ঢাকা শহরে বসবাসকারী দেড় কোটিরও বেশি মানুষকে পানি সরবরাহের কাজটি করছে ঢাকা ওয়াসা। গভীর নলকূলের মাধ্যমে পানি সরবরাহের পথ থেকে ধীরে ধীরে সরে আসছে সেবা সংস্থাটি। তাদের লক্ষ্য, ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ বা গভীর নলকূলের পানির বদলে নগরবাসীকে ‘সারফেজ ওয়াটার’ ভূ-উপরস্থ পানি পরিশোধন করে তা পানযোগ্য করে সরবরাহ করা। এরইমধ্যে এ সংক্রান্ত পাঁচটি প্রকল্প নিয়ে কাজ শুরু করেছে ওয়াসা। সংস্থাটি বলছে, বর্তমানে ওয়াসা ৩৪ শতাংশ ভূ-উপরিস্থ ও ৬৬ শতাংশ গভীর নলকূলের মাধ্যমে মোট ২৬৫ কোটি লিটার পানি প্রতিদিন সরবরাহ করছে।
ওয়াসা চায়, ৭০ শতাংশ ভূ-উপরিস্থ ও ৩০ শতাংশ গভীর নলকূলের মাধ্যমে সরবরাহ করতে। তার অংশ হিসেবে ২০১২ সালে করা মাস্টারপ্ল্যানের ওপর ভিত্তি করে মেঘনা নদীর পানি পরিশোধন করে ঢাকায় নিয়ে আসতে কাজ করছে ওয়াসা। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর নাগাদ প্রকল্প কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। অর্থাৎ এ প্রকল্পের মাধ্যমে ২০২৪ সালের শুরুতে ঢাকাবাসীর জন্য পানযোগ্য হতে চলেছে মেঘনা নদীর পানি।
ঢাকা এনভায়রোমেন্টারি সাসটেইনেবল ওয়াটার সাপ্লাই প্রকল্প নামে এ প্রকল্পটির কাজ চলছে নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জের গন্ধর্বপুরে। মেঘনা নদীর বিশনন্দী এলাকা থেকে পানি নিয়ে তা পরিশোধন করা হবে এ প্রকল্পে। পরিশোধিত পানি পাইপলাইনের মাধ্যমে রাজধানীর বারিধারা ড্রিসটিবিউশন নেটওয়ার্কে যুক্ত হবে।
এরপর তা সরবরাহ হবে- নগরির উত্তরা, বাড্ডা, গুলশান, বনানী, মিরপুরসহ আশপাশের এলাকায়। প্রকল্পের প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে তিন হাজার ১৯৯ কোটি টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে এখান থেকে প্রতিদিন ৫০ কোটি লিটার পরিশোধিত পানি ঢাকায় পৌঁছাবে বলে জানিয়েছে ওয়াসা।
সরেজমিনে প্রকল্পস্থল ঘুরে দেখা যায়, মূল প্রকল্পের কাজ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। প্রকল্পকাজের অবকাঠামো এরইমধ্যে তৈরি হয়ে গেছে। বাকী কাজ এগিয়ে নিতে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট দেশি-বিদেশী কর্মীদের কর্মচাঞ্চল্য দেখা গেছে প্রকল্পস্থল জুড়ে।
করোনাভাইরাস মহামারি পরিস্থিতিতে সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে কাজ করে চলেছেন কর্মীরা। প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের মতে, কোডিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে কাজে কিছুটা ধীরগতি ছিল। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গতি পেয়েছে। এরইমধ্যে ৩০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।
গতকাল শনিবার (০৬ ফেব্রুয়ারি) প্রকল্পস্থল পরিদর্শনে যান ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ওয়াসা) তাকসিম এ খান। পরিদর্শন শেষে তাকসিম এ খান বলেন, সরকার আমাদের অনেক সামনে দিকে দেখছে। আমরা ২০৪১ সালের যে লক্ষ্যমাত্রা তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। আমাদের যে পানি ব্যবস্থাপনা তা এর মধ্যে ঢেলে সাজাতে হবে। আমাদের পাঁচটি ট্রিটমেন্ট প্লান্ট। তারমধ্যে একটি রুপগঞ্জের গন্ধর্বপুর ট্রিটমেন্ট প্লান্ট এবং ইনশাআল্লাহ এটি ২০২৩ সালের মধ্যে সম্পন্ন হবে। আমাদের যে মূল লক্ষ্য, ঢাকা শহরের পানি ব্যবস্থাপনায় সারফেজ ওয়াটারের আধিক্য নিয়ে আসা ও পরিবেশবান্ধব করাই একটি অংশ। গন্ধর্বপুর ও সায়েদাবাদ ফেজ ৩ সম্পন্ন হওয়ার পর আমরা আমাদের কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব। অর্থাৎ ৭০ শতাংশ সারফেজ ওয়াটার এবং ৩০ শতাংশ আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়াটার। যেটি হবে পরিবেশবান্ধব, টেকসই ও গণমুখী।
২০১৯ সালের ১০ অক্টোবর এ প্রকল্পের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর প্রকল্প কাজ শুরু হয়। মাষ্টার প্লান আগে হওয়ায় তখন যে ব্যয় ধরা হয়েছিল, তার চেয়ে অনেকটা ব্যয় বেড়েছে প্রকল্পটিতে। পাশাপাশি জমি অধিগ্রহণেও খরচ বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে সময়।
এ বিষয়ে ওয়াসার এমডি বলেন, ‘আমাদের মাস্টারপ্ল্যান ২০১২ সালের। আমরা যে ট্রিটমেন্ট প্লান্টগুলো করব, সেটা মাস্টারপ্ল্যানে ছিল। ২০১৫-১৬ সালে থেকে এর ড্রইং, ডিজাইন শুরু হয়েছে। ২০১৯ সালে আমরা ফান্ড পেয়েছি। তখন আমরা ভিত্তিপ্রস্থ স্থাপন করি। এটির মেয়াদ ২০২১ সাল পর্যন্ত ছিল। যেহেতু শুরুই হয়েছে দেড়িতে তাই ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এটার মেয়াদ। ব্যয় বেড়েছে। ৩০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় বেড়েছে। ব্যয় বাড়ার কারণ ভূমি অধিগ্রহণের পয়সার কারণে প্রকল্প ব্যয় বেড়েছে। ২০১৩ সালের আউট লাইন স্টিমেট আমরা ২০১৮ সালে করেছি। এ কারণেও ব্যয় কিছুটা বেড়েছে ‘
২০২৩ সালের মধ্যে কাজ শেষ হবে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গত দেড় বছরে কোভিড থাকার পরেও ৩০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। হাতে প্রায় দুই বছর সময় সময় আছে। এ সময়ের মধ্যে কাজ হতে হবেই।’
তাকসিম এ খান বলেন, ‘আমাদের মোট পানির চাহিদা আমরা পূরণ করতে পারছি। আমরা এখনি ২৬৫ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করছি। সারফেজ ওয়াটার ৩৪ শতাংশ। ৬৬ শতাংশ আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়াটার। এটা বিপরীত হবে।’
এদিকে, একই সময় প্রকল্পস্থল পরিদর্শন করেছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। প্রকল্প ব্যয়সংক্রান্ত সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, উচ্চবিত্ত এলাকায় বসবাসরত মানুষ এবং কম আয়ের মানুষ সমান সুযোগ-সুবিধা নিয়ে কেন একই মূল্য পরিশোধ করবে। সব জায়গায় সমান মূল্য নির্ধারিত হওয়ায় এক ধরনের বৈষম্য তৈরী হচ্ছে। এজন্য উচ্চবিত্ত এলাকার মানুষের রাজস্বের হার এবং ইউটিলিটি সার্ভিসের মূল্য বর্ধিত হওয়া উচিত। একই ধরনের রাজস্ব এবং হোল্ডিং ট্যাক্সসহ অন্যান্য ইউটিলিটি সার্ভিসের মূল্য নির্ধারণ যৌক্তিক নয়। এ বিষয়ে সকলের সহযোগিতা কামনা করে মন্ত্রী দেশের উন্নয়নে সকলকে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার আহবান জানান।
প্রকল্পের মেয়াদ এবং ব্যয় বাড়ানো সংক্রান্ত অপর এক প্রশ্নের উত্তরে মন্ত্রী বলেন, সমস্ত প্রকল্পের কাজ দ্রুত শেষ করা এবং যৌক্তিক কারণ ছাড়া প্রকল্পের ব্যয় না বাড়ানোর জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা রয়েছে। প্রকল্পে অযথা কালক্ষেপণের কোনো সুযোগ নেই। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে টাইম লাইন ঠিক করে দেওয়া হচ্ছে এবং সে টাইমলাইন অনুযায়ী শেষ করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
টেকসই এবং মানসম্মত কাজ করতে গিয়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রকল্পের ব্যয় বাড়ছে মন্তব্য করে তিনি জানান, পাঁচ-ছয় বছর আগে নেয়া প্রকল্প এখন শুরু করতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রকল্পের খরচ বেড়ে যায়। কারণ ওই সময়ের দাম এবং বর্তমান দামের মধ্যে পার্থক্য থাকে। কম খরচে কাজ করে পুরো টাকা নষ্ট করার চেয়ে কিছু টাকা বেশি খরচ করে টেকসই কাজ করা উত্তম।
কোভিডকালীন সময়েও প্রকল্পের কাজ শেষ করতে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন উল্লেখ করে, ঢাকা নগরীতে পানি সরবরাহ করতে ওয়াসার এই প্রকল্পের কাজ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
মো: তাজুল ইসলাম বলেন, ‘পানির ভবিষ্যৎ চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে সারাদেশে টেকসই উন্নয়নের পাশাপাশি টেকসই পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। চট্টগ্রাম এবং ঢাকায় যে পানির সমস্যা ছিল তা এখন সমাধান হয়েছে।’ দেশে পানির কোনও সমস্যা থাকবে না বলেও জানান তিনি।
মন্ত্রী আরও বলেন, ‘পানির স্তর নিচে নামার কারণে সারা পৃথিবীর ন্যায় বাংলাদেশও সার্ফেস ওয়াটারের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। গন্ধবপুর পানি শোধানাগার থেকে রাজধানীতে পানি নিতে প্রকল্প এবং ডিস্ট্রিবিউশন লাইনের কাজ একই সাথে চলছে।’ কাজ শেষ হলেই পানি সরবরাহ শুরু হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী।
এলজিইডি’র রাস্তা, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ নিয়ে সমালোচনা হয় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী বলেন, ‘এলজিইডি যেসব কাজ করে তা লো কস্টে করে। যার জন্য টেকসই হয় না। তার মন্ত্রণালয়ের অধীন সকল প্রতিষ্ঠানের কাজ মানসম্মত এবং টেকসই করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।’
দুর্নীতি বা অনিয়ম করে নিম্নমানের কাজ করলে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘নিম্নমানের কাজের সাথে জড়িত থাকায় ইতোমধ্যে অনেক প্রকৌশলীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে এবং অনেকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ভালো কাজ করতে গেলে চ্যালেঞ্জ আসবে। তবে সেই চ্যালেঞ্জকে উপেক্ষা করে লক্ষ্য পূরণে এগিয়ে যেতে হবে।’
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি এডিবি, এএফডি এবং ইআইবি'র অর্থায়নে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে।
ব্রেকিংনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন