রাজধানীর উত্তরখানে গ্যাসলাইনের লিকেজ থেকে লাগা আগুনে একই পরিবারের ৮ জন দগ্ধ হন। প্রথম দিনেই গৃহকর্তা আজিজুল ইসলাম ও তার স্ত্রী মোসলেমা মারা যান। গতকাল সকালে আজিজুলের ফুফু সুফিয়া বেগমও পাড়ি জমান না ফেরার দেশে। সবাই একসঙ্গে দগ্ধ হওয়ায় পরিবারটির পাশে থাকার মতো যেন কেউ নেই। তাদের মতো এমন নির্মম পরিণতির মুখোমুখি হচ্ছে অনেক পরিবারই। শুধু লাইন লিকেজ থেকেই নয়, অনেক সময় সারা দেশে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণেও মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। এমন গ্যাস বিস্ফোরণে সমাপ্তি ঘটছে অসংখ্য স্বপ্নেরও।
গত শনিবার ঢাকার উত্তরখান থানার ব্যাপারীপাড়া হেলাল মার্কেটের পাশে ১১০/এ নম্বর বাড়ির নিচতলায় গ্যাস লিকেজ থেকে লাগা আগুনে একই পরিবারের আটজন দগ্ধ হন। দম্পতিসহ তিনজন ইতোমধ্যে
মারা গেছেন। বাকি পাঁচজন আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। দগ্ধরা জানান, ভোরে চুলায় আগুন জ¦ালাতে গেলে পুরো বাসায় আগুন ধরে যায়।
২০১৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি উত্তরার একটি বাসায় গ্যাসলাইন লিকেজে অগ্নিকা-ে দগ্ধ হন একই পরিবারের পাঁচ সদস্য। ঘটনার কয়েক দিন আগেই স্ত্রী ও তিন সন্তানকে নিয়ে নতুন ওই বাসায় ওঠেন ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের তৎকালীন প্রকৌশলী মো. শাহনাওয়াজ। ঘটনার দিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় বড় ছেলে দশম শ্রেণিতে পড়–য়া শালীন বিন শাহনাওয়াজ ও ছোট ছেলে মাত্র ১৪ মাস বয়সী জায়ান বিন শাহনাওয়াজ। এর এক দিন পর মারা যান শাহনাওয়াজ। ঘটনার ৯ দিন পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান মা সুমাইয়া বেগম। ওই ঘটনায় পরিবারের একমাত্র সদস্য মেজো ছেলে জারিফ বিন নাওয়াজ (১১) ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। দীর্ঘদিন চিকিৎসা শেষে পরিবারের সবাইকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ জারিফের ঠাঁই মেলে চাচাতো বোনের কাছে।
ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের আবাসিক সার্জন ডা. পার্থ শংকর পাল বলেন, বাসাবাড়িতে অগ্নিকা-ের ঘটনায় দগ্ধ রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এ ধরনের ঘটনার পর অন্তত ২০ মিনিট পানি ঢালার পর রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে।
ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৫ সালে গ্যাস বিস্ফোরণ থেকে অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে ১৫৬টি। এর পরের বছর ২০১৬ সালে বিস্ফোরণের সংখ্যা ১৯৬। গত বছরের ৯ মাসে ৬১টি অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে চুলার আগুন থেকে অগ্নিকা- হয় ৩৪টি। বাকিগুলো গ্যাস সিলিন্ডার থেকে।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, অসচেতনতার কারণেই বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া মেয়াদোত্তীর্ণ ও নিম্নমানের গ্যাস সিলিন্ডার-সরঞ্জাম ব্যবহার, নিয়মিত গ্যাসলাইন চেক না করাও দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের চিকিৎসকরা বলছেন, গ্যাস বিস্ফোরণে দগ্ধের ঘটনাগুলো সাধারণত বদ্ধ (ঘরের ভেতর) জায়গায় ঘটে। এ কারণে এর ভয়াবহতাও হয় অনেক বেশি। কারণ বদ্ধ জায়গায় বিস্ফোরণ ঘটলে শ^াসনালি দগ্ধ হয়ে থাকে। এ কারণে স্বল্প আহত রোগীরও প্রাণহানির আশঙ্কা বেড়ে যায়। ভয়বাহতা বোঝাতে এক পুলিশ কর্মকর্তা এটিকে গ্যাসবোমা বলেছেন।
গ্যাস লিকেজ হলে ঘরে উৎকট গন্ধ পাওয়া যাবে। এ ধরনের গন্ধ পাওয়া গেলে সতর্ক হয়ে কিছু পদ্ধতি অনুসরণের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। রান্নাঘরে বাতাস চলাচলের যথেষ্ট ব্যবস্থার ওপর সবচেয়ে বেশি জোর দিচ্ছেন তারা। জানালা খুলে বাতাস চলাচলের উপযোগী না করে কোনো অবস্থায় আগুন জ¦ালানো যাবে না। গ্যাসের পাশে দাহ্য জিনিসপত্র একেবারেই রাখা উচিত নয়। গ্যাস সিলিন্ডার সোজা করে রাখা খুবই জরুরি। গ্যাস সিলিন্ডার কখনই ফেলা বা ঘষা-টানা করা উচিত নয়। গ্যাসের পাইপ জোড়াতালি দিয়ে ব্যবহার করা যাবে না। সেফটি ক্যাপ লাগিয়ে রাখতে হবে। গ্যাস বদল করার সময় রেগুলেটরটি লাগানোর সময় ঠিক করে লাগানো হয়েছে কিনা দেখে নিন। বাসায় একাধিক গ্যাস সিলিন্ডার না রাখার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। দগ্ধ স্থানে কাপড় থাকলে তা খুলে ফেলতে হবে।
এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) মেজর একেএম শাকিল নেওয়াজ আমাদের সময়কে বলেন, মূলত লিকেজ থেকেই অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। লিকেজ হচ্ছে কিনা, তা দেখতে হবে সবার আগে। লিকের ফলে পচা ডিমের গন্ধ অথবা শোঁ-শোঁ শব্দ শোনা যাবে। পাইপগুলো বছরে অন্তত একবার পরীক্ষা করতে হবে।
ঘরের জানালা-দরজা বন্ধ থাকায় শীতের দিনে এটা আরও বেশি বেড়ে যাবে জানিয়ে শাকিল নেওয়াজ বলেন, সিটি করপোরেশনের জনপ্রতিনিধি, স্কুল-কলেজে সচেতনতা কর্মসূচি নেওয়া যেতে পারে। তিতাসের অনেক লাইন ৬০-৭০ বছরের পুরনো। তিতাসের উচিত এসব লাইন ঠিক করা, নয়তো বন্ধ করে দেওয়া। সচেতনতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। সব পক্ষকেই সচেতন হতে হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, লিকুইফায়েড পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) সিলিন্ডারের মেয়াদ সাধারণত ১৫ বছর থাকে। কিন্তু ২৫ থেকে ২৮ বছর পুরনো সিলিন্ডারে বাজারজাত করা হচ্ছে। প্রতিটি সিলিন্ডার প্রতি পাঁচ বছর পরপর ব্যবহার উপযোগিতা যাচাই করার কথা থাকলেও তা করা হয় না বললেই চলে। শুধু বাসাবাড়িতে নয়, গাড়িতেও ব্যবহার করা হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ এসব সিলিন্ডার। এছাড়া বাসার গ্যাস সংযোগ লাইনেও অনেক সময় ত্রুটি ধরা পড়ার পর তা ঠিক করতে গড়িমসি করেন বাড়ির মালিকরাÑ ভাড়াটিয়াদের এমন অভিযোগ বেশ পুরনো।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন