২০০০ সালের কথা। ওই বছর ভারতের বিপক্ষে খেলেই প্রথমবার টেস্ট অভিষেক হয়েছিল বাংলাদেশের। মাঝে গুটি গুটি পায়ে চলে গেছে ১৯ বছর। কিন্তু ভারতের সঙ্গে কখনোই খেলা হয়নি টেস্ট সিরিজ। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ক্রিকেটের চড়াই-উৎরাই আর উত্থান-পতন গড়িয়েছে ভলগা থেকে গঙ্গা পর্যন্ত। ১৯ বছর পর এলো সেই সুযোগ। নিজেকে যোগ্য প্রমাণের মঞ্চ প্রস্তুত হলো। কিন্তু ২২ গজের শেষ দৃশ্যে আত্মসমর্পণ, লজ্জা আর হতাশা ছাড়া অর্জন বলে কিছুই পেলো না বাংলাদেশ।
ভারতের বিপক্ষে ২-০ ব্যবধানেই শুধু নয়, লজ্জাজনকভাবে টেস্ট সিরিজ হারের পর এ নিয়ে দুদেশের ক্রিকেট অঙ্গনেই তুমুল আলোচনা-সমালোচনা চলছে। ক্রিকেটভক্ত, দর্শক, সমর্থক থেকে শুরু করে বিশ্লেষকরাও মতামত দিচ্ছেন। ঢের পরামর্শ ধেয়ে আসছে বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে। ক্রিকেটের উন্নতি নিয়ে। কিন্তু আর কত? ১৯ বছর পরও কি বলতে হবে- ‘ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে ঘুরে দাঁড়াবে বাংলাদেশ?’ যদি তাই হয় তবে কথিত এই ‘ভুল থেকে শিক্ষা নেয়া’ শেষ হবে কবে?
প্রশ্ন আসতে পারে বাংলাদেশের টেস্ট দলের অভিজ্ঞতা নিয়ে। সাকিব-তামিম বিহীন এই দলটির শক্তি নিয়ে প্রশ্ন অমূলক নয়। কিন্তু তাই বলে লড়ার আগেই আত্মসমর্পণ! তাই বলে ১০৬ রানে গুটিয়ে যাওয়া! দুই টেস্টেই ইনিংস ব্যবধানে হারা! সাকিব-তামিমকে ছাড়া এমনটি হতেই পারে- এই যুক্তির পক্ষে যদি কারও মত থাকে তবে তো আরও একটি প্রশ্ন সামনে আসবে- তবে কি বাংলাদেশ এখনও একটি দল হয়ে উঠতে পারেনি? নইলে মাত্র দুজন খেলোয়াড়ের অনুপস্থিতিতে ঝড়ের কবলে পড়া কলাগাছের মতো মাথা নুইয়ে এমন লণ্ডভণ্ড হলো কেন বাংলাদেশ।
একটু চোখ ফিরিয়ে যদি দেখি- টেস্ট সিরিজ শুরুর আগে ভারতের বিপক্ষে তিনটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছে বাংলাদেশ। প্রথমটিতে হারতে হারতে শেষ মুহূর্তে জয় পেয়েছে। গোটা সফরে সান্ত্বনা কেবল এতটুকুই। তবে লক্ষ্যণীয় যে, ভারতের যে দলটি টি-টোয়েন্টি খেলেছে একমাত্র রোহিত শর্মা ছাড়া সেই দলের আর কাউকেই কিন্তু টেস্ট দলে দেখা যায়নি। অর্থাৎ নতুন ফরম্যাটে পুরোপুরি নতুন দল নিয়ে মাঠে নেমেছে ভারত। কিন্তু ভারত তো চাইলে শেখর ধাওয়ান, শ্রেয়াস আয়ারদের মতো ক্রিকেটারদেরও টেস্টে খেলাতে পারতো। বাংলাদেশের কি ঠিক এই জায়গাটি থেকে নিজেদের নতুন করে প্রস্তুত করার পথ খুঁজে নিতে পারে না?
কথা থাকে বোলারদের নিয়েও। একবার ভারতের বোলিং লাইনআপটির দিকে তাকান। মোহাম্মদ সামি, ইশান্ত শর্মা, উমেশ যাদব- এই তিন পেসারের সঙ্গে যোগ হয়েছে রবিচন্দ্র অশ্বিন ও রবীন্দ্র জাদেজার বৈচিত্র্যময় স্পিন আক্রমণ। বিপরীতে যদি বাংলাদেশের দিকে তাকানো যায় তবে চিত্রটা উল্টো লাগে। মুহূর্তেই বলে দেয়া যায়- বাংলাদেশ গত ১৯ বছরেও টেস্টের জন্য একটি আদর্শ বোলিং ইউনিট দাঁড় করাতে পারেনি। আবু জায়েদ রাহীর সঙ্গে কখনও এবাদত হোসেন, কখনও আল-আমিনকে খেলানো হচ্ছে। আবার মোস্তাফিজুর রহমানকে বসিয়ে রেখে ওই তিন পেসারকে নিয়ে মাঠে নামা হচ্ছে। সাকিবকে বাদ দিলে টেস্টে বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল স্পিন বোলার তাইজুল ইসলাম। গেল কয়েক বছর একাদশে নিয়মিত খেলছেন তরুণ অফস্পিন অলরাউন্ডার মেহেদি হাসান মিরাজ। কিন্তু বিদেশের মাটিতে ভারতের মতো শক্তিশালী দলগুলোর ব্যাটসম্যানদের সামনে তাইজুল-মিরাজরা কতটা পারফেক্ট, তা প্রশ্ন হিসেবে জমা রাখা যায়।
ফুটবলের মতো ক্রিকেটের ক্ষেত্রেও কথাটা চূড়ান্ত সত্য যে, বোলাররা যদি ম্যাচ জেতায় তবে ব্যাটসম্যানরা ম্যাচটা বাঁচায়। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাটিং কি এখনও সেই মানের হতে পেরেছে, যারা কিনা টেসে জিতে ব্যাট করতে নেমে অন্তত ৪ থেকে ৫ সেশন পার করার সক্ষমতা রাখে। কন্ডিশন, পিচ বাধা হতেই পারে। তাই বলে ১৩ রানে দলের চার টপঅর্ডার ব্যাটসম্যান আউট হয়ে যাবে এটা কেমন কথা। ইন্দোর আর কলকাতা টেস্টের দিকে চোখ ফেরালেই তাজা দৃশ্যগুলো থেকে বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের বাস্তব দশাটা দেখে নেয়া যায়।
বাংলাদেশ ক্রিকেটে গত কয়েক বছরে সবচেয়ে বেশি সুযোগ পাওয়াদের একজন সৌম্য সরকার। নিউজিল্যান্ডের মাটিতে তার ১৪৯ রানের ইনিংসটি যেমন দেশের টেস্ট ক্রিকেটে অনুপ্রেরণার উৎস, একইভাবে বারবার সুযোগ পেয়েও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে নিজেকের জায়গাটিকেই ক্রমে অনিশ্চিত করে ফেলেছেন বাঁহাতি এই অপেনার। সাব্বির রহমানকে নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলেছে। শেষ পর্যন্ত ভারত সফরে জায়গা হয়নি তার। অথচ একটা সময় এই সাব্বিরকেই তিন নম্বরে খেলিয়ে বাঘা ব্যাটসম্যান বানানোর মহাপরিকল্পনা ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি)। শেষ পর্যন্ত সেখানেও গুড়েবালি।
বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটে সবচেয়ে আলোচিত নামগুলোর একটি বোধহয় ইমরুল কায়েস। ভারতের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ খেলার আগে ৩ টেস্টে ৬ ইনিংসের ৪টিতেই তার রান দুই অঙ্কের ঘরে পৌঁছায়। ১৯ বছর ধরে টেস্ট খেলুড়ে একটি দলের অপেনার যদি প্রায় প্রতিদিনই এভাবে ফ্লপ হয়ে ফিরেন তবে ভিত্তি গড়বে কে? অপেনারা রানের ভিত গড়ে দেন। কিন্তু বাংলাদেশ কি গত দেড় যুগে পেরেছে টেস্ট ক্রিকেটের জন্য আদর্শ দুজন অপেনার তৈরি করতে। এক্ষেত্রে সফলতা যেটুকু তা ‘হারাধনের একটি পুত্র’ সেই তামিম ইকবালের একার। তামিম তো যোগ্য সঙ্গীর অভাব বরাবরই বোধ করেছেন।
ভারত টেস্টে সাদমান ইসলাম ও ইমরুল কায়েসকে দিয়ে অপেন করানো হলো। দুই টেস্টের ৪ ইনিংসে একটিও হাফসেঞ্চুরি পার্টনারশিপ তারা দলকে দিতে পারেনি। এমনকি দলকে বিপদে ঠেলে আউট হয়েছে ইনিংসের শুরুতেই, কখনওবা প্রথম ওভারেই। টেস্টে বড় রান করতে হলে শুরুটা যে ভালো করার বিকল্প নেই তা বোধহয় এখনও বোধগম্য হচ্ছে না কর্তাব্যক্তিদের। নইলে অভিজ্ঞতায় ঠাসা ভারতের মতো একটি দলের সামনে দাঁড়িয়ে কিভাবে রান বের করতে হয় কিভাবে সেশন ধরে ধরে ব্যাট করতে হয় তার নমুনা কিঞ্চিত হলেও দেখা যেতো বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে।
টেস্ট ক্রিকেটে ‘বাংলাদেশের ডন ব্র্যাডম্যান’ বলা হয় মুমিনুল হককে। একটা সময় তো তৎকালীন কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে মুমিনুলকে ‘টেস্ট স্পেশালিস্ট’ আখ্যা দিয়ে ওয়ানডে থেকে সরিয়েও নিয়েছিলেন। এবার সাকিবের অনুপস্থিতিতে নেতৃত্ব পড়লো মুমিনুলের ছোট্ট কাঁধে। আর সেই নেতৃত্বের ভারে শেষ পর্যন্ত তার ব্যাটিংটাই পড়লো নুইয়ে। কলকাতা টেস্টে তো দুই ইনিংসে শূন্য রানে আউট হয়ে অধিনায়ক হিসেবে রেকর্ডই করে ফেললেন মুমিনুল। টেস্ট খেলুড়ে বড় বড় দলগুলোর দিকে যদি তাকালেই স্পষ্ট হয়- সেই দলগুলোতে তিন কিংবা চার নম্বর পজিশনে কারা ব্যাট করে। বর্তমান ক্রিকেট দুনিয়ায় চার নম্বর পজিশনটা বিরাট কোহলি, কেন উইলিয়ামসন, স্টিভেন স্মিথ, জো রুট, হাফ ডু প্লেসিস কিংবা বাবর আজমদের দখলে। সেখানে ভারত টেস্টে চার নম্বর ব্যাটসম্যান হিসেবে দেখা গেল মোহাম্মদ মিঠুনকে। উপরের নামগুলোর সঙ্গে মিঠুনের ক্যাপাবিলিটি কতটা তা মিলিয়ে নিলে ভবিষ্যতে সমস্যা সমাধান হলেও সহজ হতে পারে। অথচ সাকিব-তামিমের অবর্তমানে মুশফিক-মাহমুদউল্লাহরা ৫-৬ নম্বর থেকে ৩-৪ কিংবা ৪-৫ নম্বরে কেন নয়- এ নিয়ে ইন্দোর ও কলকাতা টেস্টে বহু কথা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত তথৈবচ!
ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ক্রিকেটের এগিয়ে যাওয়া ও উন্নতি করা নিয়ে খোদ সুনীল গাভাস্কার, রবি শাস্ত্রী এমনকি বিরাট কোহলিও কথা বলেছেন, নিজ নিজ পরামর্শ দিয়েছেন। কথা হচ্ছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অঙ্গনেও। এখন হয়তো বিসিবি টেস্টের জন্য আলাদা দল তৈরিতে উঠেপড়ে লেগে যেতে পারে। কিন্তু সেটাও দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ব্যাপার। তবে তার আগে নিশ্চিত করা উচিত ক্রিকেটারদের নিবেদন, তাদের প্রতিজ্ঞা, প্রত্যয় ও প্রতিশ্রুতি। মাঠে যদি কোনও ক্রিকেটার চ্যালেঞ্জ নেয়ার আগেই মুখ থুবড়ে পড়ে তবে তাকে খুব বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করাই ভালো। নতুনদের সুযোগ বাড়ানো উচিত। আর যতটা সম্ভব সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত ঘরোয়া ক্রিকেটের ওপর। উচিত হবে ঘরোয়া ক্রিকেটের মান নিয়ে কাজ করাও। এগুলো যদি এখন থেকেই যথার্থ পরিকল্পনায় করা যায় তবেই হয়তো অদূর ভবিষ্যতে দেশের ক্রিকেট তথা টেস্ট ক্রিকেট অন্তত মেরুদণ্ড সোজা করার শক্তি খুঁজে পাবে। এই প্রত্যাশা ক্রিকেটপাগল গোটা টাইগার-সমর্থকদের।
ব্রেকিংনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন