্রচার চোখে পড়েনি গত ১২ দিনেও।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন