রওশন আরার একটি ক্ষতিগ্রস্ত কিডনি কেটে বাদ দিতে গিয়ে চিকিৎসকরা দুটি কিডনিই কেটে ফেলেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। রওশন আরার ছেলে ও চলচ্চিত্র পরিচালক রফিক শিকদারের অভিযোগ, তার মায়ের একটি কিডনিতে ইনফেকশন ধরা পড়লেও চিকিৎসকরা দুটি কিডনিই কেটে ফেলেছেন।
কিন্তু চিকিৎসকরা বলছেন, পেটের এক পাশে কেটে একসঙ্গে দুটি কিডনি বাদ দেয়া সম্ভব নয়। কিডনি ঠিকমতো কাজ না করায় পরীক্ষায় সেটি ধরা পড়ছে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ইউরোলজি বিভাগে এমন ঘটনা ঘটেছে।
এ ঘটনা তদন্তে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি। একই সঙ্গে রোগীর উন্নত চিকিৎসায় তিনি ছয় সদস্যের মেডিকেল বোর্ডও গঠন করেছেন। জানা গেছে, ইউরোলজি বিভাগে রওশন আরাকে ভর্তি করা হলে চিকিৎসকরা পরীক্ষা করে জানতে পারেন তার একটি কিডনিতে ইনফেকশন রয়েছে।
কিডনিটির অবস্থা বিবেচনা করে তারা অপারেশন করে সেটি কেটে ফেলে দেয়ার পরামর্শ দেন। পরামর্শ অনুযায়ী ৫ সেপ্টেম্বর তার অপারেশন হয়। অপারেশনের পর তাকে পোস্ট অপারেটিভে নেয়া হয়। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পর তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ডিউটি ডাক্তার তাকে আইসিইউতে নেয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু হাসপাতালের আইসিইউ খালি না থাকায় স্বজনরা রোগীকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান।
সেখানে ইউরোলজি বিভাগের চিকিৎসক পরীক্ষা করে দেখেন রওশন আরার শরীরে কোনো কিডনি নেই। এ কারণে সেখানে চিকিৎসা দিতে অনীহা প্রকাশ করায় তাকে পুনরায় বিএসএমএমইউর ইউরোলজি বিভাগে নেয়া হয়।
একই সময়ে আরেকটি বেসরকারি হাসপাতালে রোগীর পরীক্ষা করা হয়। সেখানকার চিকিৎসকরাও জানান, রোগীর শরীরে কিডনির কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে না। এসব রিপোর্ট বিএসএমএমইউর সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের দেখানো হলে তারা বলেন, কিডনি নন ফাংশনিং হলে সেটি পরীক্ষায় ধরা নাও পড়তে পারে।
টেলিফোনে রফিক শিকদার যুগান্তরকে বলেন, তার মায়ের বাম পাশের কিডনিতে ইনফেকশন ছিল। চিকিৎসকরা জানান, এটি ফেলে দিতে হবে। মায়ের ডায়াবেটিস ও হাই ব্লাডপ্রেশার না থাকায় এবং সবকিছু মিলিয়ে চিকিৎসকরা বলেন, তার বাম পাশের কিডনিটা ফেলে দিলে তিনি সুস্থ থাকবেন।
মায়ের ডানপাশের কিডনি ভালো ছিল। ৫ সেপ্টেম্বর বিএসএমএমইউর ইউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. হাবিবুর রহমান দুলালের তত্ত্বাবধানে মায়ের বাম কিডনি অপসারণে অস্ত্রোপচার করা হয়।
অস্ত্রোপচারের পর পোস্ট অপারেটিভে মাকে নেয়ার কয়েক ঘণ্টা পর কর্তব্যরত চিকিৎসকরা বলেন, তাকে আইসিইউতে নিতে হবে। তখন মায়ের জ্ঞান ছিল, তিনি কথাও বলছিলেন।
এজন্য বললাম, মাকে দেখে তো মনে হচ্ছে না, আইসিইউতে নেয়ার প্রয়োজন আছে। কিন্তু চিকিৎসকরা তাকে আইসিইউতে নেয়ার জন্য চাপ দেন। বিএসএমএমইউর আইসিইউ খালি না থাকায় মাকে রাত ৩টা-৪টার দিকে মগবাজারের ইনসাফ বারাকাহ কিডনি অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউতে নেয়া হয়।
পরদিন ওই হাসপাতালের কিডনি বিশেষজ্ঞ ডা. ফখরুল মাকে ল্যাবএইড হাসপাতালে পরীক্ষার জন্য পাঠান। সেখানে সিটি স্ক্যান করার পর ডা. ফখরুল বলেন, আগের কাগজপত্রে দেখা যাচ্ছে তার (রওশন) বাম কিডনি কেটে ফেলা হয়েছে। কিন্তু সিটিস্ক্যান পরীক্ষার পর দেখা যাচ্ছে তার ডান পাশের কিডনিও নেই। এমনকি অপারেশনের পর থেকে তার প্রসাব হয়নি।
রফিক শিকদার আরও বলেন, সব রিপোর্ট পর্যালোচনা করে ইনসাফ হাসপাতালের ডা. ফখরুল তার হাসপাতালে মাকে রাখতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এরপর মাকে আবার বিএসএমএমইউতে নিয়ে গেলে চিকিৎসক অধ্যাপক হাবিবুর রহমান দুলাল অন্য চিকিৎসকদের ভর্ৎসনা করেন।
দুলাল বলেন, এখানে আইসিইউ খালি নেই সেটা আমাকে না জানিয়ে কেন রোগীকে প্রাইভেট হাসপাতালে পাঠানো হলো। রফিক বলেন, এ সময় তার কাছে দুটি কিডনি কাটার বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক দুলাল জানান, কারও কথায় কান দেবেন না। তার পেটে কিডনি আছে।
কিন্তু ফাংশনাল না হওয়ায় পরীক্ষায় ধরা পড়ছে না। রফিক আরও বলেন, বিষয়টি নিয়ে এরপর অন্য চিকিৎসকদের সঙ্গে আলাপ করেছি। তারা বলেন, দৃশ্যমান জিনিস পেটের মধ্যে থাকলে তা অবশ্যই ধরা পড়বে।
বিষয়টি নিশ্চিত হতে বিআরবি হাসপাতালে অধ্যাপক ডা. এম এ সামাদের কাছে গেলে আল্ট্রাসনোগ্রাম করে তিনিও জানান, মায়ের পেটে কোনো কিডনি নেই।
এই অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএসএমএমইউ ইউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. হাবিবুর রহমান দুলাল টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, রোগীর কাগজপত্র পরীক্ষা করে দেখা যায় তার বাম কিডনিতে পুরনো সমস্যা রয়েছে।
২০১৬ সালে তার বাম কিডনিতে অস্ত্রোপচার হয়েছিল। সেই কিডনিতেই ইনফেকশন হয়েছে। মেডিকেল বোর্ড কিডনি অপসারণের সিদ্ধান্ত নেয়। অপারেশনের পর ইউনিটের চিকিৎসকরা জানান, রোগী ভালো আছেন। তবে পরে জানা যায় তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।
তাকে আমাদের আইসিইউতে নিতে বলেছিলাম। কিন্তু প্রাইভেট হাসপাতালে তাকে নেয়া হয়। দুটি কিডনি কাটা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দুটি কিডনি ফেলে দেয়া হলে মানুষের স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। এ ছাড়া দুটি কিডনি মানুষের শরীরের দু’দিকে থাকে। তাই একদিকে অপারেশন করে দুটি কিডনি কেটে ফেলা সম্ভব নয়।
এই প্রসঙ্গে বিএসএমএমইউর ভিসি অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া যুগান্তরকে বলেন, সরাসরি কোনো অভিযোগ আসেনি। তবে বিষয়টি জানতে পেরে শনিবার সকালে ইউরোলজির প্রখ্যাত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. হারুন অর রশীদের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দিয়েছি।
তিনি আরও বলেন, যেহেতু মেডিকেল সায়েন্সের হিসেবে শরীরের একদিক থেকে কেটে দুটি কিডনি অপসারণ করা সম্ভব নয়।
তাই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিকিৎসকদের দিয়ে কমিটি করা হয়েছে। এ ছাড়া রোগীর উন্নত চিকিৎসায় ছয় সদস্যের একটি মেডিকেল বোর্ডও গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি প্রসঙ্গে রফিক শিকদার বলেন, এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। তবে দাবি সঠিক তথ্য উদঘাটনে যেন একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএসএমএমইউর একজন চিকিৎসক জানান, কিডনি থাকলে রোগীর প্রস্রাব হতো। কিডনি নেই বলে তার প্রস্রাব হচ্ছে না। জন্মগতভাবে রওশন আরার দুই কিডনি একসঙ্গে লাগানো ছিল।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় একে ‘হর্সশেপ শু কিডনি’ (ঘোড়ার খুরের মতো একসঙ্গে লাগানো) বলা হয়। যখন একসঙ্গে জোড়া লাগানো থাকে তখন একটি কিডনি অস্ত্রোপচার করে ফেলে দেয়ার সময় রক্তপাত হতে পারে। রক্তপাতও থামানো যায় না।
তখন তার ভালো কিডনিটিও ফেলে দিতে হয়। আন্তর্জাতিকভাবেও সেটাই নিয়ম। কিন্তু এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের উচিত ছিল রোগীর স্বজনদের এ বিষয়ে কাউন্সেলিং করানো।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন