গুলিস্তানের বঙ্গবন্ধু এভিনিউ লাগোয়া ফুটপাত। বেলা গড়িয়ে বিকেল হতেই ফুটপাতে বসানো দোকানে বেচাকেনা বাড়তে থাকে। এর মধ্যেই এক যুবক পায়চারি করতে করতে গিয়ে দাঁড়ালেন একটি টি-শার্টের দোকানের সামনে। হাত বাড়িয়ে দিলেন দোকানির দিকে। দোকানি অনুনয় করে বলছিলেন, ‘বেচাকেনা শুরু হয় নাই, সন্ধ্যায় আইয়েন টাহা দিমুনে।’ এতে মারমুখী হয়ে উঠলেন ওই যুবক। বললেন, ‘চাঁদা নাই তো দোকান নাই, কালকে যেন এহানে তোর দোহান না দেহি।’ তাঁর কথা শেষ হয়নি, দোকানি ১০০ টাকার একটি নোট বাড়িয়ে দিলেন।
এ ঘটনা গত ২৭ অক্টোবরের। যে দোকানি টাকা দিলেন তাঁর নাম সুরুজ আলী। তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, যে যুবকটি টাকা নিলেন, তিনি এ এলাকার ‘লাইনম্যান’। তাঁর নাম ইউসুফ। এরই মধ্যে একই ভঙ্গিতে আরেকটি দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ান ওই যুবক। কাছে গিয়ে পরিচয় দিতেই হাঁটা দিলেন তিনি। কথা বলার জন্য অনুরোধ জানাতেই থামলেন। বললেন, ‘আমি একা না। শুধু বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের ফুটপাতের দোকান থেকে আমার মতো কয়েকজন লাইনম্যান প্রতিদিন কম করে হলেও ১০ হাজার টাকা চাঁদা ওঠায়। এই টাকার বেশির ভাগ থানার পুলিশ, স্থানীয় প্রভাবশালী কিছু রাজনৈতিক নেতার পকেটে চলে যায়। আমরা শুধু তাঁদের হয়ে টাহা ওঠাই।’ পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতা যাঁরা এ চাঁদার ভাগ নেন তাঁদের বিষয়ে জানতে চাইলে রেগে গিয়ে হুমকির সুরে ইউসুফ বলেন, ‘অনেক কইছি, এখান থেকে চলে যান, নাইলে খারাপ হইব।’
২৮ অক্টোবর সন্ধ্যা ৭টা। গুলিস্তানের জিপিও বক্স এলাকার ফুটপাত। এক যুবক ফুটপাতের দোকান থেকে টাকা নিচ্ছিলেন। এক দোকানি কাকুতি-মিনতি করে বলছিলেন, ‘আইজ বেচাকেনা কম, কিছু কম দেই।’ কথা শেষ, দোকান তুলে দেওয়ার ধমক দিতে দেরি হলো না ওই যুবকের। দোকানি আজিমউদ্দিন তাঁর হাতে দেড় শ টাকা তুলে দিলেন।
এরপর ওই যুবক গিয়ে দাঁড়ালেন পাশের দোকানের সামনে। ওই দোকানিও দেড় শ টাকা দিলেন তাঁকে। একে একে জিপিওর সামনের ফুটপাতের ৭০টি দোকান থেকে টাকা নেন ওই যুবক। দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ওই যুবকের নাম নাসির। প্রতিদিন একটা সময়ে এসে ফুটপাতের দোকান থেকে টাকা নিয়ে যান।
অনুসরণ করে নাসিরের কাছে গিয়ে কথা বলতে চাইলে তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, ‘আপনে কে?’ পরিচয় দিতেই বললেন, ‘আমার আশপাশে পুলিশ আছে। আমি তাগো লোক। আমি লাইনম্যান, টাহা তুইলা পুলিশ আর নেতাগো দেই। এ এলাকায় ছয়-সাতটি গ্রুপ আছে, ফুটপাতের টাহা তারা সবাই নেয়।’ বলেই হাঁটতে শুরু করেন নাসির। পিছু নিলে হুমকি দেন, ‘আর আগায়েন না।’ বলতে বলতে জামার নিচে হাত চলে যায়। জামার এক প্রান্ত ওপরের দিকে উঠে যেতেই চোখে পড়ে তাঁর কোমরে কি একটা গোঁজা। অস্ত্র?
গত ২০ অক্টোবর থেকে আট দিন টানা গুলিস্তান এলাকা ঘুরে ফুটপাতের দোকানে চাঁদাবাজির এমন চিত্র দেখা গেছে। গুলিস্তান জিরো পয়েন্ট, ফুলবাড়িয়া টার্মিনাল, গোলাপ শাহ মাজার, স্টেডিয়াম এলাকা, সুন্দরবন স্কয়ারের চারপাশের সড়ক লাগোয়া ফুটপাতসহ ২২টি ফুটপাত ঘুরে জানা যায়, এসব ফুটপাতের প্রায় তিন হাজার দোকান থেকে ৫০ জনেরও বেশি লাইনম্যান চাঁদা তোলে। এ ছাড়া ফুলবাড়িয়া বাস টার্মিনালসহ আশপাশের মার্কেটের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও চাঁদাবাজি চলছে।
সরেজমিন অনুসন্ধান ও বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গুলিস্তান এলাকায় ফুটপাতের দোকানে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছে অন্তত সাতটি সিন্ডিকেট। ক্ষমতাসীন দলের নেতা, সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলরসহ কয়েকজন এসব সিন্ডিকেট চালান। তাঁদের অনেকের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, দুর্নীতি দমন কমিশন, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি), ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার, র্যাবের মহাপরিচালক ও সরকারের একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থায় গত মাসে ১৫টি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন চাঁদাবাজির শিকার ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে একটি অভিযোগ কালের কণ্ঠ’র এই প্রতিবেদকের হাতে রয়েছে।
ব্যবসায়ীদের দাবি, প্রতিদিন একেকটি ফুটপাতের দোকানগুলো থেকে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা চাঁদা তোলে লাইনম্যানরা। সেই হিসাবে ২২টি ফুটপাত থেকে প্রতিদিন প্রায় তিন লাখ, মাসে প্রায় এক কোটি এবং বছরে অন্তত ১২ কোটি টাকা চাঁদাবাজি হয়।
গত ২৯ অক্টোবর দুপুরে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে বাংলাদেশ হকার্স লীগের কেন্দ্রীয় অফিসে গিয়ে কথা হয় এস এম জাকারিয়া হানিফের সঙ্গে। তিনি সংগঠনটির সদ্যোবিদায়ি সভাপতি। ফুটপাতের চাঁদাবাজির বিষয়ে জানতে চাইলে হানিফ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, রাজনৈতিক দলের নেতা ও দখলবাজদের নামে চাঁদা তোলা হয়। শুধু গুলিস্তান নয়, ঢাকায় প্রায় ১০ লাখ হকার ফুটপাতে ব্যবসা করে। সবাইকেই চাঁদা দিয়ে ব্যবসা করতে হয়। আমাদের দাবি, সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে হকারদের পুনর্বাসন করা হোক।’
সাত সিন্ডিকেট : এই প্রতিবেদকের হাতে আসা অভিযোগপত্র অনুযায়ী, চাঁদাবাজ সিন্ডিকেটের একটি নিয়ন্ত্রণ করেন জি এম আতিকুর রহমান। তিনি শাহবাগ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি। তবে তিনি চাঁদাবাজির অভিযোগ অস্বীকার করে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি কোনো চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত নই। যারা আমার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ দিয়েছে, তারা পরিকল্পিতভাবে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।’ আরেকটি সিন্ডিকেট চালান সৈয়দা রোকসানা ইসলাম চামেলী। তিনি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সংরক্ষিত ওয়ার্ডের (১৩, ১৯ ও ২০ নম্বর) কাউন্সিলর। অভিযোগপত্র অনুযায়ী, তাঁর স্বামী টাবু। তিনি ওয়ার্ড বিএনপি নেতা। ভাই রফিকুল ইসলাম স্বপন ২০ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক, মা মহিলা দলের শাহবাগ থানা কমিটির সভানেত্রী। অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, বিএনপি-জামায়াত পরিবারের সদস্য হয়েও চামেলী সরকারি দলে ভিড়ে চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত। তবে কাউন্সিলর চামেলী চাঁদাবাজির সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেছেন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যারা এসব অভিযোগ দিচ্ছে, তারা পরিকল্পিতভাবে আমার বিরুদ্ধে অপবাদ ছড়াচ্ছে।’
ওই অভিযোগপত্রে আবদুর রহমান ওরফে রহমান মোল্লাহ নামের আরেকজনের কথা বলা হয়েছে। তিনিও গুলিস্তান এলাকার একটি অংশে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করেন। রহমান মোল্লাহর বাড়ি বিক্রমপুরে। তিনি ৩০ বছর আগে গুলিস্তানে হকার ছিলেন। তিনি মূলত জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি করেন।
অভিযোগপত্র অনুযায়ী, শাহবাগ থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ইসমাইল হোসেন বাচ্চুর বিরুদ্ধে অস্ত্র কারবার ও গুলিস্তান এলাকায় ব্যাপক চাঁদাবাজির অভিযোগ করা হয়েছে। গুলিস্তান এলাকার সিটি প্লাজা, নগর প্লাজা, জাকির প্লাজা, সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেট, ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট, ঢাকা ট্রেড সেন্টার, পুরান বাজার মার্কেট ও বঙ্গ মার্কেট এলাকায় তাঁর প্রভাব আছে।
আরেকজন লোকমান। তিনি শাহবাগ থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। লোকমান একসময় ফুলবাড়িয়া রেল কলোনি বস্তিতে থাকতেন জানিয়ে অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, লোকমানের ঘনিষ্ঠ ফিরোজ জামায়াত নেতা। ফিরোজ কুমিল্লার লাকসাম এলাকার জামায়াতের দুর্ধর্ষ ক্যাডার ছিলেন। একসময় ফুলবাড়িয়া এলাকার যুবদল নেতা আহমদ কমিশনারের ক্যাডারও ছিলেন এই ফিরোজ।
অভিযোগপত্রের বাইরে ফুটপাতের ব্যবসায়ী ও লাইনম্যানদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মহানগর বিএনপি নেতা মহাজন লিটন, ইরফান, সোহেল, নিউটন, জাকিরসহ আরো কয়েকজনের একটি গ্রুপও গুলিস্তান এলাকায় চাঁদাবাজি করছে। গুলিস্তান এলাকার বিভিন্ন মার্কেটের কতিপয় ব্যবসায়ী এবং সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশের কিছু সদস্যও চাঁদাবাজি করছেন বলে লাইনম্যান ও ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন।
এসব সিন্ডিকেটের হয়ে ফুটপাতের দোকান থেকে যারা প্রতিদিন চাঁদা তোলে, তাদের মধ্যে ইউসুফ ও নাসির ছাড়াও আছেন লম্বা হারুন ও তাঁর শ্যালক দেলোয়ার, সালাম, শহীদ, আলী মিয়া, বিমল, খলিল ও কাদের, নসু, জাহাঙ্গীর, কালা কোটন, বাবুল, তমিজ উদ্দিন, সাজু, কবির, বাবুল ২, মনির ও তরিক আলী, ছালা, কালা নবী, কানা সিরাজ, ভোলা ও সালেহ।
পুলিশের বক্তব্য : পল্টন থানার ওসি আবু বকর সিদ্দিক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ফুটপাতে চাঁদাবাজির অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’
মতিঝিল থানার ওসি মোহাম্মদ ইয়াসির আরাফাত খান বলেন, ‘ফুটপাতে চাঁদাবাজির অভিযোগ পেলেই আমরা ব্যবস্থা নিই। নিয়মিত ফুটপাতের দিকে আমাদের নজরদারি রয়েছে।’
তবে ফুটপাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, থানায় অভিযোগ দিয়ে প্রতিকার পাওয়া যায় না। কারণ ‘যারা রক্ষক, তারাই তো ভক্ষক’। বরং অভিযোগ দিলে দোকান হারাতে হয়। না হয় চাঁদার পরিমাণ বেড়ে যায়। প্রতিদিন এক থেকে দেড় শ টাকার পাশাপাশি মাসে কমপক্ষে পাঁচ হাজার টাকা দিতে হয় তখন।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, করোনা মহামারির সময় গত মার্চ মাস থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তাঁরা দোকান নিয়ে বসতে পারেননি। যখন আবার ব্যবসা করতে বসলেন, তখন আগের চেয়ে চাঁদার হারও বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আগে যেখানে দোকানপ্রতি ৫০ টাকা দিতে হতো, এখন দ্বিগুণের বেশি দিতে হয়। যে দোকানে বেচাকেনা বেশি, সেই দোকানের চাঁদাও বেশি। এখন দোকানপ্রতি ১০০ থেকে শুরু করে ৫০০ টাকা পর্যন্ত দিতে হয়।
১৫ বছর ধরে গুলিস্তানের ফুটপাতে ব্যবসা করে আসা রহমত আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা প্রতিদিন যে টাকা চাঁদাবাজদের দিই, সেই টাকা সরকারকে দিতে চাই। বিনিময়ে গরিব মানুষগুলোর জন্য বৈধভাবে কাজ করে খাওয়ার সুযোগ করে দিলে ভালো হয়।’
সিটি করপোরেশনের বক্তব্য : ঢাকা দক্ষিণের মেয়রের মুখপাত্র ও জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবু নাসের কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘লাইনম্যান হোক আর যে-ই হোক, চাঁদাবাজ সন্ত্রাসীদের ছাড় নেই। সিটি করপোরেশনের নামে কেউ যদি চাঁদাবাজি করে, তাহলে মেয়র মহোদয়ের কাছে অভিযোগ করলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ফরিদ উদ্দিন রতন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এক মহিলা কাউন্সিলরসহ অনেকেই এই অবৈধ কর্মকাণ্ডের নিয়ন্ত্রক বলে অভিযোগ আমিও পেয়েছি। এ নিয়ে অনেক জায়গায় অভিযোগ দিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘এখন শুধু ফুটপাতই নয়, রাস্তার ওপরও দোকান বসছে। এতে ব্যাপক যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের অন্যত্র পুনর্বাসন করলে এলাকায় দোকানও থাকবে না, চাঁদাবাজিও হবে না। আর যানজট থাকবে না।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন