ফরিদপুর সদর উপজেলার চরাঞ্চলের প্রত্যন্ত একটি গ্রামের কিশোর মারুফ। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় অনলাইন জুয়ার নেশায় পড়েন তিনি। এর পর বইপত্র রীতিমতো শিকেয় তোলেন। ঝরে পড়েন স্কুল থেকেও। এই কিশোরকে জুয়া থেকে ফেরাতে পরিবারের সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। ভেঙে যায় তাকে নিয়ে মা-বাবার দেখা স্বপ্নও। ছেলেটি এখন দিনমজুর।
মারুফের মতো তার গ্রামের অধিকাংশ কিশোর-যুবক অনলাইন জুয়ায় আসক্ত। এই আসক্তি মারুফের মতো তাদের পড়ালেখার বারোটা বাজাচ্ছে। এই চিত্র ফরিদপুরের ওই গ্রামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। সারাদেশেই এর ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে। অনলাইন জুয়ার থাবায় অনেকের জীবনের হিসাব-নিকাশ এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ছে তরুণ সমাজ। অন্যদিকে এই অনলাইন জুয়ার বিভিন্ন সাইটের মাধ্যমে দেশ থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে হাজারো কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনলাইন জুয়া এখন রাজধানীর অভিজাত এলাকা ও জেলা শহরের গণ্ডি ছাপিয়ে প্রত্যন্ত গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে। তরুণ থেকে মধ্য বয়সীরাও জুয়ায় আসক্ত হয়ে পড়েছেন। এতে বাড়ছে চুরি, ছিনতাই থেকে শুরু করে খুনোখুনির মতো অপরাধ। সর্বশেষ কুষ্টিয়ায় অনলাইন জুয়া কেন্দ্র করে ‘ট্রিপল মার্ডার’-এর ঘটনা ঘটে।
পুলিশ বলছে, সারাদেশের মতো জামালপুরের সরিষাবাড়ীর স্থল পশ্চিমপাড়া গ্রামের বেশিরভাগ যুবক অনলাইন জুয়ায় আসক্ত। গ্রামটির জুয়ার ‘নাটেরগুরু’ সবুজ গ্রেপ্তার হয় গত বছর। তবে তার আগেই জুয়ায় আসক্ত হয়ে নিঃস্ব হয় অনেক মানুষ। গ্রেপ্তার সবুজ একাই চালাতেন ১৮০টি জুয়ার সাইট।
ওয়ার্ল্ড গ্যাম্বলিং মার্কেট রিপোর্ট অনুযায়ী, অনলাইন জুয়ায় বাজারমূল্যের সূচক ঊর্ধ্বমুখী। ২০২২ সালে শুধু অনলাইন জুয়ার বাজারমূল্য ছিল ৬ হাজার ৩৫৩ কোটি মার্কিন ডলার। ২০২৩ সালে এর ব্যাপ্তি ১১ দশমিক ৭ শতাংশ বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পুলিশ
কর্মকর্তারা বলছেন, কোভিডের সময় ঘরবন্দি অনেক মানুষ সময় কাটাতে গিয়ে অনলাইন জুয়ার নেশায় জড়িয়ে পড়েন। ওয়ানএক্সবেট, বেটবাজডট৩৬৫, ক্রিকেক্স, বেট৩৬৫এনআই ও মসবেটসহ বিভিন্ন জুয়ার সাইটের টাকা পাচার হচ্ছে। চক্রগুলো হুন্ডি, ক্রিপ্টোকারেন্সিসহ বিভিন্ন মাধ্যমে টাকা পাচার করছে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক (মিডিয়া) কমান্ডার খন্দকার আল মঈন আমাদের সময়কে বলেন, ‘আমরা জুয়ার সাইটগুলো শনাক্ত করে সংশ্লিষ্টদের গ্রেপ্তার করি। গ্রেপ্তারের কয়েকদিন পর জামিনে ছাড়া পেয়ে তারা একই কাজ করে। একটি ওয়েবসাইট বন্ধ করলে ভিন্ন নামে আরও ১০টি সাইট খুলে যায়। এদেশ থেকে সাইট বন্ধ করলে ভিপিএনের মাধ্যমে জুয়াড়িরা সাইটে প্রবেশ করে।’
তিনি আরও বলেন, অনলাইন জুয়ার বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সচেতনতা বাড়াতে হবে। জুয়ার ভয়াবহতা তুলে ধরতে হবে। একাধিকবার গ্রেপ্তার আসামিদের ব্যাপারে আইনের মধ্যে থেকে আরও বেশি কঠোর হতে হবে।
সম্প্রতি সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টার জুয়ার সাইট বেটউইনারের তিন বাংলাদেশি এজেন্টকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃতরা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জানান, বেটউইনার সাইপ্রাসভিত্তিক মারিকিট হোলিডংস লিমিটেডের একটি অনলাইন জুয়া সাইট, যা রাশিয়া থেকে পরিচালিত। মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের এজেন্টরা জুয়ার জমাকৃত টাকা তুলে ওই টাকা বাইন্যান্স নামক মানি এক্সচেঞ্জ অ্যাপের মাধ্যমে মার্কিন ডলারে কনভার্ট করেন। পরে বাইন্যান্সের মাধ্যমে এই টাকা বিভিন্ন দেশে পাচার হয়।
গত বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর খিলক্ষেত থেকে জুয়ার দুই এজেন্টসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। এক বছরে তারা অন্তত ২০ কোটি টাকা পাচার করেছেন। তাদের তথ্যমতেÑ রাশিয়া, মালয়েশিয়া ও ভারত থেকে জুয়ার সাইট পরিচালনা করা হয়। গত অক্টোবরে র?্যাব জানিয়েছিলÑ ‘তিন পাত্তি গোল্ড’ জুয়ার মাধ্যমে প্রায় ২০০ কোটি টাকা ভারতে পাচার হয়েছে।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজাদ রহমান আমাদের সময়কে বলেন, অনলাইন বেটিং সাইটগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের আইনের আওতায় আনার কাজ করছে সিআইডি। ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে অর্থপাচারের প্রাথমিক প্রমাণও পাওয়া গেছে। তদন্তে অর্থপাচারের প্রমাণ পেলে তাদের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের মামলা হয়।
জুয়ার নেশায় হত্যা-আত্মহত্যা
জুয়ার কারণে চুরি-ডাকাতির পাশাপাশি নিঃস্ব হয়ে হতাশায় আত্মহননের ঘটনাও ঘটছে। গত ৭ আগস্ট ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে আত্মহত্যা করেন রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তানভীর আহমেদ তুষার। অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হয়ে জীবনের সব হিসাব এলোমেলো হয়ে যায় তার।
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে এনজিও থেকে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন সাইদুল ইসলাম। ঋণের টাকা জুয়া খেলে শেষ করেন। পরে নিঃস্ব হয়ে সম্প্রতি হতাশায় আত্মহনের পথ বেছে নেন। রাজধানীতেই জুয়ায় সর্বস্বান্ত বিটিসিএল কর্মকর্তা রকিব উদ্দিন আহমেদ লিটন তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েকে হত্যা করেন। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ধানমন্ডি লেক থেকে এক যুবকের লাশ উদ্ধারের তদন্তেও মিলেছে অনলাইন জুয়ায় আসক্তির তথ্য।
২০২২ সালের ৭ নভেম্বর নিজের বাসায় ভাতিজা নওরোজ কবির নিশাতের হাতে খুন হন কুষ্টিয়া জেলা স্কুলের শিক্ষক রুখসানা খানম। নিঃসন্তান রুখসানা পরম মততায় নিজের ভাতিজাকে বড় করেছিলেন। আর জুয়ার নেশায় সেই ভাতিজাই হয়ে ওঠেন ঘাতক।
গত ১ এপ্রিল রংপুরের লাকীপাড়ার কামরুল খুন হন বন্ধুদের হাতে। ঘটনায় ফাইয়াজ, শাকিল হাসান ও রাসেদ নামে তিন যুবককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পুলিশ জানায়, অনলাইন জুয়া খেলে নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিল আসামিরা। পরে বন্ধু কামরুলকে খুন করে তার অটোরিকশা বিক্রি করে জুয়ার টাকা জোগার করে।
যেভাবে কাজ করে জুয়ার এজেন্ট
জুয়ার দেশীয় মাস্টার এজেন্টরা তাদের সাবএজেন্ট নিযুক্ত করে। সাবএজেন্টরা মানুষকে শেখায় কীভাবে অনলাইনে জুয়ার অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়। কীভাবে খেলে লাভ করা যায়। তার পর গ্রাহকরাই প্রচার চালায়। এভাবে একে একে গ্রাহক বাড়তে থাকে।
এক এজেন্ট জানান, কেউ জুয়া খেলতে চাইলে প্রথমে যোগাযোগ করেন একজন সাবএজেন্টের সঙ্গে। জুয়াড়ি বিশ^স্ত হলে তার অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়া হয়। টাকার বিনিময়ে জুয়াড়ির অ্যাকাউন্টে ডিজিটাল মুদ্রা জমা করেন সাবএজেন্ট। সাবএজেন্ট এই মুদ্রা পান মূলত মাস্টার এজেন্টের কাছে। মাস্টার এজেন্ট এই টাকা পাঠিয়ে দেন দেশের বাইরে থাকা সুপার এজেন্টের কাছে।
জুয়ায় টাকা ঢুকালে সাবএজেন্টরা ৫ শতাংশ কমিশন পান। আবার টাকা কেউ উঠালে ৭ শতাংশ কমিশন দিতে হয়। একজন সাবএজেন্টের আন্ডারে যদি প্রতিদিন ২০ লাখ টাকাও জুয়ায় লেনদেন হয়, তা হলে কমিশন হিসেবে তিনি ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা পান। সাব-এজেন্টের কয়েকগুণ বেশি কমিশন পান মাস্টার এজেন্ট। সাব এজেন্ট সাধারণ জুয়াড়িদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। টাকা গ্রহণ ও উত্তোলন মূলত সাব-এজেন্টদের মাধ্যমেই হয়।
নেশা বাড়িয়েছে আইপিএল
অভিযোগ আছেÑ আইপিএলের ম্যাচ ঘিরে প্রতিদিন কোটি টাকার জুয়া চলে। বিশ্বকাপ ক্রিকেট, ফুটবল, জাতীয় লিগ, ইউরোপ নেশন্স কাপ-উয়েফা, স্প্যানিশ লিগ, কোপা আমেরিকা, বিপিএল টুর্নামেন্টেও জুয়া খেলায় মত্ত থাকেন বাজিকররা।
ওয়ান এক্স বেট, বেট থ্রি-সিক্সটি-ফাইভ, মোস্ট বেট বিডি, ৯ উইকেটসসহ প্রায় ১০০ সাইটে আইপিএলের জুয়া চলছে। লেনদেন হচ্ছে বিকাশ, নগদ, রকেট বা ভিসা, মাস্টারকার্ডে। জুয়ার অর্থ ক্রেডিট কার্ড, ই-ব্যাংকিংয় ও হুন্ডির মাধ্যমে পাচার হচ্ছে।
গত ১১ এপ্রিল আইপিএল নিয়ে অনলাইনে জুয়া খেলার অভিযোগে রাজশাহী থেকে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ)।
জুয়া বন্ধে সরকারি পদক্ষেপ অপ্রতুল
গত কয়েক বছরে সাড়ে তিন হাজারের বেশি জুয়ার সাইট বন্ধ করেছে সরকার; কিন্তু বিদেশ থেকে পরিচালিত জুয়ার সাইট এ দেশে বন্ধ করলেও জুয়াড়িরা ভিপিএন বা অন্য উপায়ে ঠিকই সাইট ব্যবহার করেন। অনলাইন জুয়া পরিচালনাকারী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্র ফেসবুক, ইউটিউবসহ বিভিন্ন মাধ্যমে জুয়ার বিজ্ঞাপন দেয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জনপ্রিয় ব্যক্তিদের ব্যবহার করছে প্রচারে। নাটকের ফাঁকে জুয়ার সাইট ‘ক্রিকএক্স’-এর প্রচার চালানোয় গত ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রত্যয় হিরণসহ তিন ইউটিউবারকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তবে জুয়ার ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধির সঙ্গে এর সরকারি প্রতিরোধব্যবস্থা খুবই অপ্রতুল বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
দুর্বল আইনের সুযোগ নিচ্ছে জুয়াড়িরা : পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট অনুযায়ী যে কোনো ঘর, স্থান বা তাঁবু জুয়ার আসর হিসেবে ব্যবহৃত হলে তার মালিক বা রক্ষণাবেক্ষণকারী, জুয়ার ব্যবস্থাপক বা এতে কোনো সাহায্যকারী তিন মাসের কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব ২০০ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সচেতনতার পাশাপাশি আইনের কঠোর প্রয়োগ করা না গেলে জুয়া বন্ধ করা যাবে না।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন