আগুন পিছু ছাড়ছে না বস্তিবাসীর। গত ১ মাসে রাজধানীতে ছোট-বড় ৫টি বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন হাজারও মানুষ। তারা বলছেন, সব হারিয়ে কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই আবারও সব পুড়ে ছারখার করে দেয় আগুন।
ক্ষুধার আগুন নেভাতে গ্রাম থেকে ঢাকায় এসে বস্তিতে বারবার সর্বগ্রাসী আগুনে পুড়ে নিঃস্ব হতে হচ্ছে। তারা জানান, বস্তি পোড়ে, কিন্তু এর দায় কেউ নেয় না। ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ঢাকার বিভিন্ন বস্তিতে ৩১ বার আগুন লাগে।
এনজিও থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে সাততলা বস্তি বাজারে একটি দোকান দিয়েছিলেন ফিরোজা বেগম। সোমবার রাতের আগুনে তার সব পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে। বুধবারও বস্তি এলাকায় বসে তাকে আহাজারি করতে দেখা গেছে। ফিরোজা বেগম বলেন, বারবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি, আর আগুনে সব পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। পোড়া কপালের বুঝি আর ক্ষত সারবে না।
একই বস্তির বাসিন্দা আবদুল করিমকে দেখা গেছে, ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে ভিটায় খুঁটি পুঁততে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, তিনবার আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হলাম। আয়-রোজগার করে ক্ষতি পুষিয়ে ঘুরে দাঁড়াই, আবার আগুন নিঃস্ব করে দেয়। বস্তি ছেড়ে যাওয়ারও কোনো উপায় নেই বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন করিম।
ফিরোজা বেগম ও আবদুল করিমের মতো সোমবার রাতের আগুনে নিঃস্ব হয়েছেন এ বস্তির পাঁচ শতাধিক মানুষ। পুড়ে গেছে তাদের কষ্ট উপার্জিত সব সহায়-সম্বল। মাঠে টানানো প্যান্ডেলের নিচে রাত যাপন করলেও ঘুরে দাঁড়ানোর যুদ্ধে মরিয়া তারা।
সাততলা বস্তি এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একেকটি বৈধ সংযোগ থেকে বস্তির বিভিন্ন বাড়িতে দেয়া হয় অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ। চিকন আর নিুমানের ক্যাবল বিদ্যুতের লোড নিতে পারে না। যার কারণেই বারবার আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ছে বস্তিবাসীর স্বপ্ন। ফায়ার সার্ভিস সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০১২, ’১৫ ও ’১৬ সালেও সাততলা বস্তিতে আগুনের ঘটনা ঘটেছে। প্রত্যেকবারই বৈদ্যুতিক শর্ট-সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়।
জানা গেছে, সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার মধ্যরাত পর্যন্ত মহাখালীর সাততলা বস্তি, মোহাম্মদপুর বাবর রোডের জহুরী মহল্লায় বিহারিপট্টি ও মিরপুরের কালশী বাসস্ট্যান্ডসংলগ্ন বাউনিয়া বাঁধের বস্তিতে আগুনের ঘটনা ঘটে। এর আগে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে কল্যাণপুর নতুনবাজার বস্তি এবং টিকাটুলি সুইপার কলোনিতে।
৩০ অক্টোবর অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত নতুনবাজার বস্তিতে বুধবার সকালে গিয়ে দেখা গেছে, পোড়া ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে বস্তিতে ঘর তুলেছেন অনেক বাসিন্দা। তারা বলছেন, নিজের মাথা গোঁজার ঠাঁই নিজেকেই তৈরি করতে হবে।
গত বছরের ডিসেম্বরে বাউনিয়া বাঁধ পুকুরপাড় বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। মাত্র ১১ মাসের মাথায় আবারও ঘটে এ বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। গার্মেন্টস শ্রমিক জুলহাস মিয়া বলেন, দু-এক বছর পরপরই এ বস্তিতে আগুন লাগে। কিন্তু এসব ঘটনার সুনির্দিষ্ট কারণ কখনোই জানা যায় না। তিনি বলেন, বিভিন্ন সময় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে ক্ষমতাসীনদের দ্বন্দ্ব হয়। আর এর জেরেই আগুন লাগতে পারে। তবে কারা বস্তি নিয়ন্ত্রণ করেন তা সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারেননি তিনি।
এদিকে আগুনের ঘটনা পরিদর্শন করতে গিয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য ইলিয়াস মোল্লা সাংবাদিকদের বলেছেন, বস্তির ভেতর অনেক ব্যাটারিচালিত রিকশার গ্যারেজ ছিল। এসব গ্যারেজে অবৈধভাবে বৈদ্যুতিক সংযোগ নেয়া হয়েছে। সেখান থেকেই আগুনের ঘটনা ঘটে থাকতে পারে।
এদিকে নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, বস্তির এসব অগ্নিকাণ্ড নিছক দুর্ঘটনা, নাকি উদ্দেশ্যমূলক তা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা উচিত। সাধারণত বস্তিগুলো সরকার বা ব্যক্তি মালিকানাধীন পরিত্যক্ত জমিতে গড়ে ওঠে। অনেক সময় ভূমি মালিক জমি খালি করার জন্য বস্তিতে আগুন লাগিয়ে দেন। এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে।
তাই সিটি কর্পোরেশন, থানা-পুলিশসহ সংশ্লিষ্টদের তদন্ত করে অগ্নিকাণ্ডের কারণ বের করতে হবে। পাশাপাশি ভুক্তভোগীদের সহায়তায় স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, অর্থাৎ সিটি কর্পোরেশনকে এগিয়ে আসতে হবে। নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, এখনই সরকারের উচিত সিটি কর্পোরেশনকে দায়িত্ব দেয়া। পাশাপাশি সব সেবার বৈধ সংযোগ ব্যবস্থা করার পরামর্শ দেন তিনি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন