ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী যুঁথি। কিছুদিন আগেই মাকে হারিয়েছে সে। মাতৃহীন মেয়েটির পরিবারে চাকরিজীবী বাবা ছাড়াও আছে বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া ভাই জুয়েল। একদিন খাবার টেবিলে যুঁথি তার ভাইকে জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা ভাইয়া, পতিতা বলতে কী বোঝায়?’ ছোট্ট বোনের এমন কথায় জুয়েল তো হতভম্ব। চোখ-কান দিয়ে ধোঁয়া বেরোনার জোগাড় তার। ধমকের সুরে বোনকে তিনি জিজ্ঞেস করেন, ‘পতিতা’ শব্দটি সে কোথায় পেয়েছে! যুঁথি উত্তর দেয়, ইউটিউবে গান দেখার সময় স্ক্রল করতে গিয়ে চোখে পড়ে ‘স্কুলের মেয়েরা কিভাবে পতিতা হচ্ছে দেখুন’।
ইউটিউব খুললেই এখন অহরহ চোখে পড়ে এমন অনাকাক্সিক্ষত কনটেন্ট। এটি শুধু রাজধানীর সমস্যা নয়, পুরো বাংলাদেশেরই চিত্র। সচেতন অভিভাবকরা মানসিক আতংকে থাকেন অনিরাপদ ইন্টারনেট (ইউটিউব) নিয়ে। সমস্যা দিন দিন বাড়ছে, অথচ দেখার যেন কেউ নেই। এমন অনিরাপদ ভিডিও সংখ্যা দেশি-বিদেশি মিলে কয়েক লাখ। শিশু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউটিউবে যে কেউই চাইলে ভিডিও আপলোড করতে পারছেন। যেখানে মানহীন ও শিশুদের জন্য অনিরাপদ ভিডিওর সংখ্যা অনেক বেশি।
বর্তমানে আরেকটি সমস্যা খুবই প্রকট হয়ে উঠেছে। ইউটিউবে শিশুদের জন্য তৈরি হচ্ছে প্রাপ্তবয়স্ক (অ্যাডাল্ট) সব কনটেন্ট। আর এতে অভিনয় করানো হচ্ছে ১০-১৬ বছরের শিশু-কিশোরদের। বিষয়বস্তু বড়দের, পোশাক বড়দের, শিশুদের দিয়ে কেবল অভিনয় করানো হচ্ছে। প্রেমে পাগল, মনে জ্বালার মতো বিষয়গুলোর সঙ্গে ‘অংশগ্রহণকারী ও দর্শক শিশুরা’ পরিচিত হচ্ছে। এসব আপত্তিকর কনটেন্ট যেকোনো মূল্যে বন্ধ করা এবং শিশুর বেড়ে উঠতে সহায়ক কনটেন্ট ইউটিউবে দেয়ার ব্যবস্থা করতে এখনই উদ্যোগ নেয়ার কথা বলছেন জনপ্রিয় কনটেন্ট নির্মাতা ও ইউটিউবাররা। আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলছেন, সংস্কৃতি ও অপসংস্কৃতির মধ্যকার পার্থক্য নির্ধারণ করে সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ করবে- এ রকম মনিটরিং দরকার।
ইউটিউবে ছোটদের নাটক দেখার জন্য সার্চ দিলে এমন কনটেন্ট হাজির হয়, যেখানে শিশুদের বড়দের চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা যায়। বিষয়বস্তুও প্রাপ্তবয়স্কদেরই। এসব কনটেন্টের টার্গেট গ্রæপ শিশুরাই। শিশুদের বিনোদনের ভিডিওতে বিভিন্ন রকমের অনাকাক্সিক্ষত বিজ্ঞাপন প্রদর্শন নিয়ে বিশ্বব্যাপী যখন আন্দোলন ও পর্যালোচনা চলছে, তখন শিশুদের ব্যবহার করে এসব দেশীয় কনটেন্ট দিয়ে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ভরে ফেলা অপরাধের পর্যায়ে পড়ে বলে মনে করছেন শিশু অধিকারকর্মীরা। তারা বলছেন, এসব আপত্তিকর অনাকাক্সিক্ষত কনটেন্টে শিশুরা একদিকে যেমন বিভ্রান্ত হচ্ছে, অন্যদিকে তাদের মধ্যে বিকৃত ভাবনাও তৈরি হচ্ছে।
ইউটিউবে জনপ্রিয় সিরিজ মি. বিন দেখছিল দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্রী সোমা। দেখার সময় সে লক্ষ করল ‘লনলি ওয়াইফ’ নামের একটি ভিডিও সাজেস্ট করা হচ্ছে দেখার জন্য। মাকে প্রশ্ন করল বাচ্চা মেয়েটি- আম্মু, লনলি ওয়াইফ মানে কী? ব্যাংক কর্মকর্তা রেহেনা আখতার শিশুকন্যার মুখে এমন কথা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লেন। তিনি মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলেন তার মেয়ে সেই অনিরাপদ ভিডিও ক্লিপ ওপেন করে বসে আছে! যেখানে এমন কিছু দেখানো হচ্ছিল যেটা একটি শিশুর মস্তিষ্ককে ধ্বংস করে দেবে অল্প বয়সেই।
শাহরিয়ার চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। বাবার মোবাইলে ইউটিউবে মীনা কার্টুন দেখছিল। হঠাৎ বাবাকে সে প্রশ্ন করে, ‘হাজবেন্ড-ওয়াইফ লাভ স্টোরি’ বলতে কী বোঝায়? অবাক চোখে ছেলের দিকে তাকান বাবা মোস্তাক হোসেন। তিনি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। ছেলের হাত থেকে মোবাইল নিয়ে দেখেন ‘ভয়ানক কিছু’। যেটি মীনা কার্টুনের মাঝপথেই ‘সাজেস্ট’ করা হয়েছে।
ইউটিউব ভিডিওর আরেকটি অংশ ‘টিকটক’। এটি একটি চীনাভিত্তিক অ্যাপ। টিকটকে ধারণকৃত ভিডিওকে বলা হয় ‘টিকটক’ ভিডিও। বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের বক্তব্য, সিনেমার ডায়ালগের সঙ্গে ঠোঁট মিলিয়ে ‘টিকটক’ ভিডিও তৈরির প্রবণতা সব থেকে বেশি। এসব ভিডিও তৈরি করে সবাই ফেসবুক-ইউটিউবে আপলোড করে। এসব ভিডিও কী পরিমাণ ব্যঙ্গ আর অশ্লীলতা ছড়াচ্ছে তা কল্পনাকেও হার মানায়। কিশোর-কিশোরী তরুণ-তরুণীরা নির্লজ্জভাবে অশ্লীল কথাবার্তার সঙ্গে নিজেদের ঠোঁট মিলিয়ে অবলীলায় তা ছড়িয়ে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। এমনকি অশ্লীল কুরুচিপূর্ণ উচ্চারণের পাশাপাশি আপত্তিকর অঙ্গভঙ্গির দৃশ্য ধারণ করে তা ইউটিউবে আপলোড করতে দ্বিধা করছে না। এ ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় নারীরাও পিছিয়ে নেই। শুধু ‘টিকটক’ নয়; বিভিন্ন উপায়ে কুরুচিপূর্ণ সংলাপে ভরা ভিডিও নির্মাণ করে প্রচার-প্রসারের মাত্রাটা অকল্পনীয়। একসময়কার কৌতুক অভিনেতারাও এই সুযোগটা তাদের হীন উদ্দেশ্যে কাজে লাগাচ্ছে। আর এর থেকে অপ্রাপ্তবয়স্করাও শিখছে কুরুচিপূর্ণ সংলাপ ও নষ্টামির পদ্ধতি। নিচ্ছে অশ্লীলতার দীক্ষা।
আবার ফেসবুক-ইউটিউবে দেয়া আপত্তিকর ভিডিওর প্রতিবাদে কথিত ইউটিউবাররা সেগুলো ‘ঠেকানোর নামে’ হাজার হাজার ভিডিও বানিয়ে তার প্রচার বাড়িয়ে দিচ্ছে শতগুণ।
আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, মেয়েটির বয়স ৮ কি ৯ হবে। বলিউডের গানের সঙ্গে ঠোঁট মিলিয়ে ড্যান্স করছে। দেশে নাচ শেখার আসরের অভাব নেই। কিন্তু এমন অশ্লীল অঙ্গভঙ্গির নাচ কোথাও শেখানো হয় বলে জানা নেই। ইউটিউব দেখে দেখেই ছোট্ট মেয়েটি বলিউডের স্বল্পবসনা নায়িকাদের অনুকরণে গানের তালে তালে নাচ শিখেছে নিশ্চয়ই। ওই শেখা পর্যন্ত ক্ষ্যান্ত না থেকে নিজে সেই গানের তালে নেচে ভিডিও ধারণ করে নিজের নামে ইউটিউব চ্যানেল তৈরি করে তাতে আপলোড দিয়েছে। এতে নিশ্চয়ই পরিচিত কারোর সহযোগিতা সে নিয়েছে। কারণ একা একা এটা তার পক্ষে করা কোনোভাবেই সম্ভব না। আর পরিবারের সম্মতি ছাড়াও ওইটুকুন মেয়ের পক্ষে কোনোভাবেই এটা করা সম্ভব নয়।
এ ব্যাপারে দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের আলোচিত শিশু গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশে শিশুদের জন্য নিরাপদ ইন্টারনেট আন্দোলনের প্রধান আরিফ রহমান শিবলী বলেন, ভিউ বাড়ানোর জন্য এমন কিছু কনটেন্ট লেখা হয় যেটা দেখে বেশি ক্লিক করছে শিশু-কিশোররা। মিউজিক ভিডিওর নামে অসভ্যতাকে তুলে ধরা হচ্ছে এবং স্বল্পসময়ের নাটক-সিনেমার নামে অশ্লীল ভাষা, পোশাক, গল্প তুলে ধরা হচ্ছে ইউটিউবে।
তিনি বলেন, এসব কারণে ইউটিউবকে শিশুদের জন্য মারাত্মক হুমকি বলে আমি মনে করি। দেশ বিদেশের গণমাধ্যমে প্রশংসিত ‘কিডস মিডিয়া’ প্রধান আরিফ আরো বলেন, আয়ের আশায় ভিউ বাড়ানোর জন্য এমন কিছু ইউটিউবে আপলোড হচ্ছে দিনের পর দিন, যেগুলো শিশু-কিশোররা দেখলে মানসিক ধাক্কা ও সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। আর সবচেয়ে ভয়ানক হচ্ছে ইউটিউবের নোংরা দেশি-বিদেশি ভিডিওগুলো না খুঁজলেও চোখের সামনে হাজির হয়।
শিশু-কিশোরদের হাতে একা ইউটিউব চালাতে দেয়া এখন মারাত্মক হুমকি। আমি সব অভিভাবককে বলব, আপনার ছেলেমেয়েরা ইউটিউবে কী দেখছে খেয়াল রাখুন। ইউটিউবে নোংরা ভিডিওগুলো আপলোডকারীদের দ্রæত গ্রেফতার ও আইনের আওতায় আনা জরুরি বলেও মনে করেন বাংলাদেশের শিশুদের জন্য নিরাপদ ইন্টারনেট আন্দোলনের প্রধান আরিফ রহমান শিবলী।
ইউটিউবার ও কনটেন্ট নির্মাতা সাকিব বিন রশীদ বলেন, ‘শিশুদের কনটেন্ট হিসেবে যা দেখানো হয় তা ভয়াবহ। আমি বেশ কিছু তেমন ভিডিও দেখেছি। এই শিশুদের দিয়ে যা বলানো হয় এবং যেভাবে তা দেখানো হয়, তা দেখে যদি শিশুরা সত্যি তেমন আচরণ করতে চায় সেটির ফল হবে ভয়ঙ্কর। রোমান্টিক দৃশ্যে বড়দের মতো করে সাজিয়ে শিশুদের উপস্থাপন স্পষ্টতই শিশু অধিকারের লঙ্ঘন।’
তিনি আরো বলেন, ‘শিশুদের জন্য সুস্থ শিক্ষা দরকার। তা তো নেই-ই, বরং তার পরিবর্তে নেতিবাচক শিক্ষার মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাকে। বড়দের কপি করা শিখছে, সেটিও নেতিবাচক কনটেন্টের মাধ্যমে। বন্ধু কিভাবে তৈরি হবে, প্রকৃতি কখন কিভাবে সাড়া দেয়, বড়দের সঙ্গে আচরণ কেমন হবে- বিভিন্ন মূল্যবোধ শেখানো যেতে পারে। আমি শিশুদের কনটেন্ট বন্ধের পক্ষে বলছি না। শিশুদের উপযোগী আইডিয়া নিয়ে কাজ করা জরুরি। সৃজনশীলতা বাড়বে এমন কনটেন্ট নিয়ে কাজ করা জরুরি।’
সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘এ ধরনের কনটেন্টের বিষয়ে উদ্যোগ নেয়ার সুযোগ সাইবার ক্রাইমের অবশ্যই আছে। কিন্তু সবার আগে সংস্কৃতি ও অপসংস্কৃতির মধ্যকার পার্থক্য সুনির্দিষ্ট করতে হবে। নাটিকা বা ছোট ছোট যে ভিডিও ক্লিপগুলো সেগুলো নিয়মিত একটা মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা থাকা দরকার।’
এ ধরনের সমস্যাকে সামাজিক সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ডিজিটাল পরিসরে অনেক ধরনের কনটেন্ট আছে। চাইলেই একাধারে সব বন্ধ করে দেয়া যাবে না। তেমন কিছু করলে বাকস্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। ভুক্তভোগী বা দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনতে পারেন। সেগুলো আমলে নিয়ে আমরা আমাদের করণীয় নির্ধারণ করতে পারি।’
শিশু অধিকার পরামর্শক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘স্পষ্ট কথা হচ্ছে এগুলো অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। যে কারণ এখানে শিশুদের তিনটি বড় ক্ষতির জায়গা তৈরি হচ্ছে-প্রথমত, কনটেন্টগুলো হচ্ছে অশ্লীল। দ্বিতীয়ত, এগুলো স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক, পরিবার সম্পর্কে একটি কুরুচিপূর্ণ, নারীর প্রতি মর্যাদাহীন শিক্ষা দিচ্ছে শিশুকে। সেটা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা খুব জরুরি। কারণ, ছোটবেলাই শিশুদের মনে যেটা গেঁথে যায় সেটাই কিন্তু সারা জীবন তার মনের ভেতর থাকে। কাজেই এ ধরনের কনটেন্ট তৈরির ক্ষেত্রে এগুলো খুবই সেনসিটিভ একটা বিষয়, প্রশাসনের অবিলম্বে ব্যবস্থা নেয়া উচিত। এর ভেতর কিছু কিছু কনটেন্ট আছে, যেগুলোর বিষয়ে আমাদের আইসিটি অ্যাক্ট এবং পর্নোগ্রাফি আইনে একটা ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ রয়েছে। কাজেই শিশুদের ব্যবহার করা, এটা যেমন গুরুতর অপরাধ, শিশুদের টার্গেট করে এ ধরনের কনটেন্ট তৈরি করা, সেটিও অপরাধ। যারা এ কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।’
মানবকণ্ঠ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন