ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে সক্রিয় রয়েছে ৬টি সিন্ডিকেট। এখানে সেবা নিতে আসা রোগী এবং তাদের স্বজনদের পড়তে হয় এ সিন্ডিকেটের খপ্পরে। খোয়াতে হয় বাড়তি অর্থকড়ি।
এছাড়া ভর্তি, সিট পাওয়া, পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ প্রতিপদে ভোগান্তির শেষ নেই। সিন্ডিকেটগুলো হচ্ছে- রক্ত, অ্যাম্বুলেন্স, রোগী ভাগানো ও বাচ্চা চোর, আইসিইউ, টেস্ট বাণিজ্য এবং ট্রলি ও হুইলচেয়ার সিন্ডিকেট। অসহায় রোগীকে ঘিরে সিন্ডিকেট সদস্যরা কৌশলে চালায় গলাকাটা বাণিজ্য।
রক্ত সিন্ডিকেট : ঢামেক হাসপাতালের ১০১ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি ছিল কিশোর ইমন। রক্তের গ্রুপ বি-নেগেটিভ। ইমনের মা জায়েদা জানান, এক দালালের মাধ্যমে তিনি এক ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করেন। সে তার কাছ থেকে নেয় ৫ হাজার টাকা। পরে আরেক ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হয়। দালালকে তিনি তিন হাজার টাকা নিতে অনুরোধ জানান।
ওই দালাল তাকে সাফ বলে দেয় এ টাকায় রক্ত কেন, লাল রঙের পানিও মিলবে না। পরে জায়েদা চানখারপুলের বন্ধন ব্লাড ব্যাংক অ্যান্ড ট্রান্সফিউশন সেন্টার থেকে ৩ হাজার ২৪৮ টাকায় এক ব্যাগ বি-নেগেটিভ রক্ত কিনেন। শুধু ইমনই নয়, এ ধরনের রোগীদের জিম্মি করে টাকা আদায় করে রক্ত সিন্ডিকেট।
টেস্ট বাণিজ্য : ঢামেক হাসপাতাল ঘিরে গড়ে উঠেছে টেস্ট বাণিজ্যের শক্তিশালী চক্র। এখানে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ থাকলেও এরা রোগীদের পাঠিয়ে দেয় বাইরের হাসপাতালে। মোহাম্মদপুরের ব্যবসায়ী মাহতাব হোসেনের মেয়ে ফাজিয়া (১৮) ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত হয়ে দুই মাস চিকিৎসাধীন ছিলেন হাসপাতালের ২০৪ নম্বর ওয়ার্ডে।
মাহতাব বলেন, সিটিস্ক্যান, এমআরআইসহ বিভিন্ন টেস্ট করাতে হয়েছে ফাজিয়ার। তিনি জানান, একটি অপারেশনের এক সপ্তাহের মাথায় ফাজিয়াকে ছুটি দিয়ে দেয়া হয়। বাসায় নিয়ে আসার পর সে মারা গেছে। ভুক্তভোগীদের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এখানে বিভিন্ন টেস্টের সুবিধা থাকলেও এ চক্রের সদস্যরা কমিশনের লোভে রোগীদের বাইরে পাঠিয়ে দেয়। প্রতিমাসে কমিশন বাবদ হাতিয়ে নেয় লাখ লাখ টাকা।
আইসিইউ : কিশোরগঞ্জের পরিমল পাল ১২ আগস্ট সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হন। ১৩ আগস্ট রাত ৩টায় তাকে ভর্তি করা হয় ঢামেক হাসপাতালের ১০০ নম্বর ওয়ার্ডে। ভর্তির পর পরিমল পালের স্বজনদের জানানো হয় রোগীকে আইসিইউতে নিতে হবে। তবে ঢামেক হাসপাতালের আইসিইউ খালি নেই। তড়িঘড়ি করে পরিমলকে পাঠানো হয় গ্রিন রোডের ইউনিহেলথ স্পেশালাইজড হাসপাতালে। সেখানকার চিকিৎসকরা জানান, তার জরুরি অস্ত্রোপচার লাগবে।
ওই অস্ত্রোপচার ঢামেক হাসপাতাল ছাড়া হবে না। পরদিন আবার তাকে ঢামেক হাসপাতালে ফিরিয়ে আনা হয়। পরে নিউরো সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. পীযূষ কান্তি মিত্রের তত্ত্বাবধানে পরিমল পালের অস্ত্রোপচার হয়। এভাবেই হয়রানির শিকার হন রোগীরা। বাইরের ক্লিনিকে একটি রোগী পাঠালে তারা কমিশন হিসেবে পান প্রথমেই ৫ হাজার টাকা। পরে প্রতিদিনই পাওয়া যায় মোটা অঙ্কের কমিশন।
অ্যাম্বুলেন্স : ঢামেক হাসপাতালের তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী ও তাদের স্বজনদের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেট। অভিযোগ রয়েছে, হাসপাতালের দায়িত্বরত পুলিশ ও আনসার সদস্যদের ম্যানেজ করে এ চক্র অ্যাম্বুলেন্স বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে যে যেভাবে পারছে রোগীর পকেটের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। ঢাকার বাইরে দূরত্ব অনুযায়ী একটি অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়া ৬ থেকে ১৮ হাজার টাকা দিতে হয়। ঢাকার আশপাশের জেলাগুলোয় গেলেও রোগী ও তাদের স্বজনদের গুনতে হয় কমপক্ষে ৫ হাজার টাকা।
ট্রলি : ঢামেক হাসপাতালে ট্রলি ও হুইলচেয়ার সিন্ডিকেটের সদস্যরা বেপরোয়া। এরা ট্রলিতে করে পৌঁছে দেয়ার নামে রোগীদের কাছ থেকে ইচ্ছেমতো টাকাপয়সা আদায় করে। হাসপাতালে লোক স্বল্পতার কারণে কাজ করছেন বহিরাগতরা। এদের বলা হয় স্পেশাল বয়। এদের নিয়ন্ত্রণ করে কতিপয় সরদার। বকশিশের মাধ্যমে ট্রলিতে রোগী বহনের নিয়ম থাকলেও এরা সরদারদের আশকারায় ইচ্ছামতো টাকাপয়সা দাবি করে রোগীদের কাছে।
রোগী ভাগানো ও বাচ্চা চোর সিন্ডিকেট : ঢামেক হাসপাতাল ঘিরে সক্রিয় রয়েছে দুই শতাধিক দালাল। এছাড়াও রয়েছে বাচ্চা চোর সিন্ডিকেট। ফরিদা, জাহানারা, মিনা, কুলসুমসহ ১০-১২ নারীর বিচরণ থাকে হাসপাতাল এলাকায়। এরা জরুরি বিভাগে আসার পর রোগীদের ফুসলিয়ে বিভিন্ন ক্লিনিকে নিয়ে যায়। এদের কারও কারও বিরুদ্ধে বাচ্চা চুরিতে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ আছে। এছাড়াও রয়েছে বহিরাগত দালালদের দৌরাত্ম্য।
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য : যোগাযোগ করা হলে ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার একেএম নাছির উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, হাসপাতালের অনিয়ম অপরাধ রোধে কাজ করে যাচ্ছি। ভুক্তভোগী কেউ অভিযোগ করলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিই। অ্যাম্বুলেন্সের বিষয়ে তিনি বলেন, যেখানে প্রতিদিন অ্যাম্বুলেন্সের চাহিদা আছে অন্তত ৪০টির, সেখানে আমাদের সরকারি অ্যাম্বুলেন্স আছে মাত্র ৬টি। তিনি বলেন, হাসপাতালে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স বন্ধ করে দিলে রোগীর ভোগান্তি হবে।
টেস্ট বাণিজ্যের বিষয়ে তিনি বলেন, এ হাসপাতালে প্রতিদিন ৭০০ প্যাথলজিক্যাল টেস্ট করার সক্ষমতা আছে। সেখানে টেস্টের চাহিদা আছে ১২শ। এমনিতেই ৫শ’ রোগীকে বাইরে থেকে টেস্ট করতে হয়। তিনি বলেন, অনেকে আবার স্বেচ্ছায় বাইরে থেকে টেস্ট করিয়ে নিয়ে আসেন। তিনি বলেন, কেউ অপরাধ করে তো স্বীকার করে না। তাই কেউ অভিযোগ করলে এর সূত্র ধরে আমরা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন