একটা সময় ছিল স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা টিফিনের টাকা জমিয়ে রাখত নতুন ক্যাসেট কেনার জন্য। কিশোর-তরুণরা ব্যান্ডের ক্যাসেট কিনতে দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হয়েছে ভক্তকে। অনেকে অগ্রিম টাকা দিয়ে রাখতেন পছন্দের ব্যান্ডের ক্যাসেট কিনতে। কোথাও কোনো ব্যান্ডদল আসছে গান পরিবেশনের জন্য শুনলেই চারদিকে হইহই পড়ে যেত। কিন্তু এখন এসব বিষয় যেন কেবলই সোনালি অতীত। এই কালে ব্যান্ড নিয়ে মাতামাতি এখন আর নেই বললেই চলে।
সত্তরের দশকে বাংলাদেশে ব্যান্ড সংগীতের শুরু। আর নব্বইয়ের দশক ছিল ব্যান্ড সংগীতের সবচেয়ে উজ্জ্বল সময়। স্বাধীনতা পর পর আজম খান বাংলাদেশে গড়ে তুলেছিলেন ‘উচ্চারণ` নামে একটি ব্যান্ড দল৷ স্বাধীন বাংলাদেশে সেটাই ছিল প্রথম ব্যান্ড। এরপর ফিরোজ সাঁই, ফকির আলমগীর, ফেরদৌস ওয়াহিদের নামও রাখা যায় জনপ্রিয় ব্যান্ডের খাতায়। আজম খানের কণ্ঠে গাওয়া ‘সালেকা মালেকা`, ‘রেললাইনের ওই বস্তিতে`, ‘আসি আসি বলে তুমি আর এলে না`, ‘আলাল ও দুলাল`, ‘অভিমানী, ‘মুক্তিসেনা আমি`-র মতো গান মনে পড়লে এখনোও দর্শকরা সজোরে গেয়ে ওঠে।
এরপর ‘মাইলস` আর ‘সোলস` নামের দু`টি গ্রুপ অনেকদিন রাজত্ব করে৷ সাফিন আহমেদ আর তপন চৌধুরী বাংলা ব্যান্ডে যোগ করেন নতুন এক ধারা৷ আরো যোগ হয় ফিডব্যাক, ফিলিংস, নগর বাউল, রেনেসাঁ৷ ব্যান্ড সংগীতের লিজেন্ড আইয়ূব বাচ্চুর ‘এলআরবি` আর জেমস-এর ‘নগর বাউল` বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতকে নতুন উচ্চতা দেয়৷ বর্তমানে যে কয়টি ব্যান্ড কিছুটা হলেও ঐতিহ্য ধরে রেখেছে, তার মধ্যে অন্যতম দলছুট, চিরকুট, জলের গান, শিরোনামহীন, অর্থহীন, ব্লাক, আর্টসেল, তবে তারাও অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে।
এইসব ব্যান্ডের গান সাধারণ মানুষকে সংগীত নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে৷ তাদেরকে কৌতূহলী করেছে৷ তরুণদের আকর্ষিত করেছে ব্যাপকভাবে৷ সবশেষে বাংলা ব্যান্ডের গুরু বলা হয় জেমসকে। সেই জেমসের কনসার্টে এখনোও টিকেট পাওয়া যায়না। চিরকুট-এর শারমিন সুলতানা সুমি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘নব্বই-এর দশককে বাংলা ব্যান্ড মিউজিকের স্বর্ণযুগ বলা হয়৷ ফিডব্যাক, নগর বাউল, এলআরবি, ওয়ারফেজ, রেনেসাঁ, মাইলস এ রকম অসাধারণ সব গ্রুপের জন্ম হয়েছিল৷ তাঁরা বাংলা ব্যান্ডের ট্রেন্ড সেট করেন৷ গান যে শুধু প্রেম, ভালোবাসা নিয়ে কথা বলবে, তা নয়৷ মানুষের জীবন নিয়ে কথা বলবে৷ জীবনের সব বিষয় নিয়েই যে গান হতে পারে, তা তাঁরা তখন প্রতিষ্ঠা করেন৷’
নব্বই-এর দশক থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ব্যান্ড নিয়ে একধরনের উত্তেজনা ছিল। কিন্তু বর্তমানে তরুণদের মাঝে ব্যান্ড নিয়ে মাতামাতি করতে দেখা যায়না। ব্যান্ডে ভাটার টান লক্ষ্য করা যাচ্ছে। লিজেন্ডরা বলছেন, বর্তমানে তরুনরা তাদের ব্যান্ড নিয়ে অ্যামেরকিা, ক্যানাডা, অষ্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। আগে ব্যান্ডকে পেশা হিসেবে নেয়া হতো। বাংলাদেশে একমাত্র আইয়ুব বাচ্চু ফুল টাইম ব্যান্ড মিউজিক করতেন৷ কিন্তু এখন আর্থিকভাবে লাভবান না হওয়ায় অনেকেই ব্যান্ড মিউজিককে পেশা হিসেবে নিচ্ছে না।
আগে ব্যান্ড দলের সদস্যদের মধ্যে আগের মতো টান লক্ষ্য করা যায়না। হরহামেশাই ভেঙ্গে যাচ্ছে ব্যান্ড। এখনকার ব্যান্ডের সদস্যদের মধ্যে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব ব্যান্ড ভেঙে যাওয়ার অন্যতম কারণ। ব্যান্ডের সদস্যদের মধ্যে মতের অমিলও একটি বড় কারণ। এছাড়া কোন ব্যান্ড দলের ভাঙনের পেছনে অর্থনৈতিক টানাপোড়নটাও একটি বড় কারণ। ভালো আয় করা না গেলে যে কোন কিছুই টিকে রাখা মুশকিল। বিশেষ করে নতুন এবং মাঝারি মানের ব্যান্ডগুলোর জন্য। ব্যান্ডের সাথে জড়িয়ে থাকলে সাধারণত তারা আর কোন কাজের সাথে যুক্ত থাকতে পারেন না। ওদিকে গান করে যে অল্প ক’টা টাকা আয় রোজগার হয় সেটা দিয়েও চলা মুশকিল।
বাংলাদেশে নারীদের নিয়েও আলাদা ব্যান্ডের প্রচেষ্টা করা হয়েছে। তবে তা এখন পর্যন্ত খুব বেশি সফল হয়নি৷ নারীদের নিয়ে ব্যান্ড তৈরির প্রসঙ্গে সুমি বলেন, ‘আমাদের ব্যান্ডে তো আমিই একমাত্র নারী আর সবাই পুরুষ৷ আমি অবশ্য নিজেকে নারী বা পুরুষ হিসেবে দেখি না৷ আমি একজন ব্যান্ড সংগীত শিল্পী৷ তবে আমাদের দেশে ব্যান্ড নিয়ে নারীদের অনেক কিছু করার আছে।` সমালোচনা আর অবহেলাকে সাথে করেই বর্তমানে ব্যান্ড এগিয়ে যাচ্ছে। ২০০০ সালের পর থেকে ব্যান্ড সংগীত যে অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তা আবারও প্রত্যাবর্তন হবে বলে আশাবাদী তরুণরা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন