ঘরোয়া ক্রিকেটে পারিশ্রমিক বাড়ানোসহ ১১ দফা দাবিতে ধর্মঘটের ঘোষণা দেন সাকিব আল হাসান। সোমবার মিরপুর বিসিবি একাডেমি মাঠে এসময় তার সঙ্গে ছিলেন অন্য ক্রিকেটাররা।
কিছু দাবি পূরণ হয়েছে কিছুটা। কিছু পূরণের প্রক্রিয়া চলছে। দু-একটি দাবিকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিসিবি মনে করছে অবাস্তব। পরে করোনাভাইরাস মহামারীতে প্রবলভাবে ব্যাহত হয়েছে প্রক্রিয়া। সব মিলিয়ে ক্রিকেটারদের ধর্মঘটের এক বছর পর তাদের ১৩ দফা দাবি নিয়ে আছে আশা-হতাশার নানা গল্প।
বাংলাদেশের ক্রিকেটকে থমকে দেওয়া সেই ধর্মঘটের এক বছর পূর্ণ হচ্ছে আগামী বুধবার। গত বছরের ২১ অক্টোবর দুপুরে, মিরপুরে একাডেমি মাঠে ১১ দফা দাবি উত্থাপন করে ধর্মঘট ঘোষণা করেন ক্রিকেটাররা। ৬০ জনের মতো ক্রিকেটার উপস্থিত ছিলেন সেখানে। সবার প্রতিনিধি হিসেবে সেই সময়ের টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক সাকিব আল হাসান জানান, দাবি না মানা পর্যন্ত সব ধরনের ক্রিকেট কার্যক্রম বন্ধ রাখবেন তারা।
শুরুর ১১ দফা দাবির পর যোগ করা হয় আরও দুটি। সংবাদ সম্মেলন করে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রয়া জানিয়ে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান বলেন, “এই ধর্মঘট দেশের ক্রিকেটকে অস্থিতিশীল করার চক্রান্ত।” তিন দিনের টানাপোড়েনের পর বোর্ড কর্তাদের সঙ্গে ক্রিকেটারদের বৈঠকে অবসান হয় অচলাবস্থার। বিসিবির আশ্বাসে ধর্মঘট প্রত্যাহার করেন খেলোয়াড়রা।
ক্রিকেটারদের শুরুর ১১ দাবির ৯টিই তখন মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন বিসিবি প্রধান। সম্ভাব্য সময়সীমার কথাও উল্লেখ করেছিলেন তিনি, “এটা যে ৬ মাস বা ১ বছর পরে করব, তা নয়। আশা করছি, ২-৩ দিনের মধ্যে আর্থিক ব্যাপারগুলো আমরা করে দেব ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করে।”
এক বছর পর দেখে নেওয়া যাক বাস্তবায়নের কোন পর্যায়ে আছে সেই ১৩ দফা।
দাবি ১
“ক্রিকেটারদের প্রাপ্য সম্মান দিতে হবে ও অকার্যকর সংগঠন কোয়াবের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে অবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে। নির্বাচনের মাধ্যমে ক্রিকেটারদেরই সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক বেছে নেওয়ার অধিকার দিতে হবে।”
ক্রিকেটারদের প্রাপ্য সম্মানের বিষয়ে যে কথা তখন বলা হয়েছিল বিসিবির পক্ষ থেকে, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপচারিতায় এখনও সেই উচ্চারণই শোনা গেল বিসিবির প্রধান নির্বাহী নিজাম উদ্দিন চৌধুরির কণ্ঠে।
“ক্রিকেটারদের আমরা সবসময়ই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য ও সম্মান দেই। তাদেরকে ঘিরেই আমাদের সবকিছু। এমনকি আমাদের মাননীয় বোর্ড প্রেসিডেন্ট ছোটখাটো থেকে যে কোনো ব্যাপারে ক্রিকেটারদের খোঁজখবর রাখেন। তাদেরকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন।”
ক্রিকেটার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বা কোয়াবের নির্বাচন হয়নি এই এক বছরেও। সভাপতি পদে যথারীতি আছেন বোর্ড পরিচালক ও সাবেক অধিনায়ক নাঈমুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক পদে সাবেক পেসার দেবব্রত পাল।
এখনও দায়িত্বে থেকে যাওয়ার পেছনে নিজেদের দায় খুব একটা আছে বলে মনে করেন না কোয়াবের সাধারণ সম্পাদক দেবব্রত পাল।
“ধর্মঘট শেষ হওয়ার পরই আমরা ওদের সঙ্গে বসেছিলাম। সরাসরিই বলেছি, আমরা তো দায়িত্বে থাকতে চাই না। তোমরা দায়িত্ব নাও। এগিয়ে আসো। ওরা তিন দিন সময় নিয়েছিল। সেই তিন দিন এখনও শেষ হয়নি। আর কিছুই জানায়নি। প্রথম দাবিই ওরা এটা জানাল, তারপর আর খবর নেই। আমরা নির্বাচনের উদ্যোগ নিতে চেয়েছি, কিন্তু ওরা সবাই এগিয়ে না এলে তো সম্ভব নয়।”
“তারপরও আমরা নির্বাচন দিতাম, কিন্তু কোভিড মহামারী শুরু হয়ে গেল। এখন আমাদের পরিকল্পনা হলো, সামনে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ হলে, তখন মোটামুটি সব ক্রিকেটারকে পাওয়া যাবে। লিগের আগে বা লিগ চলার সময় আমরা নির্বাচন দিয়ে দেব।”
দাবি ২
“ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ হতে হবে আগের মতো করে। সেখানে পারিশ্রমিকের কোনো মানদণ্ড থাকবে না। কোন ক্লাবে, কত টাকায় খেলবেন, সেই স্বাধীনতা দিতে হবে ক্রিকেটারদের।”
এই দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে ধর্মঘট শেষের পরপরই। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে উন্মুক্ত দলবদলের পরিবর্তে ‘প্লেয়ার্স বাই চয়েজ’ নামে একটি পদ্ধতি তৈরি করেছিল বিসিবি, যেখানে ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক নির্ধারণ করে দিয়ে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে রাখা হতো। তাদের বেছে নিত ক্লাবগুলি। শুধু এক মৌসুমেই এই পদ্ধতি থাকবে বলে বিসিবি সভাপতি কথা দিলেও পরে তা একরকম নিয়মিত হয়ে যায়। ক্রিকেটারদের ধর্মঘটের পর শেষ হয় ‘প্লেয়ার্স বাই চয়েজ’ অধ্যায়।
তবে এটি নিয়ে এখন ক্রিকেটারদের অনেকের মধ্যেই অনেক দ্বিধা আছে। বিশেষ করে, মধ্যম সারির অনেক ক্রিকেটার ক্লাব কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে পর্যাপ্ত ও প্রাপ্য পারিশ্রমিক না পেয়ে আক্ষেপ করছেন যে ‘প্লেয়ার্স বাই চয়েজ’ হয়তো মন্দের ভালো ছিল। সঙ্গত কারণেই নাম প্রকাশে ইচ্ছুক নন তারা।
অনেকে যেটা প্রকাশ্যে বলতে পারছেন না, তাদের কথা মুখ ফুটে বলতে আপত্তি করলেন না কোয়াবের সাধারণ সম্পাদক দেবব্রত পাল।
“দেখুন, ওদের দাবিতে এটা ছিল, আমরা সমর্থন করেছি। সবাই চাইলে তো পাশে থাকতেই হবে। কিন্তু এখন অনেকেই হাহুতাশ করছে। এই যে এবার মহামারীতে খেলা হলো না, কজন টাকা পেয়েছে?”
“প্লেয়ার্স বাই চয়েজ বাদ হওয়ায় লাভবান হয়েছে বড়জোর ৩-৪ জন ক্রিকেটার। তাদের পারিশ্রমিক হয়তো ৩০-৩৫ লাখ থেকে ৬০ লাখ হয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্রিকেটারের জন্য খারাপ হয়েছে। আমাদের ক্লাব ক্রিকেটের বাস্তবতা তো অন্যরকম, কারণ নিয়ে বিতর্ক যতোই থাকুক। ছেলেরা অনেকেই এখন ঠিকমতো টাকা পায় না, বোর্ডের কাছে যেতেও অস্বস্তি থাকে।”
দাবি ৩
“এবার বিশেষ বিপিএল হলেও আগামী বছর থেকে বিপিএলকে ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক নিয়মে ফেরাতে হবে। বিদেশি ক্রিকেটারদের সঙ্গে স্থানীয় ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিকের সামঞ্জস্য রাখতে হবে। ড্রাফটে ক্রিকেটাররা কে কোন গ্রেডে থাকবেন, সেটা বেছে নেবার অধিকার দিতে হবে।”
মুজিববর্ষ উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু বিপিএল আয়োজনের পর কোভিড মহামারীর কারণে এবছর বিপিএল হচ্ছে না। পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে আগামী মার্চে নিউ জিল্যান্ড সফরের পর এই টুর্নামেন্ট আয়োজনের একটা ভাবনা বিসিবির আছে, তবে আপাতদৃষ্টিতে সম্ভাবনা কমই। পরের বিপিএল নিয়ে তাই এমনিতেই অনিশ্চয়তা আছে।
পারিশ্রমিকের দাবি নিয়ে খুব বেশি ভাবনার কিছু আছে বলে মনে করেন না বিসিবির প্রধান নির্বাহী নিজাম উদ্দিন চৌধুরি।
“বিপিএল তো আল্টিমেটলি ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিকই হবে, এটা আসলে দাবি জানানোর মতোও নয়। আর পারিশ্রমিকের ব্যাপারে আমরা সবসময় বলে এসেছি বাংলাদেশের বাস্তবতার কথা। আমাদের সামাজিক ও আর্থিক প্রেক্ষাপট মাথায় রেখেই আমরা পারিশ্রমিক নির্ধারণ করার চেষ্টা করি। বাড়ানোর সুযোগ সবসময়ই থাকে, আমরা অবশ্যই দেখব।”
দাবি ৪
“প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ম্যাচ ফি অন্তত এক লাখ টাকা করতে হবে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটারদের বেতন কমপক্ষে ৫০ শতাংশ বাড়াতে হবে।”
ধর্মঘট শেষ হওয়ার পাঁচ দিন পরই ম্যাচ ফি বাড়ানোর ঘোষণা দেয় বিসিবি। জাতীয় লিগের প্রথম স্তরে ম্যাচ ফি ৩৫ হাজার থেকে বাড়িয়ে করা হয় ৬০ হাজার টাকা। দ্বিতীয় স্তরে ২৫ হাজার থেক বেড়ে হয় ৫০ হাজার।
টাকার অঙ্ক যদিও ক্রিকেটারদের চাওয়ার কাছাকাছি নয়, তবে বাড়ানোর পর তখন আপাতত সন্তুষ্টির কথাই বলেছিলেন ক্রিকেটাররা।
প্রথম শ্রেণির চুক্তিবদ্ধ ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক বাড়ানোর দাবি পূরণ হয়নি এখনও। বিসিবির প্রধান নির্বাহী নিজাম উদ্দিন চৌধুরি জানালেন, উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
“এখানে একটু দেরি হয়েছে সত্যি। তবে প্রক্রিয়া চলছে। সামনেই হয়তো ঘোষণা দিতে পারব আমরা। ওরা ৫০ শতাংশ বাড়ানোর কথা বলেছিল, আমরা চেষ্টা করব সব বাস্তবতা মেনে যতটুকু বাড়ানো যায়।”
দাবি ৫
“ক্রিকেটারদের অনুশীলনের সুবিধা বাড়াতে হবে। বিভাগীয় পর্যায়ে ১২ মাস কোচ, ফিজিও, ট্রেনারের সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি ভ্রমণ ভাতা, দৈনিক ভাতা উপযুক্ত পর্যায়ে আনতে হবে। ঘরোয়া ক্রিকেটে ভালো বলে খেলা হতে হবে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের টুর্নামেন্টের সময় জিম, সুইমিংপুলসহ হোটেলে রাখা ও ভালো বাসে যাতায়াত নিশ্চিত করতে হবে।”
দৈনিক ভাতা ও ভ্রমণ ভাতা বাড়ানো হয় ম্যাচ ফি বাড়ানোর সঙ্গেই। দৈনিক এক হাজার ৫০০ থেকে বাড়িয়ে করা হয় দুই হাজার ৫০০। ভ্রমণ ভাতা ছিল দুই হাজার ৫০০, যে টাকায় বিমানে যাতায়াত ছিল কঠিন। সেটি বাদ দিয়ে বিমানে যাতায়াত নিশ্চিত করা হয়। যেসব ভেন্যুতে বিমানে যাওয়ার সুযোগ নেই, সেখানে ভ্রমণ ভাতা করা হয় তিন হাজার ৫০০ টাকা।
এছাড়াও আবাসন ভাতা আগের চেয়ে বাড়ানো হয় ৮০ শতাংশ। ফিটনেস সহায়ক খাবার দেওয়ার জন্য ক্যাটারিং ফি বাড়ানো হয় ৮৫ শতাংশ।
জাতীয় লিগের ম্যাচে অনেক সময়ই খুবই নিম্নমানের বাসে হোটেল থেকে মাঠে যাতায়াত করতে হতো ক্রিকেটারদের। সেখানে এসি বাস নিশ্চিত করা হয়।
অনুশীলন ও কোচিংয়ের সুযোগ-সুবিধা খুব একটা বাড়েনি, মেনে নিলেন প্রধান নির্বাহী নিজাম উদ্দিন চৌধুরি।
“অনেক কিছুই রাতারাতি করা সম্ভব নয়। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। ভেন্যুগুলোতে উন্নয়ন কাজ চলছে। জিমসহ যা কিছু আমাদের সক্ষমতার মধ্যে সম্ভব, আমরা করছি। মহামারীর কারণে বড় একটা বিরতি পড়েছে। ক্রিকেটারদের সম্ভব সেরা ফ্যাসিলিটিজ নিশ্চিত করার চেষ্টা করে যাব আমরা।”
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন