"ব্রোকেন ফ্যামিলির" সন্তান হিসেবে আমার জীবনটা আর দশটা খুব স্বাভাবিক ছেলেমেয়েদের থেকে অনেকখানি আলাদা ছিল, সবসময়। সর্বোচ্চ দুই সেকেন্ডে উচ্চারণ করে ফেলা শব্দটা বাস্তবে কতখানি মানসিক যন্ত্রনা দিতে পারে তা আমি জানি। যখন আমার কোন সহপাঠী জ্বলজ্বলে চোখে তাদের বাবাদের ভালোবাসার ছেলেমানুষি গল্প করে কিংবা যখন ফেসবুকের টাইমলাইন স্ক্রল করতে করতে কাঁচাপাকা চুলের কোন বাবাকে তার আদরের বাচ্চার সাথে হাসিমুখে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখি তখন বুকের ভিতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে অনেক, আজও। অভ্যাস হবে না হয়তো কোনদিন। "বাবা" নামের খুব স্বাভাবিক একটা আশীর্বাদ আমার জীবনেই কেন নেই? কেন মানুষটা শুধু আমার মায়ের স্বামী, আমার জন্মদাতা, আমার "বাবা" না?
মাত্র বাইশ বছর বয়সে চোখে হাজারটা রঙিন স্বপ্ন নিয়ে শুরু করা আমার মায়ের সংসারটা শ্মশান হতে খুব বেশিদিন লাগেনি। তবু সেই প্রাণহীন শ্মশান আগলে রেখেছিলেন তিনি প্রাণপণে, বিনা ভালোবাসায় জন্ম নেয়া আমার ছোট ছোট ভাইগুলোর জন্য। প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, তার যদি কোনদিন একটা মেয়ে হয়, যে সম্মান তিনি নিজে পাননি, তার শতগুণ সম্মানের যোগ্য করে গড়ে তুলবেন তার মেয়েকে। ঈশ্বরের হাজার কৃপায়, সহস্র বছরের পূণ্যের বিনিময়ে আমি এই মায়ের গর্ভে জন্মেছিলাম। এসএসসি বা এইচএসসি কিংবা মেডিকেল এডমিশান কোন পরীক্ষার সময়ে হল থেকে বের হয়ে আমি অন্যদের মত বাবা মানুষটাকে দেখিনি, দেখেছি দুপুরের কড়া রোদ মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আমার মাকে।
ডায়বেটিস ম্যালাইটাসে মাসল মেদ ক্ষয়ে অর্ধেক হয়ে যাওয়া আমার মাকে দেখে কেউ বলবে না, কি প্রাণশক্তি আছে তার ভেতরে! জন্ম থেকে এই মানুষটিকে একা আমাকে নিয়ে শক্ত হয়ে অটল দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। তার কড়া শাসনে অতিষ্ঠ হয়ে হাঁপিয়ে উঠতাম আমি, আমার শত গলাবাজির উত্তরে মা সবসময় একটা কথাই বলতেন, "বড় হও, তখন বুঝবা”। কত বড় হয়েছি জানিনা, তবে এখন বুঝি, তার সমস্ত জীবন ছিলাম আমরা তিনটি ভাইবোন। কোন ঈদে একটির জায়গায় দুইটা জামা না পেয়ে গাল ফুলানো আমি কখনো ভেবে দেখতাম না, জন্ম থেকে আমার মাকে কখনো শখ করে নিজের জন্য একটা শাড়িও কেন কিনতে দেখিনি। কলেজে কাজল পরা মেয়েদের দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মায়ের নিষেধগুলো ঘৃণা করতাম ঠিকই কিন্তু জন্ম থেকে কোনদিন আমার মাকে কেন কোনদিন সাজতে দেখিনি, প্রশ্নটা মনে আসেনি কখনো। স্বার্থপর আমি সবসময় স্বার্থ নিয়েই মেতে ছিলাম, আমার মা যে কোন ফাঁকে নিজের জীবনটাই আমাদের করে দিলেন দেখিনি কখনো।
সত্যি কথা বলতে, আমার একার চেষ্টা, শ্রম, ধৈর্য, অধ্যাবসায় সবমিলিয়েও ঢাকা মেডিকেলের চৌকাঠ পেরোনোর যোগ্যতা আমার ছিল না। মানুষটা আমার মা, যিনি আমার পাল্লা ভারি করেছিলেন। এডমিশানের তারিখটা যত কাছে আসতে থাকলো, তত মরিয়া হয়ে যাওয়া মানুষটা আমি ছিলাম না। এডমিশান পরীক্ষা দিতে যাওয়ার পথে আল্লাহর নাম নিয়ে বিড়বিড় করে দোয়া পড়তে থাকা মানুষটাও আমি ছিলাম না, আমার মা ছিলেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়াশোনার পাশাপাশি আমি একটা কাজই করি সেটা হলো টুকটাক লেখালেখি, গল্প বা নিতান্তই নিজের বিশ্বাসের কিছু কথা। কল্পনা আর নিছক ভালো লাগা থেকে শুরু করেছিলাম লেখার অভ্যাসটা, ফেসবুক নামের প্লাটফর্মটা পেয়ে। তারপর নিতান্তই কৌতুহল বশত নিজের লেখাগুলো পাঠাতে শুরু করলাম একটা দুটো প্রতিযোগিতায়, যখন যে সুযোগ চোখে পরে আর কী। লেখালেখির অর্জন বলতে ঝুলিতে আছে বেশকিছু মানুষের শুভকামনা, তাদের হাসিমুখে বলা, "ইচ্ছা, তোমার লেখা অনেক ভালো লাগে।" আর নারী দিবসের লেখনী প্রতিযোগিতার প্রথম পুরষ্কার কিছু বই আর সম্প্রতি পাওয়া ট্রাভেলেটস অফ বাংলাদেশ আয়োজিত ভ্রমনকাহিনী লেখা প্রতিযোগিতায় সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপুমনি ম্যামের হাত থেকে নেওয়া ক্রেস্টখানি। আমার মনে হয়, লেখা খুব কঠিন কোন কাজ না যদি কল্পনাটুকু করতে পারো তো। এ ক্ষেত্রে আমি যতটুকুই পারি, অধিকাংশ ক্রেডিট আমার ভাইদুটোকে দেবো। ছোটবেলা থেকে তারা আমাকে কল্পনা করতে শিখিয়েছিলো। মায়ের কড়া শাসনে বড় হতে থাকা অমিশুক ছোট্ট বোনটাকে একটু জিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ দিতে তারা আমাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলো পাঁচ ফুট লম্বা বিশাল এক আলমারির সামনে। একটু একটু করে টাকা জমিয়ে জমিয়ে কেনা তাদের বইয়ের আলমারি। ক্লাস টুতে পড়ি, যখন আমি প্রথম হাতে তুলে নিয়েছিলাম মোহাম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের লেখা বই "তিন্নি ও বন্যা"। বানান করে করে গল্পগুলো পড়তে পড়তে আমি প্রথম কল্পনা করেছিলাম তিন্নিকে। মায়ের অনুমতি নিয়ে এখানে ওখানে বাবার সাথে আমি কোনদিন ঘুরিনি ঠিকই কিন্তু কল্পনায় আমি পুরো পৃথিবী চষে বেড়াতাম। এডভেঞ্চার করতাম, ফেলুদার সাথে খুনি কে সেটা বের করতাম, কাকাবাবুর ক্র্যাচের সাথে তাল মিলিয়ে হাটতাম হিমালয়ে। সেই কল্পনার রেশ ধরে এখনো যখন চোখ বন্ধ করি, কোন না কোন গল্প কল্পনা হয়ে আমাকে ধরা দেয়, আর আমি সেটা লিখে ফেলি।
জীবনের ওপর আমার অভিমান জমে ছিল অনেক, সেগুলো সরিয়ে হাসতে শিখছি একটু একটু। অনেক কিছুর পাশাপাশি এইটুকু শিখেছি, জীবনে "কেউ" আমাকে খুশি রাখবে কিনা এ নিশ্চয়তা কেউই দিতে পারেনা। নিশ্চয়তা যেটার আছে সেটা হলো আমার নিজের অর্জন করা যোগ্যতার। নিজের যোগ্যে আগে নিজে খুশি হয়ে নেই তারপর বাকি খুশির জন্য নাহয় অন্যের ওপর নির্ভর করা যাবে। এখন লক্ষ্য দুটো, এক. আমার নানা, যিনি আমার মায়ের জীবনের আদর্শ মানুষ, তার অপূর্ণ স্বপ্ন পূরণ করা। তার জন্মস্থান বাগেরহাটের মানুষদের জন্য দাতব্য চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। আর দুই. লেখার অভ্যাসটা যদি থাকে তাহলে আমার মায়ের জীবনটা একটি পান্ডুলিপিতে ফুঁটিয়ে তোলা। সারা পৃথিবীর মানুষ আরো একবার জানুক, নিজের ছেলেমেয়ের জন্য একজন মা নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে কতদূর যেতে পারেন। অবাক হয়ে তারা দেখুক, সারাজীবন অপমানিত হওয়া মানুষটা কতখানি সম্মানের যোগ্য!
প্রাপ্তি আমলান ইচ্ছা
পড়াশোনা ঢাকা মেডিকেল কলেজ
ক্যাম্পাসলাইভ২৪
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন