রাজধানী ঢাকার কয়েকটি এলাকায় শনিবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাসাবাড়ি ও সিএনজি ফিলিং স্টেশনগুলোতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ ছিল। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েন শহরের একাংশের বিপুলসংখ্যক মানুষ। সংশ্লিষ্ট গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান তিতাস জানিয়েছে যান্ত্রিক ত্রুটি সারাতে গিয়ে নগরবাসীকে এ দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে।
ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরে কয়েক ঘণ্টা গ্যাস সরবরাহ না থাকলে মানুষের দুর্ভোগের মাত্রা কোথায় গিয়ে ঠেকে তার চিত্রটা জানা যাবে ভুক্তভোগীদের বক্তব্যে।
মিরপুর শেওড়াপাড়া এলাকার গৃহিণী আয়েশা আক্তার বলছেন, ‘ছেলে-মেয়েরা স্কুল-কলেজে যাবে। স্বামী যাবেন অফিসে। সকালে উঠে তাদের জন্য নাশতা তৈরি করতে গিয়ে দেখি চুলায় গ্যাস নেই। কোনো উপায় না দেখে আশপাশের হোটেল থেকে খাবার আনতে পাঠিয়েছি ছেলেকে। হোটেলে তখন দীর্ঘ লাইন। আমাদের মতো অনেক পরিবারের লোকজন তখন স্থানীয় রেস্তোরাঁগুলোতে লাইন দিয়েছে। ফলে দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর খাবার পাওয়া গেছে। সে খাবার খেতে খেতে বাচ্চাদের স্কুল-কলেজ যেমন দেরি হয়েছে তেমনি স্বামীও অফিসে গেছেন দেরিতে। দুপুরেও একই অবস্থা। গ্যাস নেই তো রান্নাও হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘যান্ত্রিক ত্রুটির খবর আগে থেকে জানলে হয়তো কিছুটা প্রস্তুতি নেওয়া যেত। কিন্তু হঠাৎ করে হওয়ার ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে।’
জানা গেছে, জরুরি রক্ষণাবেক্ষণ কাজের জন্য গতকাল সকাল থেকে আশুলিয়া ও আমিনবাজার সিজিএস প্লান্ট থেকে তিতাসে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ ছিল। এর প্রভাব পড়ে ঢাকার বেশ কয়েকটি এলাকার শিল্প, বাণিজ্যিক, আবাসিক এলাকায়। তিতাসের তথ্য অনুযায়ী প্রায় ২৮ লাখ আবাসিক সংযোগ রয়েছে তাদের। ভুক্তভোগীরা বলছেন, এতেই অনুমান করা যায়, রাজধানীর বিপুলসংখ্যক বাসিন্দাকে কতটা ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে।
অনেকে এই ভেবে আঁতকে উঠছেন, কয়েক ঘণ্টা গ্যাস না থাকাতে যদি এমন দুর্ভোগে পড়তে হয়, তাহলে বড় ধরনের কোনো বিপর্যয় ঘটলে তো ঢাকা রীতিমতো অচল হয়ে পড়বে। এমনকি বড় ধরনের মানবিক সংকটও তৈরি হতে পারে। কারণ, শুধু গ্যাস নয়, বিদ্যুৎ, ওয়াসা থেকে শুরু করে সর্বত্রই চলছে চরম বিশৃঙ্খলা। নাগরিক সেবা দেওয়ার পবিত্র দায় নেই কারও।
মিজান সুমন নামের কাঁঠাল বাগান এলাকার বাসিন্দা খেদ প্রকাশ করে বলেন, ‘ঢাকা শহর তো ভোগান্তির শহর। নাগরিক সেবা দানকারী কোনো প্রতিষ্ঠানেই কোনো শৃঙ্খলা নেই। এই শহরে প্রায় দুই কোটি মানুষ বসবাস করছেন। তাদের জীবনমান, নিরাপত্তা, নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করা এবং ভোগান্তিমুক্ত করার ব্যাপারে কারও কোনো দায় নেই বলেই মনে হয়।’
তিনি বলেন, ‘বিশ্বের বসবাস অযোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকা প্রথম হয়। যানজটে শুধু কর্মঘণ্টাই নয়, জীবনের বিশাল সময় নষ্ট হয় মানুষের। উপর্যুপরি পরিবেশ দুষণের কারণে প্রচণ্ড স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকে এখানকার নাগরিকরা। বিদ্যুৎ,ওয়াসা, রোডস অ্যান্ড হাইওয়েসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বছরের প্রায় প্রতিদিনই রাজধানীর কোনো না কোনো এলাকার দীর্ঘ রাস্তা খুঁড়ে রাখছে। তার ওপর নানা উন্নয়ন প্রকল্প তো সর্বত্রই চলছে। এসবের কারণে জনভোগান্তি তৈরি হতে পারে, কিন্তু সেটা সমন্বিতভাবে নিরসনের কোনো চেষ্টাই করে না কেউ। উপরন্তু এ শহরে বসবাসকারী মানুষ অনেকটাই জিম্মি সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কাছে। এতে চরম অমানবিক জীবনযাপন করতে বাধ্য হয় নাগরিকরা।’
রামপুরা এলাকার বাসিন্দা আফজাল রহমান বলেন, ‘এই শহরের সবচেয়ে বড় ভোগান্তির জায়গা গণপরিবহন ও ট্রাফিক ব্যবস্থা। কোনো পরিবহনই শৃঙ্খলার মধ্যে নেই। নেই নির্দিষ্ট বাসস্টপেজ, বাসে সরকার নির্ধারিত ভাড়া মেনে চলার বালাই নেই, লোকাল সার্ভিস তুলে দিয়ে সিটিং সার্ভিসের নামে প্রতারণার ব্যবসায় নেমেছে বাস মালিকরা। দুর্বৃত্ত মানসিকতার ড্রাইভার-হেলপারদের দিয়ে গণপরিবহন পরিচলনা করা হয়। রাস্তায় তারা পাল্লা দিয়ে গাড়ি চালায়। তাদের রেষারেষিতে মানুষের জীবন যায়-এসব দেখার কেউ নেই। ট্রাফিক বিভাগ ভয়ঙ্কর দুর্নীতিগ্রস্ত। সবখানে একটা দুষ্টচক্র গড়ে উঠেছে। ফলে একটাকে বাদ দিয়ে আরেকটাকে ভালো করা যায় না। এসব অব্যস্থাপনা ও বিশৃঙ্খলার প্রভাব এসে পড়ছে নাগরিক জীবনে।’
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক ২০১৫ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে তার ইশতেহারে ‘মানবিক ঢাকা’ গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ঢাকার গণপরিবহন, পরিবেশ, স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ নানা খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে বসবাস উপযোগী ও মানবিক ঢাকা শহর গড়ে তোলার কাজ তিনি শুরুও করেছিলেন নির্বাচনে জেতার পর। বেশ কিছু প্রশংসনীয় উদ্যোগ তিনি গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু সব উদ্যোগই মুখ থুবড়ে পড়ে তার আকস্মিক মৃত্যুর পর।
রাজধানীর যানজটের অন্যতম উৎসস্থল সাতরাস্তার ট্রাকস্ট্যান্ড উচ্ছেদ করেছিলেন তিনি। কিন্তু তার মৃত্যুর পর পরই সেই স্ট্যান্ড পুনরায় দখল করে নেয় দুর্বৃত্তরা। একইভাবে শ্যামলী থেকে আমিনবাজার পর্যন্ত দীর্ঘ রাস্তা তিনি পার্কিংমুক্ত ঘোষণা করে যানজটমুক্ত করেছিলেন। সেই রাস্তার চিত্র আবারও পুরনো চেহারায় ফিরেছে।
রাজধানী ঢাকার অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজিয়ে নাগরিকবান্ধব অভিন্ন গণপরিবহন ব্যবস্থার আওতায় আনতে কয়েকটি নির্ধারিত কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির ভিত্তিতে রাজধানীতে নামাতে চেয়েছিলেন চার হাজার বাস। নগরীর অভ্যন্তরে অবস্থিত সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, মহাখালী, গাবতলীর মতো বড় বড় বাস টার্মিনালগুলো নগরীর বাইরে স্থাপনের পরিকল্পনাও করেছিলেন তিনি। এমনকি রাজধানীর সবচেয়ে বড় কারওয়ান বাজারের কাঁচাবাজারও স্থানান্তর করে নগরীর বাইরে স্থাপন করার পরিকল্পনা ছিল তার। স্বাস্থ্যকর নগরী গড়ার পরিকল্পনা হিসেবে সাধারণ যান চলাচলের পাশাপাশি অযান্ত্রিক সাইকেল চলাচলের জন্য আলাদা লেনের পরিকল্পনা নিয়েছিলেন আনিসুল। ডিএনসিসি এলাকা থেকে ২২ হাজার বিলবোর্ড অপসারণ করেছিলেন তিনি। সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে নগরের পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থারও সংস্কারে হাতে দিয়েছিলেন। নগরীর স্পর্শকাতর এলাকাগুলোতে তিনি নিবন্ধিত রিকশা ও বাস সার্ভিস চালু করেন। ফুটপাত দখলমুক্ত করা, রাস্তাঘাট সংস্কার ও নির্মাণের পাশাপাশি আধুনিক ও সবুজ ঢাকার ধারণা তুলে ধরেন নগরবাসীর কাছে। গুলশানে আলোচিত ‘ঢাকা চাকা’ বাস সার্ভিসের উদ্যোগ নিয়েছিলেন মেয়র আনিসুল হকই। কিন্তু তার মৃত্যুর পরপরই সেসব উদ্যোগ ও স্বপ্নেরও মৃত্যু ঘটেছে।
গুলশান এলাকার ‘ঢাকা চাকা’ বাসের নিয়মিত যাত্রী, আব্দুর রহমান বলেন, ‘এ বাস সার্ভিস চালু হওয়ার পর বছরখানেক বেশ ভালো সার্ভিস দিয়েছিল। ‘ঢাকা চাকা’ ছাড়া অন্য কোনো গণপরিহন বা সিএনজি-মাইক্রো চলতে না দেওয়া মানুষ ‘ঢাকা চাকার’ ওপরই নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। কিন্তু এখন ‘ঢাকা চাকার’ বাস সংখ্যা ক্রমেই কমে যাচ্ছে। একটা বাস ধরার জন্য অপেক্ষা করতে হয় দীর্ঘ সময়। বাসে চড়ার পর গুলশান-১-এর মোড়ে সিগন্যালে আটকে থাকতে হয় দীর্ঘ সময়। বাসটির ব্যবস্থাপনায়ও সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে নানা ত্রুটি। মুখ বুজে এসব সহ্য করেন যাত্রীরা। কারণ আমরা সবাই জিম্মি হয়ে পড়েছি ঢাকা চাকা কোম্পানির হাতে।’
নানা আইনি জটিলতা কাটিয়ে আনিসুল হকের মৃত্যুর পর ডিএনসিসিতে শূন্য হওয়া মেয়র পদে ভোট অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি। আনিসুল হক যে ‘মানবিক ঢাকা’ গড়ার যাত্রা শুরু করেছিলেন, আগামী সিটি নির্বাচনে বিজয়ী মেয়র সে যাত্রা অব্যাহত রাখবেন কী না তা নিয়েই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট অনেকেই বলছেন, সে যাত্রা যদি অব্যাহত না রাখা হয়, তবে ‘মানবিক ঢাকা’র স্বপ্ন কেবলই স্বপ্নই রয়ে যাবে। বাস্তবায়নের মুখ দেখবে না।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন