মানহীন ডালডা, পাম অয়েল, পানি, ফ্লেভার ও রঙ মিশিয়ে তৈরি করা হয় নকল ঘি ও মাখন। পরে দেশের নামিদামি অনেক খাদ্যপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কারখানা হয়ে এগুলো চলে যাচ্ছে মানুষের ঘরে ঘরে। এমনকি জনপ্রিয় অনেক কোম্পানির মোড়কে সুপার শপে বিক্রি হয় এসব নকল পণ্য। মানহীন পণ্য খেয়ে প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকে। কিন্তু অপরাধীরা থেকে যাচ্ছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। সম্প্রতি দৈনিক আমাদের সময়ের অনুসন্ধানে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
বেকারি পণ্য তৈরির একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হলো স্নেহজাতীয় পদার্থ। মানসম্পন্ন বেকারি পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানের মার্জারিন (মাখনের বিকল্প) ব্যবহার হয়ে থাকে। অন্যদিকে সাধারণ প্রতিষ্ঠানগুলো ডালডা বা বনস্পতি ব্যবহার করে। সে দিক থেকে দেশে এ জাতীয় পণ্যের একটি বড় বাজার রয়েছে।
এ সুযোগ কাজে লাগিয়েছেন রাজধানীর ভাসানটেকের লিটন তালুকদার। ৭ বছর আগেও লিটন মিরপুরের একটি স্থানীয় বেকারির ডেলিভারি বয় হিসেবে কাজ করতেন। এরপর তিনি মিরপুর সাড়ে ১১, পল্লবী বাসস্ট্যান্ডে ‘আহসান’স হট কেক’ নামে একটি ছোট পরিসরে দোকান খোলেন, যেটি তার একমাত্র দৃশ্যমান বৈধ ব্যবসা। তারপর শুরু করেন নকল-ভেজাল ঘি ও মাখন তৈরির ব্যবসা। সেই থেকেই দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রসিদ্ধ ব্র্যান্ডের নামে অবৈধভাবে ভেজাল খাদ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করে আসছেন তিনি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, লিটন রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অস্থায়ী কারখানা করে অনুমোদন ছাড়াই বালতি, মগ, ড্রাম ইত্যাদি ব্যবহার করে নকল ঘি, মাখন ও মার্জারিন তৈরি করে আসছেন। এগুলো বাজারজাত করার ক্ষেত্রে তিনি ভিন্ন ধরনের কৌশল অবলম্বন করে থাকেন। এসব পণ্য বাজারজাত করতে তিনি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান মিল্কভিটাসহ বিভিন্ন নামিদামি কোম্পানির মোড়ক ব্যবহার করেন।
এ বিষয়ে কথা হয় লিটনের কারখানার সাবেক কারিগর মো. ফারুকের সঙ্গে। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, লিটনের অস্থায়ী কারখানায় পাম অয়েল, পানি ও মার্জারিন মিলিয়ে তৈরি করা হয় মাখন। পাম অয়েল ও ডালডা মিশিয়ে তৈরি করা হয় ঘি। এসব ঘি বিক্রি করা হয় ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা কেজিতে এবং মাখন বিক্রি করা হয় ৬২০ টাকা কেজিতে। এ ছাড়া কালার কেমিক্যাল পেস্ট ও বিভিন্ন ধরনের জিংক অক্সাইড রঙ মিলিয়ে তৈরি করা হয় পেস্টি কেকের ক্রিম। এসব পণ্য ছড়িয়ে দেওয়া হয় ঢাকাসহ সারাদেশে।
এসব খাদ্যপণ্য মানুষের শরীরের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর বলে জানিয়েছেন রোগতত্ত্ববিদ ও আইইডিসিআরের প্রাক্তন পরিচালক অধ্যাপক ড. মাহমুদুর রহমান। তিনি বলেন, ডালডা ও পাম অয়েলে আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে। এগুলোতে এমন কিছু উপাদান রয়েছে, যা মানুষের রক্ত দ্রুত জমাট বাধার কারণ। এসব পণ্য খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করলে হৃদরোগ এবং স্ট্রোকের আশঙ্কা অনেক বেড়ে যায়।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, মেয়াদোত্তীর্ণ নিম্নমানের মার্জারিন, ফ্লেভার ও রঙ মিশিয়ে গোপনীয়ভাবে তৈরি করা এসব পণ্য লিটন নিজ মালিকানার একাধিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করেন। নিজ মালিকাধীন যেসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এই ভেজাল খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ করেন সেগুলো হলো- ১. শাহী ট্রেডারস, ২/১০ পল্লবী, মিরপুর, ঢাকা। ২. শাহী ট্রেডারস, ১০/১০ পল্লবী, মিরপুর, ঢাকা। ৩. আলম এন্টারপ্রাইজ, ১৮৫/১ মাটিকাটা, দেওয়ানপাড়া, ভাসানটেক, ঢাকা। ৪. খান এন্টারপ্রাইজ, ১০/১০ পল্লবী, মিরপুর, ঢাকা। ৫. আলম এন্টারপ্রাইজ ১/৯৬, খাতুনগঞ্জ, চট্টগ্রাম। ৬. খান এন্টারপ্রাইজ, রিয়াজউদ্দিন বাজার, চট্টগ্রাম। এসব প্রতিষ্ঠানের বাস্তবে অস্তিত্ব আছে কিনা, সেটি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে এসব নামে লেটার হেড ও ক্যাশমেমো তৈরি করে দেদার ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। এসব প্রতিষ্ঠানের নামের লেটার হেড ও ক্যাশমেমো এই প্রতিবেদকের হাতে রয়েছে।
এগুলো বিএসটিআই অনুমোদিত কিনা জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির সম্পাদক মইনউদ্দিন মিয়া জানান, এ ধরনের পণ্য উৎপাদনের বৈধতা বিএসটিআই থেকে দেওয়া হয় না।
সারাদেশে এসব ভেজাল ও নকল পণ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে কৌশল অবলম্বন করেন লিটন। নিজস্ব পরিবহনে সরাসরি না পঠিয়ে তিনি কুরিয়ার সার্ভিসে মাল পাঠান। বাংলাদেশ পার্সেল অ্যান্ড কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে মালামাল পাঠানোর বেশকিছু চালান এই প্রতিবেদকের হাতে রয়েছে। সেখানে চালানের কাগজে বাটার লেখা থাকলেও একটি সিলমোহর ব্যবহার করা হয়। যেখানে লেখা হয় ‘চেকিং ছাড়াই বুকিং করা হইল’। এসব চালানের প্রেরকের স্থানে কোনটিতে লেখা রয়েছে আলম এন্টাপ্রাইজ, কোনটিতে শাহী ট্রেডার্স; আবার কোনটিতে ‘লিটন ভাই’ লেখা রয়েছে।
মো. ফারুক বলেন, এক সময় তিনি নিজেই এই কারখানার প্রধান কারিগরের দায়িত্ব পালন করেছেন। এমনকি তিনি নিজেই ছোট-বড় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এগুলো পৌঁছে দিয়ে আসতেন। তিনি আরও জানান, নামিদামি কোম্পানির মালিক বা কর্তৃপক্ষ নকল মাখন ও ঘি সম্পর্কে জানেন না। মূলত ওইসব প্রতিষ্ঠানের ক্রয়কারী কর্মকর্তাকে মোটা অংকের সুবিধা দিয়ে এসব মাল ঢোকানো হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ‘ফুলকলি’ কোম্পানির এক কর্মকর্তা জানান, ২০১৯ সালের এপ্রিলে চট্টগ্রামে ‘ফুলকলি’র দুটি শাখায় এসব নকল-ভেজাল ঘি-মাখন সরবরাহ করে ধরা পড়েন লিটন। এতে তার কাছ থেকে ঘি-মাখন কেনা বন্ধ করাসহ ফুলকলি তার অর্ধ কোটি টাকার বিল আটকে দেয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে অদৃশ্য প্রভাব খাটিয়ে তিনি বেশির ভাগ টাকা উঠিয়ে নেন।
ফারুক বলেন, রাজধানীর মৌলভীবাজার থেকে বিদেশি মার্জারিনের খালি প্যাকেট কিনে এনে সেগুলোতেই নিজের তৈরি নকল মার্জারিন বাজারজাত করেন তিনি। অন্যদিকে তার ভাসানটেকের বাসার সামনে একটি কম্পিউটারের দোকান থেকে তিনি দেশি কোম্পানিগুলোর নকল মোড়ক তৈরি করে সেগুলো পৌঁছে দেন পাইকারি বাজার ও সুপার শপে। কোম্পানির শেয়ার দেওয়ার কথা বলে লিটন তার কারিগর ফারুকের কাছ থেকে প্রায় ৫ লাখ ধার নেন। এরপর টাকা চাইলে ফারুককে কারখানা থেকে তাড়িয়ে দেন এবং নানা ভয়ভীতি দেখান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে এসব কোনো ব্যবসায় লিটন নিজে সম্পৃক্ত থাকেন না। কোনটি তার ছোট ভাইয়ের নামে, কোনটি স্বজনের নামে চলছে। এসব নকল পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে তিনি কখনই কোনো স্থায়ী কারখানা স্থাপন করেননি। কখনো শনিরআখড়া (বিজ্র থেকে বামে), কখনো উত্তরা ১২নং খালপাড় এলাকায়, কখনো ভাসানটেক দেওয়ানপাড়ায় অস্থায়ী ঘর ভাড়া করেই বানানো হয় নকল ঘি।
সম্প্রতি রাজধানীর মাটিকাটার দেওয়ানপাড়ায় আটতলা ভবন নির্মাণ করেছেন লিটন। সেখানেই তিনি বসবাস করেন। তার স্থায়ী ঠিকানা মাদারীপুরের বাঁশবাড়ী ইউনিয়ন। নকল ও ভেজাল খাদ্যপণ্য উৎপাদন ও বিক্রি করে অবৈধ অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে ঢাকা ও মাদারীপুরে নামে-বেনামে আরও অনেক সম্পদের মালিক হয়েছেন বলে জানিয়েছেন তার সহযোগীরা। অনুসন্ধানে লিটনের বেশকিছু ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট নম্বর পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, লিটন এখন সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে অবস্থান করেন। এমনকি ব্যক্তিগত নিরাপত্তায় নিযুক্ত করেছেন নিরাপত্তা রক্ষী। মিরপুরে লিটনের দোকানে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। এমনকি তিনি সেখানে বসেন না বলে জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে লিটনের দুটি মোবাইল নম্বরে ফোন করা হয়। একটি নম্বরে একাধিকবার ফোন করা হলেও সেটি তিনি রিসিভ করেননি। অন্য নম্বরটিতে ফোন করলে লিটন নিজেকে একজন কেক ব্যবসায়ী হিসেবে দাবি করেন। তবে কথোপকথনের একপর্যায়ে তিনি নিজেকে লিটনের ভাগ্নে বলে পরিচয় দিয়ে বলেন, তিনি মূলত লিটনের সব ব্যবসা দেখাশোনা করেন। তারা ইন্দোনেশিয়া থেকে কাঁচামাল আমদানি করে সেগুলো দিয়ে কেক তৈরি করে বিক্রি করেন। মিরপুর সাড়ে ১১ বাসস্ট্যান্ডে তাদের ‘আহসান’স হট কেক’ নামে দোকান রয়েছে। তবে ঘি-মাখনের ব্যবসা তারা করেন না। একপর্যায়ে তিনি ফোন কেটে দেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন