সাধারণত ৫০ বা ১০০ বছরের চাহিদার কথা মাথায় রেখে গ্রহণ করা হয় পরিকল্পনা। আর বড় অবকাঠামোগত প্রকল্পের পেছনে থাকে দীর্ঘমেয়াদি সুফল পাওয়ার আশা। তবে বাংলাদেশে এ চিত্র অনেকটাই ভিন্ন। কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষেই ধরা পড়ে ত্রুটি। সেগুলো সংশোধনের জন্য আবার নেওয়া হয় প্রকল্প। এতে অপচয় হয় সম্পদ ও সময়ের। এ ধরনের ত্রুটিপূর্ণ কয়েকটি অবকাঠামো নিয়ে অনুসন্ধান করেছে শেয়ার বিজ।
ইসমাইল আলী: ঢাকার যানজট নিরসনে নির্মাণ করা হচ্ছে উত্তরা-মতিঝিল মেট্রোরেল। তবে এ মেট্রোরেলের উচ্চতা অনেক কম। এতে কয়েকটি প্রকল্প নিয়ে জটিলতা দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম প্রস্তাবিত শান্তিনগর-ঝিলমিল ফ্লাইওভার। কম উচ্চতার কারণে ফ্লাইওভাটি নির্মাণ করতে হবে মেট্রোরেলের ওপর দিয়ে। এতে প্রায় ১০০ ফুট (৩১ মিটার) উচ্চতা দিয়ে যাবে ফ্লাইওভারটি।
এদিকে ফ্লাইওভারের উচ্চতা বাড়ায় ওঠানামার র্যাম্প হবে অনেক বড়। এজন্য জমি অধিগ্রহণ ও নির্মাণ ব্যয় অনেক বেশি হবে। এছাড়া নিচে মেট্রোরেল ও তার ওপর ফ্লাইওভার বিশ্বের কোথাও দেখা যায় না। তবে শুধু মেট্রোরেলই নয়, ঢাকায় নির্মিত ও চলমান অন্য প্রকল্পগুলোতেও রয়েছে ত্রুটি। এজন্য মূলত দুর্বল পরিকল্পনা কমিশনকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।সূত্রমতে, উত্তরা-মতিঝিল মেট্রোরেলে পিলারের উচ্চতা ১১ মিটার। এর ওপর ভায়াডাক্ট ও অন্যান্য কাঠামো স্থাপন করা হবে। যদিও বিশ্বের কোনো দেশে এত কম উচ্চতায় মেট্রোরেল নির্মাণ করা হয় না। পার্শ^বর্তী দেশ ভারতে দিল্লি মেট্রোর উচ্চতা ২৩ দশমিক ৬০ মিটার। এছাড়া পুনে ও ব্যাঙ্গালুরুতে ফ্লাইওভার কাম মেট্রোরেল নির্মাণ করা হচ্ছে। এগুলোর উচ্চতা যথাক্রমে ১৬ ও ১৭ মিটার। তিনতলাবিশিষ্ট এসব মেট্রোরেলের দ্বিতীয় তলাটি ফ্লাইওভার। তার ওপরে থাকছে মেট্রোরেল।
এদিকে ঢাকায় মেট্রোরেলের উচ্চতা কম হওয়ায় প্রস্তাবিত শান্তিনগর-ঝিলমিল ফ্লাইওভার নির্মাণে জটিলতা দেখা দিয়েছে। কারণ মেট্রোরেল পল্টন মোড় হয়ে মতিঝিল যাবে। আবার ফ্লাইওভারটিও পল্টন অতিক্রম করে গুলিস্তানের দিকে যাবে। ফলে ফ্লাইওভারটির উচ্চতা অনেক বেড়ে যাবে।
সম্প্রতি ফাস্ট ট্রাক কমিটির বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এতে জানানো হয়, উত্তরা-মতিঝিল মেট্রোরেলে পিলারের উচ্চতা হবে ১১ মিটার। আর ভায়াডাক্টের উচ্চতা আড়াই মিটার। এছাড়া মেট্রোরেল চলাচলকারী ট্রেন এবং উপরের বৈদ্যুতিক ব্যবস্থার উচ্চতা সাত দশমিক ৮৬ মিটার। এর উপরে আরও দুই দশমিক ৬৪ মিটার কাঠামো থাকবে। ফলে মেট্রোরেল চালানোর জন্য হাইট ক্লিয়ারেন্স তথা উচ্চতা প্রয়োজন ২৪ মিটার। এর ওপর দিয়ে ফ্লাইওভারের ভায়াডাক্ট বসবে। ফলে ফ্লাইওভারটির উচ্চতা দাঁড়াবে ৩১ মিটার।
এদিকে মেট্রোরেলের জন্য মগবাজার-সাতরাস্তা ফ্লাইওভারের এফডিসি মোড়ের র্যাম্পটিও ছোট করতে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছিলেন র্যাম্পটিকে কারওয়ান বাজার মোড় অতিক্রম করে পান্থপথ পর্যন্ত নিয়ে যেতে। তবে মেট্রোরেলের উচ্চতা কম হওয়ায় তা বাতিল করা হয়। এতে হোটেল সোনারগাঁওয়ের সামনেই র্যাম্পটি শেষ করা হয়। এছাড়া মেট্রোরেলের কম উচ্চতার কারণে নির্মাণাধীন ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের খামারবাড়ির র্যাম্পটি বাদ দিতে হয়েছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামছুল হক শেয়ার বিজকে বলেন, উত্তরা-মতিঝিল মেট্রোরেল ঢাকা শহরকে বামনের শহর বানিয়ে দিয়ে গেল। জাইকার (জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা) বিশেষজ্ঞরা থাকার পরও এটা কেমন করে হলো সেটা খতিয়ে দেখা উচিত। শুধু একটি মেট্রোরেলের কম উচ্চতার কারণে বেশকিছু প্রকল্পে জটিলতা দেখা দিয়েছে। শান্তিনগর-ঝিলমিল ফ্লাইওভারকে মেট্রোরেলের ওপর দিয়ে নির্মাণ করতে হবে। অথচ বিশ্বের কোথাও এমনটি নেই।
তিনি বলেন, সাধারণত ফ্লাইওভার হয় নিচে ও মেট্রোরেল নির্মাণ করতে হয় সবার উপরে। কারণ ফ্লাইওভারে ওঠানামার র্যাম্প থাকে। তবে মেট্রোরেলে কোনো র্যাম্প থাকে না। অথচ ঢাকায় তার উল্টোটা করতে হচ্ছে। এতে ফ্লাইওভারের ওঠানামার র্যাম্প অনেক লম্বা করতে হবে। ফলে জমিও লাগবে বেশি আবার নিচের সড়কও আটকে যাবে অনেকটা। এছাড়া ফ্লাইওভার নির্মাণ ব্যয়ও বেড়ে যাবে।
সূত্রমতে, মেট্রোরেল নির্মাণ ও পরিচালনার জন্য পৃথক কোম্পানি গঠনের শর্ত দিয়েছিল প্রকল্পটিতে অর্থায়নকারী সংস্থা জাইকা। এর পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা গণপরিবহন কোম্পানি (ডিএমটিসিএল) গঠন করা হয়। কোম্পানিটির এমডির ২০ বছরের রেলওয়েবিষয়ক কারিগরি জ্ঞান থাকার কথা। যদিও এ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে অবসরপ্রাপ্ত এক আমলাকে, যা শর্তের সম্পূর্ণ লঙ্ঘন।
শুধু মেট্রোরেল প্রকল্পই নয়, ঢাকার নির্মিত, নির্মাণাধীন ও প্রস্তাবিত বিভিন্ন প্রকল্পেই পরিকল্পনাগত ত্রুটি রয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ঢাকা-টঙ্গী রেলপথ চার লেন করা হচ্ছে, বর্তমানে যা দুই লাইনের। এতে ঢাকায় ট্রেনের চলাচল বাড়বে। ফলে ঢাকা শহরের যানজট আরও বাড়বে। অথচ ২০০৫-০৬ সাল থেকেই ঢাকার লেভেল ক্রসিংগুলোয় রেলওয়ে আন্ডারপাস-ওভারপাস নির্মাণের কথা হচ্ছে, যার কোনো অগ্রগতি নেই।
আবার মহাখালী ও সাতরাস্তা-মগবাজার ফ্লাইওভারের কারণে বিমানবন্দর-কেরানীগঞ্জ বিআরটি (বাস র্যাপিড ট্রানজিট) নির্মাণ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া ঢাকার চারপাশে বিভিন্ন নিচু সেতুর কারণে বৃত্তাকার নৌপথ চালু করা যায়নি। আর গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের কারণে মেট্রোরেলের রুট দুইবার পরিবর্তন করতে হয়েছে। ফলে এটিকে পুরোনো ঢাকার সঙ্গে যুক্ত করা যায়নি। আবার সায়েদাবাদের পরিবর্তে মতিঝিলেই শেষ করতে হচ্ছে মেট্রোরেল।
এদিকে ঢাকা শহরে নির্মিত মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের ওপর দুটি ক্রসিং (মোড়) রয়েছে। এগুলোয় সিগন্যাল বাতি বসানো হয়েছে, যা বিশ্বে নজিরবিহীন বলে মনে করেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, সিগন্যাল ফ্রি করতে ফ্লাইওভার নির্মাণ করে তার ওপর আবার বসল সিগন্যাল বাতি। কিন্তু দেখার কেউ নেই। ভুল ধরার কেউ নেই।
অধ্যাপক শামছুল হক বলেন, ঢাকা শহরে এ ধরনের অপরিকল্পিত ও ত্রুটিপূর্ণ অবকাঠামো নির্মাণের জন্য দায়ী মূলত দুর্বল পরিকল্পনা কমিশন। সেখানে শত শত পরিকল্পনাবিদ থাকা উচিত ছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয়, পরিকল্পনা কমিশনে কোনো পরিকল্পনাবিদ নেই। যখন যে সংস্থাই প্রকল্প নিয়ে যাচ্ছে তারা অনুমোদন করে দিচ্ছে। সেটা ভুল না ঠিক, তা যাচাই করার কেউ নেই। ভুলগুলো কারা করছে, কীভাবে করছে তারও কোনো জবাবদিহি নেই, যা খুবই দুঃখজনক।
তিনি বলেন, ‘আমাদের একটা সুবিধা ছিল, আমরা অনেক দেরিতে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ শুরু করেছিলাম। তাই যাচাই-বাছাই করে সঠিক ও আধুনিক পদ্ধতি গ্রহণের সুযোগ ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমরা ভুলপথে হাঁটছি। এতে ঢাকাকে স্থায়ী ভুলের শহর বানিয়ে ফেলা হয়েছে। ফলে আগামীতে কোনো ওষুধই আর ঢাকার জন্য কাজ করবে না।’
সূত্র: শেয়ার বিজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন