কর্তৃপক্ষের যথাযথ নজরদারি না থাকায় এক গ্রাহকের আঙুলের ছাপ চুরি করে একাধিক সিম নিবন্ধন হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত সেলফোন অপারেটর টেলিটকের। পরে ওইসব সিম চড়া দামে কিনে নিচ্ছে অপরাধীরা। আর সেই সিম দিয়েই সংঘটিত হচ্ছে চাঁদাবাজি, অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসাসহ নানা ধরনের অপরাধ।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, বিষয়টি নজরে এনে এখনই ব্যবস্থা নেয়া না হলে ভবিষ্যতে ভুয়া তথ্যে নিবন্ধিত এসব সিম জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে। যদিও টেলিটক বাংলাদেশ লিমিটেড দাবি করেছে, যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই গ্রাহককে সিম সরবরাহ করছে তারা।
সম্প্রতি গ্রাহকের আঙুলের ছাপ চুরি করে সিম নিবন্ধন চক্রের দুই সদস্যকে রংপুর থেকে গ্রেফতার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত শাখা (সিআইডি)। তাদের একজন হলেন টেলিটকের কাস্টমার কেয়ার সুপারভাইজার আহমেদ জাহিদ আনোয়ার এবং অন্যজন রংপুর সিটি করপোরেশনের কম্পিউটার অপারেটর মাহমুদুল হাসান মামুন। এছাড়া ঢাকা থেকে সাইদুল ইসলাম নামের আরো একজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এ সময় তাদের কাছ থেকে গ্রাহকের তথ্য চুরি করে নিবন্ধন নেয়া ১ হাজার ২০০টি সিম উদ্ধার করা হয়, যার অধিকাংশই টেলিটকের। এছাড়া সেলফোন অপারেটর রবির সিমও ছিল এতে।
গ্রেফতারকৃত এ তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী জানায়, এখনো যেসব সিম থেকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে, তার বেশির ভাগই টেলিটকের। আর এ অপরাধে সম্পৃক্ত রয়েছেন অপারেটরটির অসাধু এজেন্ট ও কর্মকর্তারা। গ্রাহকের তথ্য চুরি করে নিবন্ধন করা সিম বিক্রি থেকে যে অর্থ পাওয়া যায়, তার ভাগও চলে যায় অপারেটরটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে। এ চক্রটি শুধু গ্রাহকের ভোটার আইডি কার্ড বা ছবিই চুরি করছে না, তারা গ্রাহকের আঙুলের ছাপও চুরি করছে। যান্ত্রিক ত্রুটির কথা বলে তাদের এজেন্টরা গ্রাহককে দিয়ে ৫ থেকে ১০ বার আঙুলের ছাপ নিচ্ছে। এর মধ্যে একটি ছাপ ব্যবহার করা হচ্ছে ওই গ্রাহকের সিম রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে, আর অন্য ছাপগুলো দিয়ে নিবন্ধন করা সিম তুলে দেয়া হচ্ছে অপরাধীদের হাতে।
সিআইডির এক কর্মকর্তা জানান, জাহিদ আনোয়ারের একজন আত্মীয় টেলিটকের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে কর্মরত রয়েছেন। ওই কর্মকর্তার সুবাদে ২০১৪ সালে স্ত্রীসহ টেলিটকে যোগ দেন জাহিদ। ওই আত্মীয়ের প্রভাব খাটিয়েই জাহিদ উত্তরাঞ্চলের পাঁচটি জেলায় সিন্ডিকেট তৈরি করেন। এ সিন্ডিকেট মূলত উত্তরাঞ্চলের পাঁচটি জেলায় গ্রাহকের আঙুলের ছাপ চুরি করে সিম নিবন্ধনের একটি বিশাল নেটওয়ার্ক তৈরি করে। নেটওয়ার্কটি গ্রামে গ্রামে গিয়ে ফ্রি সিম বিতরণের ক্যাম্পেইন করে থাকে। সিম নিলে সঙ্গে একটি মগও ফ্রি দেয়া হয়। আর তাদের প্রলোভনে পড়ে একজন এলে, পরে তার পরিবারের সবাইকে নিয়ে এসে ফ্রি সিম ও মগ নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তাব দিয়ে তাদেরও আঙুলের ছাপসহ অন্যান্য তথ্য চুরি করা হতো।
সূত্র জানায়, এ চক্রটি মূলত উত্তরাঞ্চলের দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী ও জয়পুরহাট থেকে গ্রাহকের আঙুলের ছাপ চুরি করে। পরে চুরি করা আঙুলের ছাপ দিয়ে আট থেকে দশটি করে সিম নিবন্ধন করে। পরে গ্রাহকের চুরি করা তথ্যে নিবন্ধিত সিমগুলো আনা হয় রংপুরে। সেখান থেকে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে সিমগুলো পাঠানো হয় ঢাকায়। এখানে সিমগুলো গ্রহণ করেন লিয়াকত নামের এক চোরাই সিম ব্যবসায়ী। এই লিয়াকত সিম জালিয়াতির কারণে এক বছর জেলও খেটেছেন। কিন্তু জেল থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি পুনরায় একই কাজে জড়িয়ে পড়েন। তাকে গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রেখেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।
সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমের সিরিয়াস ক্রাইম ইউনিটের অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার ফারহান রাজিব বণিক বার্তাকে বলেন, টেলিটকের সিম নিবন্ধনের ক্ষেত্রে যথাযথ তদারকি না থাকায় এমনটি হচ্ছে। বিক্রয় প্রতিনিধি থেকে শুরু করে প্রতিটি ধাপেই তদারকি করা প্রয়োজন। কিন্তু এ তদারকি না থাকায় একজন গ্রাহকের তথ্য চুরি করে আট-দশটি সিম নিবন্ধন করা হচ্ছে। এ ধরনের সমস্যা সমাধানে গ্রাহক সচেতনতা তৈরির পাশাপাশি টেলিটকেরও তদারকি বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
উল্লেখ্য, নিবন্ধনহীন অবৈধ সিম শনাক্তে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। এসব অভিযানে অবৈধ কল টার্মিনেশনে ব্যবহূত বিপুলসংখ্যক চ্যানেল বক্স, জিএসএম গেটওয়ে, সফটসুইচ, সার্ভার, রাউটার, মডেম, সেলফোন হ্যান্ডসেট, লেন সুইচ, কলিং কার্ড ও ভুয়া তথ্যে নিবন্ধিত সিম উদ্ধার করা হয়। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে পরিচালিত মোট ৩৩টি অভিযানে ৩০ হাজার ১৪৭টি এমন সিম আটক করা হয়। এর মধ্যে একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সবচেয়ে বেশি সিম আটক হয় টেলিটকের, ১০ হাজার ৮০৫টি। এছাড়া গ্রামীণফোনের ৪ হাজার ৯৫৬, বাংলালিংকের ১ হাজার ৯১, রবির ৬ হাজার ৯২৪, এয়ারটেলের (বর্তমানে রবির সঙ্গে একীভূত) ৬ হাজার ৩৬৩ এবং সিটিসেল ও র্যাংকসটেলের চারটি করে সিম আটক হয়। প্রতিটি অভিযানের ঘটনায় একটি করে মামলাও হয়।
জানতে চাইলে টেলিটকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী মো. গোলাম কুদ্দুস বলেন, জাহিদকে আমরা এরই মধ্যে চাকরিচ্যুত করেছি। তার মতো আরো যাদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ আসবে, তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন