রাজধানীর বনানীতে এফআর টাওয়ারে আগুন লেগে ২৬ জন নিহত হওয়ার পর নড়েচড়ে বসেছে রাজউক৷ তারা সোমবার থেকে ঝঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করার কাজ শুরু করেছে৷ কিন্তু চিহ্নিত করার পর কী হবে, তা সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারেননি রাজউক চেয়ারম্যান৷
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) গত বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ঢাকার বিভিন্ন এলাকার দুই লাখ চার হাজার ভবনের ওপর জরিপ চালায়৷ এই ভবনগুলো তিন তলা বা তার বেশি উচ্চতার৷
তারা ওই জরিপে দেখতে পায়, প্রতি ১০টি ভবনের নয়টিই অনুমোদন ও নকশার বাইরে গিয়ে তৈরি করা হয়েছে৷ দুই লাখ চার হাজার ১০৬টি ভবনের মধ্যে এক লাখ ৩৪ হাজার ৬২৫টি ভবন নিয়ম ভঙ্গ করে নির্মাণ করা হয়েছে৷ শতকরা হিসেবে এটা ৬৬.১১ ভাগ৷
২০১২ সালে ফায়ার সার্ভিস, ডেসা, ওয়াসা, পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন দেয়া ১১২টি ভবনে বুয়েটের করা গবেষণায় দেখা যায়, মাত্র দুটি ভবন তাদের সব নির্মাণ নীতিমালা মেনেছেন৷ বাকিরা কোনো না কোনো নিয়ম এড়িয়েছেন, অথবা মানলেও তা অকার্যকর৷
২০১৬ সালে ড্যাপ-এর করা জরিপে দেখা যায়, ঢাকা শহরে সাততলা বা তার চেয়ে উঁচু ভবন আছে ১৬ হাজার ৯৩০টি৷ স্বাভাবিক নগরায়ন ও উন্নয়নের কারণে গত দুই বছরে এর সংখ্যা আরো ১০-১৫ ভাগ বেড়েছে৷ আইন অনুযায়ী এসব ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র থাকা বাধ্যতামূলক৷ কিন্তু ফায়ার সার্ভিস থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে ২০০০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মাত্র পাঁচ হাজার ২৪টি ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ছাড়পত্র নেওয়া হয়েছে৷ তাহলে এটা স্পষ্ট যে দুই তৃতীয়াংশের বেশি বহুতল ভবনের ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র নেই৷ আর গত বছর ফায়ার সার্ভিস পাঁচ হাজারেরও বেশি ভবনকে নোটিশ দেয়৷ কারণ তাদের ফায়ার সিস্টেম নেই বা কার্যকর নয়৷
রাজউক যা করছে
রাজউকের চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রহমান বার্তা সংস্থা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘গত বছরের জরিপে আমরা নিয়ম ভেঙে ভবন নির্মানে নানা ধরনের ত্রুটি পেয়েছিলাম৷ তারমধ্যে নকশার বাইরে গিয়ে ভবন বর্ধিত করাই প্রধান৷ তবে এবার আমরা যে কাজ শুরু করেছি তাতে হাই-রাইজ ভবনের সেফটি সিকিউরিটি, বিশেষ করে ফায়ার ফাইটিং সিস্টেমকে প্রাধান্য দিচ্ছি৷ আজ (সোমবার) থেকেই কাজ শুরু হয়েছে৷ ১৫ দিনের মধ্যে আমরা এই কাজ শেষ করতে চাই৷ এরপর আমরা নিচু ভবনগুলো নিয়ে কাজ করব৷ আমাদের কাজ ধারাবাহিকভাবে চলবে।’
ঢাকা শহরকে মোট আটটি জোনে ভাগ করে রাজউকের ২৪টি টিম এই ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করার কাজ করছে৷ প্রতিটি টিমে ৮-১০ জন সদস্য রয়েছেন৷ তবে টিমে ফায়ার সার্ভিসের কোনো লোক রাখা হয়নি৷
রাজউকের নোটিশ বলছে, তারা ১০ তলা বা তার চেয়ে বেশি উঁচু ভবনে চিহ্নিত করার কাজ করবে৷ রাজউক চেয়ারম্যান জানান এধরনের ভবন ঢাকা শহরে ৩-৪ হাজারের বেশি হবে না৷
এই ভবনগুলো চিহ্নিত করার পর কী ব্যবস্থা নেয়া হবে জানতে চাইলে রাজউক চেয়ারম্যান বলেন, ‘আইনে যা আছে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে৷ কোন ভবনের কী ত্রুটি আছে, তা দেখে ব্যবস্থা নেয়া হবে৷ ফায়ার সিঁড়ি, যন্ত্রপাতি ঠিকমত আছে কি না, কাজ করে কি না, তা আমরা দেখছি৷ আমরা তা ঠিক করতে নোটিশ দেব৷ ভবন মালিকরা যদি সে অনুযায়ী কাজ না করেন তাহলে আরও কঠিন ব্যবস্থা নেব।’
এদিকে স্থপতি ইকবাল হাবিব ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘রাজউক যেভাবে সারা ঢাকা শহরের ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করতে নেমেছে তা আসলে কোনো কাজে আসবে বলে মনে হয়না৷ এতে বছরের পর বছর লেগে যাবে৷ কাজটি করা দরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে৷ যেমন মার্কেট, শপিং কমপ্লেক্স, অফিস, বাণিজ্যিক কেন্দ্রর মতো ভবন, যেখানে লোক সমাগম বেশি হয় সেগুলো নিয়ে আগে কাজ করা দরকার৷ সেগুলোর ফায়ার সেফটি ও সিকিউরিটি নিয়ে আগে ভাবা উচিত৷ আগে জরুরি ভিত্তিতে জীবন রক্ষার উদ্যোগ নিতে হবে৷ রাজউক যেভাবে কাজ শুরু করেছে তাতে আমার মনে হয় তারা বিষয়টি অন্যদিকে নিয়ে যেতে চায়।’
‘বাংলাদেশে বড় উদাহরণ হলো পোশাক কারখানা৷ রানা প্লাজা ধসের পর এক দেড় বছরের মধ্যে পোশাক কারখানাগুলো সেফটি সিকিউরিট উন্নত করেছে৷ ফায়ার ফাইটিং সিস্টেমকে মানম্পন্ন করেছে৷ এটা সম্ভব হয়েছে ক্রেতাদের চাপের কারণে৷ রাজউক এই মডেল অনুসরণ করতে পারে।’
ভবন ৪০ হাজার, অকুপেন্সি সার্টিফিকেট মাত্র ১৬১
২০০৮ সালে ইমারত নির্মাণ আইন পরিবর্তন করে অকুপেন্সি সার্টিফিকেটের বিধান করা হয়৷ এই বিধান অনুযায়ী, ভবন নির্মাণের পর রাজউক এবং এক্সপার্টদের নিয়ে গঠিত একটি কমিটি ভবনটি অনুমোদিত নকশা এবং সব নিয়ম মেনে তৈরি হচ্ছে কিনা, তা দেখে ব্যবহারের ছাড়পত্র দেবে৷ তারপর গ্যাস ও বিদ্যুৎ লাইন দেয়া হবে৷
স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ‘২০০৮ সালের পর থেকে ঢাকা শহরে ৪০ হাজার ভবন নির্মাণ করা হয়েছে, কিন্তু অকুপেন্সি সার্টিফিকেট নিয়েছে মাত্র ১৬১টি ভবন৷ তাহলে রাজউক কী করেছে, এটাতো রাজউকেরই কাজ৷’
তিনি দাবি করেন, ‘ঢাকা শহরের ভবনগুলোর এইযে দূরবস্থা বা ভবনগুলো যে মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে তার জন্য প্রধান এবং প্রথম দায়ী রাজউক৷ এটা তাদের অবহেলা এবং দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের কারণে হয়েছে৷ প্রতিবছর তাদের ভবন পরিদর্শন করে কোনো আইনের ব্যত্যয় ঘটেছে কি না, তা দেখে ব্যবস্থা নেয়ার কথা৷ তারা কাজ করলেতো এই পরিস্থিতি হতো না৷ তাদের কেউ কেউ অবৈধভাবে নিয়ম না মেনে ভবন নির্মাণে উলটো সহযোগিতা করে।’
ইকবাল হাবিব আরও বলেন, ‘রাজউক তার মূল কাজ না করে জমি ও ফ্ল্যাটের ব্যবসা করছে৷ আর মানুষ মারা গেলে তারা বলে ভবনটি অননুমোদিত৷ এই অননুমোদিত ভবনের দায় রাজউকের৷ এরজন্য তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।’
এদিকে, রাজউক চেয়ারম্যান বলছেন, ‘আমাদের পক্ষে সবসময় মনিটরিং করা সম্ভব হয় না৷ আমরা এর আগে ভবনগুলোর ছোটখাট ত্রুটি পেয়েছি৷ যেমন কর্নিশ বড় করা, বাড়তি বরান্দা নির্মাণ৷ এফআর টাওয়ারে আমরা বড় ধরনের ত্রুটি দেখতে পেলাম৷ আমাদের কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীর অবহেলা বা দুর্নীতির কারণে যদি এটা হয় তাহলে আমরা অবশ্যই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবো৷ এটা সরকারের একটি প্রতিষ্ঠান, এখানে দুর্নীতি প্রমাণ হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে৷'
এফআর টাওয়ারের নথি
এফআর টাওয়ারের নকশা এবং অনুমোদন নিয়ে নানা বিতর্ক চলছে৷ রাজউক চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমরা তাদের ১৮ তলা পর্যন্ত অনুমোদনের কাগজ খুঁজে পেয়েছি৷ কিন্তু পরে যে আরও ২৩ তলা পর্যন্ত বাড়ানো হয় তার কাগজপত্র পাইনি৷ কিছু ফটোকপি পেয়েছি৷ এখন আমরা খতিয়ে দেখছি ওই কাগজগুলো সঠিক কি না৷ আর বাড়তি পাঁচ তলার অনুমোদন দেয়া হয়ে থাকলে তা কীভাবে দেয়া হয়েছে।'
এদিকে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি রাজউক থেকে ওই ভবনের কোনো নকশা পায়নি৷ তারা নকশা ছাড়াই তদন্ত শুরু করেছে৷ –ডয়েচে ভেলে
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন