হুমায়ুন রশীদ সম্প্রতি হজ করে দেশে ফিরেছেন। এতদিন কমার্শিয়াল ব্যাংকগুলোতে স্বাচ্ছন্দ্যে লেনদেন করলেও এখন শরিয়াহ মোতাবেক হালাল লেনদেন করতে চাচ্ছেন।
বাংলাদেশে শরিয়াহ মোতাবেক লেনদেন করতে চাইলে রয়েছে ১১টি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক। তবে অনেকেরই প্রশ্ন, এ সব ব্যাংকে আদৌ শরিয়াহ মোতাবেক লেনদেন হয় কি-না? অনেকেই অভিযোগ করে থাকেন, এসব ব্যাংকে মুনাফার নামে সুদের বদলে যে লভ্যাংশ দেয়া হয় তা-ও একপ্রকার সুদ।
এ ব্যাপারে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মুফতি মাওলানা মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ সময় সংবাদকে বলেন, ‘সুদমুক্ত ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপরে আমরা আট বছর ধরে গবেষণা করেছি। এখানে গ্রাহকের কোনো দায় নেই। ব্যাংকগুলো যদি মুনাফার নাম করে সুদে ব্যবসা করে তাহলে তার দায়ভার ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ওপরে বর্তায়। ইসলামি ব্যাংকগুলো নিয়ে সন্দেহ পোষণ করা শয়তানের কাজ।’
ব্যাংকগুলো কীভাবে সুদের পরিবর্তে মুনাফার মাধ্যমে ব্যবসা করে এ ব্যাপারে জানতে আল-আরাফাহ ইসলামি ব্যাংক ও ইসলামি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারমান আর চৌধুরী ও মুনির মাওলাকে একাধিকবার ফোন ও মোবাইলে ক্ষুদেবার্তা পাঠানো হলেও তারা কোনো সাড়া দেননি।
একাধিক ব্যাংক কর্মকর্তার সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলতে চাইলে তারা জানান, ব্যাংকের নীতি অনুযায়ী এ ব্যাপারে কথা বলা নিষেধ আছে।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা অনেকেই ধারণা করি সুদমুক্ত ব্যাংকিং ব্যবস্থা পুরোটাই ভাওতাবাজি। কিন্তু আসলে এমন না। শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সুদমুক্ত ব্যাংকিংয়ের দিকে সর্বোচ্চ তাগিদ দেয়া হয়। ব্যাংকগুলো যাতে সুদে ব্যবসা করতে না পারে তাই অন্যান্য ব্যাংকে বছরে তিন বার অডিট করা হলেও ইসলামি ব্যাংকগুলোতে পাঁচবার অডিট করা হয়। এছাড়াও এখানে রয়েছে শরিয়াহ বোর্ড। যেকোনো ধরনের সিদ্ধান্ত থেকে শুরু করে লেনদেনজনিত সব কাজে তাদের থেকে অনুমোদন নেয়া হয়। এতে করে মুনাফার পরিবর্তে চাইলেই সুদের ব্যবসা করার কোনো সুযোগ নেই।’
ব্যাংকে রাখা আমানত ও এর থেকে পাওয়া লভ্যাংশের ব্যাপারে ব্যাংক কর্মকর্তা জানান, ‘সহজভাবে বলতে গেলে ইসলামি ব্যাংকগুলো গ্রাহকের রাখা আমানতের টাকা বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করে এবং এর লভ্যাংশ গ্রাহককে দেয়। একজন গ্রাহককে কত টাকার বিপরীতে কত টাকা লভ্যাংশ দেয়া হবে- এটা বোঝানো বেশ কঠিন। গ্রাহকের বোঝার সুবিধার জন্য আনুমানিক একটি লভ্যাংশ ধরে দেয়া হয়। সেটা ওঠানামা করে।’
বিনিয়োগ করলে লভ্যাংশ পেলেও কেন লোকসানের ভাগ গ্রাহক পান না- এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ব্যাপারটি এমন না যে ব্যাংক এক জায়গায় বিনিয়োগ করে। ধরা যাক, একশ' জায়গায় বিনিয়োগ করলে ১০ জায়গায় লোকসান হলো, এতে করে সামগ্রিকভাবে কিন্তু লাভই হচ্ছে। এরপরও ধরা যাক, কোনো এক কারণে ব্যাংকের লোকসান হলো, এক্ষেত্রে ব্যাংক নিজের ফান্ড থেকে লভ্যাংশ কম রেখে গ্রাহককে বেশি দিয়ে দেয়। দিন শেষে একজন গ্রাহক লাভের জন্যই ব্যাংকে টাকা রাখেন। তাকে লোকসানের ভয় দেখালে তিনি ব্যাংকমুখী হবেন না। এক্ষেত্রে গ্রাহক যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকে সর্বোচ্চ নজর দেয়া হয়।’
এছাড়া ঋণ দেয়ার ব্যাপারে ইসলামি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলো ব্যবসারক্ষেত্রে নিজ থেকে কাঁচামাল কিনে দেয় এবং ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে বড় অংশের মালিকানা নিজের কাছে রেখে দেয়। টাকা পরিশোধের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংকের মালিকানা কমতে থাকে। এখানে ব্যাংক সুদ না খেয়ে ভাড়া কিংবা ইজারার মতো করে মুনাফা অর্জন করে বলে জানান ব্যাংক কর্মকর্তা।
ক্রেডিট কার্ড থেকে শুরু করে অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যাপার নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শতভাগ স্বচ্ছ লেনদেনের নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। এক্ষেত্রে ইসলামি ব্যাংকগুলো নিজেদের আয় যাতে হালাল হয় সেজন্য সন্দেহজনক আয় থেকে মূল লভ্যাংশ আলাদা রাখে। সন্দেহজনক আয় থেকে যে অর্থ আসে তা দান করে দেয়া হয়। এক্ষেত্রে ব্যাংক কিংবা গ্রাহক কেউই সুদের ভাগিদার হচ্ছেন না।’
ব্যাংকগুলো শরিয়াহর নাম করে সুদের ব্যবসা করতে চাইলে তা হবে ভয়াবহ ব্যাংক কেলেঙ্কারি। সাধারণত এত বড় ঝুঁকি কেউ নিতে চাইবে না বলে জানান এ ব্যাংক কর্মকর্তা।
শরিয়াহ ব্যাংকগুলো এতটা পাক-সাফ হওয়ার পরও কেন গ্রাহককে ব্যাখ্যা দেয় না- এ প্রশ্নের জবাবে ওই ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, ‘এটা আসলে ব্যক্তির ওপর নির্ভর করে। আমাদের বলা আছে আমরা যাতে গ্রাহকদের বুঝিয়ে বলি।’
১৯৮৩ সালে ইসলামি ব্যাংকের মাধ্যমে বাংলাদেশে শরিয়াহ ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রচলন হয়। পরবর্তীতে মানুষের আগ্রহের ওপর ভিত্তি করে দেশে একের পর এক ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু হয়েছে। যেহেতু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সুদ সম্পূর্ণ হারাম, সে অনুযায়ী দেশের অধিকাংশ মুসলিম জনগোষ্ঠী শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিংকে নিরাপদ মনে করেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন