বাড়ছে প্রযুক্তির সমারোহ। সেই সঙ্গে বাড়ছে চ্যালেঞ্জ। এর মধ্যেই সাইবার নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি সাইবার নিরাপত্তা গবেষণা প্রতিষ্ঠান কমপারিটেকের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাইবার নিরাপত্তার দিক থেকে সবচাইতে ঝুঁকিতে থাকা ১০টি দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্বের ৬০টি দেশের ওপর জরিপ চালিয়ে ওই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সাইবার নিরাপত্তার দিক থেকে সবচেয়ে অনিরাপদ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ।
সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন স্মার্টফোন ব্যবহারকারীরা। তাদের মতে-স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের মধ্যে প্রায় ৩৬ শতাংশের স্মার্টফোনই ম্যালওয়্যারে আক্রান্ত। এ ছাড়া কম্পিউটার ব্যবহারকারীদের ক্ষেত্রে ম্যালওয়্যার আক্রান্তের হার ১৯ দশমিক ১ শতাংশ। রিপোর্ট অনুযায়ী সাইবার নিরাপত্তায় সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ আলজেরিয়া। তালিকায় এর পর যথাক্রমে ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, তানজানিয়া এবং উজবেকিস্তানের স্থান।
নিরাপত্তার দিক থেকে বাংলাদেশের পরই রয়েছে পাকিস্তান। ঝুঁকির বিচারে তালিকায় চীন ১৩ নম্বরে এবং ভারত ১৫ নম্বরে রয়েছে।
সাইবার নিরাপত্তা প্রসঙ্গে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, ডিজিটাল যুগে প্রতিদিন নতুন নতুন ডিজিটাল প্রযুক্তি আসতে থাকবে। প্রতিদিন নিরাপত্তার হুমকি তৈরি হতে থাকবে। এর মধ্যেই নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ আসবে। নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। আমাদের যতটুকু সম্ভব, ততটুকু আমরা করছি। নিরাপদ ইন্টারনেটের লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। সাইবার নিরাপত্তার বিষয়টি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একেবারেই নতুন এবং জনগণের মধ্যে এ বিষয়ে সচেতনতার ঘাটতি রয়েছে। ব্যক্তি সচেতন না থাকলে সাইবার জগৎকে নিরাপদ রাখা খুব কঠিন। প্রায় একই মন্তব্য করেন দেশের তথ্য প্রযুক্তিবিদ হিসেবে খ্যাত সুমন আহমেদ সাবির।
মানবজমিনকে তিনি বলেন, সাইবার নিরাপত্তার দিক দিয়ে আমরা যথেষ্ট ঝুঁকির মধ্যে আছি এটা বলা যায়। সাইবার সিকিউরিটি নিয়ে গত ১০ বছরে অনেক কথা হয়েছে, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম হয়েছে। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান এ বিষয়ে বেশ প্রস্তুতিও নিয়েছে। কাজের পরিধি বড় করেছে। কিন্তু নিরাপত্তা মোকাবিলায় ঘাটতি রয়েছে প্রচণ্ডভাবে। তিনি বলেন, এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। হঠাৎ করে সাইবার সিকিউরিটি তৈরি করে ফেললাম বিষয়টা তা নয়। এসবের জন্য সফটওয়্যার, হার্ডওয়্যারগুলোতে বিনিয়োগের দরকার হয়। এসব মেইনটেইন করতে যোগ্য লোকের দরকার হয়। আবার কিছু আউটসোর্স থাকতে হয়। এজন্য আবার কিছু প্রতিষ্ঠান থাকতে হয়। আমাদের দেশে এই টোটাল ইকো সিস্টেমটা এখনো ভালোভাবে গড়ে ওঠেনি। এ কারণে আমাদের সাইবার ঝুঁকিটা অন্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি।
সাইবার নিরাপত্তার বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) উদ্যোগে এবং সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় সম্প্রতি দিনব্যাপী যুব কর্মশালা ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে কমিশনের ভাইস-চেয়ারম্যান সুব্রত রায় মৈত্র বলেন, সাইবার নিরাপত্তার বিষয়টি বহুল আলোচিত এবং বিশ্বের প্রতিটি দেশই সাইবার অপরাধ সংক্রান্ত নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। তরুণ সমাজ যাতে সাইবার নিরাপত্তার বিষয়ে সচেতন হয়, সে বিষয়ে অধিক প্রচার প্রচারণা ও কর্মশালা আয়োজনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
বিটিআরসি জানিয়েছে, ২০২১ সালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যৌন হয়রানির হার ছিল ৭.৬৯ ভাগ, আপত্তিকর ছবি ৫.৮৫ ভাগ, সাইবার বুলিং ৫০.১৬ ভাগ এবং ২০২২ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যৌন হয়রানির হার ছিল ৯.৩৪ ভাগ, আপত্তিকর মেসেজ ৬.৯০ ভাগ এবং সাইবার বুলিংয়ের হার ৫০.২৭ ভাগ। ২০২১ সালে ওয়েবসাইট/ডোমেইন থেকে লিংক অপসারণের অনুরোধ করা হয়েছে ১২৩৫টি’র মধ্যে অপসারণ করা হয়েছে ১২৩৫টি, অপসারণের হার ১০০ ভাগ।
২০২২ সালে ওয়েবসাইট/ডোমেইন থেকে লিংক অপসারণের অনুরোধ করা হয়েছে ৬৪৫টির মধ্যে অপসারণ করা হয়েছে ৬৪৫টি, অপসারণের হার ১০০ ভাগ। বিটিআরসি জানিয়েছে, ২০২১ সালে ফেসবুক থেকে ৮ হাজার ৯১৬টি এবং ২০২২ সালে ৮ হাজার ২২৮টি লিংক অপসারিত হয়েছে। ২০২১ সালে ইউটিউব থেকে ১ হাজার ১৩টি এবং ২০২২ সালে অপসারিত হয়েছে ২২২টি লিংক। ২০২২ সালে টিকটক থেকে অপসারিত হয়েছে ১ হাজার ১৫৯টি লিংক, ২০২২ সালে বিগো, লাহিক ও ইমো থেকে অপসারিত হয়েছে ৬৭টি এবং টুইটার থেকে অপসারিত হয়েছে ২৯টি লিংক। ডিজিটাল সিকিউরিটি এজেন্সির পরিচালক (অপারেশন) তারেক এম বরকতউল্লাহ বলেন, আগামীতে সক্ষম ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে নিজস্ব প্রযুক্তি ও প্রযুক্তি সংক্রান্ত গবেষণা ও উন্নয়নের জোর দেয়া হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, বিদেশি প্রযুক্তির অনুকরণ কমিয়ে নিজস্ব সক্ষমতা বাড়ানো সাইবার সিকিউরিটির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে পাইরেটেড সফটওয়্যার বেশি ব্যবহার হওয়ায় সাইবার আক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সাইবার সুরক্ষায় সাইবার ইনসিডেন্ট রেসপন্স টিমের (সিআইআরটি) পরিধি প্রতিটি সেক্টরে বাড়ানোর কাজ চলছে। বিটিআরসি’র চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদার বলেন, বাংলাদেশের বিশাল সংখ্যক মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহারকারী প্রযুক্তি বিষয়ে তেমন দক্ষ না হওয়ায় সাইবার ক্রাইমের শিকার হচ্ছে।
জেলা-উপজেলা-ইউনিয়ন পর্যায়ে টেলিযোগাযোগ সেবা ও সাইবার নিরাপত্তার বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, সাইবার সংক্রান্ত বিষয়ে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সপ্তাহে সচেতনতা ক্যাম্পেইন করলে তা ফলপ্রসূ হবে এবং এ জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে এগিয়ে আসতে হবে। সাইবার সিকিউরিটি, সাইবার অ্যাওয়ারনেস ও সাইবার সেফটি-এই তিনটি বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
এদিকে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক এসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ মানবজমিনকে বলেন, ডিজিটাল যুগে মানুষের দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ব্রাউজার যেমন ক্রম, ফায়ারফক্স, মজিলা, মিনি অপেরা, বেটা, ভিপিএন সহ বিভিন্ন ব্রাউজার ব্যবহার করে আসছে। আর সেই সকল প্রয়োজনে সার্চ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে মিলে যাচ্ছে লাখ লাখ কোটি কোটি পর্নো ভিডিও লিংক।
এ সকল ব্রাউজার নিয়ন্ত্রণে এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে আমরা লক্ষ্য করিনি। তাছাড়া পাড়া মহল্লার অলিগলিতে কম্পিউটার অপারেটর, পোস্ট এডিটিং এর নামে গড়ে ওঠা কম্পিউটার দোকানগুলোতে দশ বিশ টাকার বিনিময়ে মেমোরি কার্ড এর লোড অথবা শেয়ারিং এর মাধ্যমে পর্নো ভিডিও ব্যবসা চলছে। এসব নজরদারি করার জন্য নিয়ন্ত্রণ কমিশনের, মন্ত্রণালয় এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রম গ্রহণ করতে খুব একটা উদ্যোগ আমরা লক্ষ্য করিনি। প্রকৃতপক্ষে পর্নো নিয়ন্ত্রণ করতে হলে গুগলসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্রাউজারগুলাকে নিয়ন্ত্রণ ও জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে হবে। পাশাপাশি পাড়া মহল্লায় অভিযান পরিচালনা করতে হবে। সেইসঙ্গে জনসচেতনতা গড়তে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে সকল পক্ষের। এদিকে দেশের দেশের প্রযুক্তিবিদরা বলছেন-মোবাইলে যখন অ্যাপ ডাউনলোড করা হয়, অনেক ব্যবহারকারীই এর টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন ঠিকমতো পড়ে দেখেন না। ফলে গ্রাহক নিজের অজান্তেই ফোনের মেসেজ, কল রেকর্ড, ব্যক্তিগত ছবি বা ভিডিও অনেক কিছুর অ্যাকসেস দিয়ে দেন ওই অ্যাপের মালিককে। সেখান থেকেও ঝুঁকিতে পড়েন স্মার্টফোন ব্যবহারকারী।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন