রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রায় সব পণ্যের দামে আগুন লাগে। এরই মধ্যে বাজার সংশোধনে জ্বালানি তেলের দাম কিছুটা কমায় নিম্নমুখী ধারায় ফিরেছে বেশকিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দাম। তবে পড়তি দাম উঠতে কতদিন এ নিয়েই যত সংশয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ না হলে জ্বালানি পণ্যের বাজার যেমন স্থিতিশীল হবে না, নিত্যপণ্যের বাজারেও থাকবে অস্থিরতা, এমনটাই মনে করেন পণ্যবাজার বিশ্লেষকরা।
দেশীয়ভাবে সরকারি চিনিকলে উৎপাদিত আখের চিনির খুচরা দাম প্রতি কেজি সর্বোচ্চ ৮৫ টাকা বেঁধে দিয়েছে সরকার। কিন্তু বাজারের চিত্র ভিন্ন। সরেজমিনে বাজার ঘুরে দেখা গেছে, এসব চিনির প্যাকেটের গায়ে লেখা সর্বোচ্চ বিক্রয় মূল্য ১২০ টাকা। কোথাওবা সুযোগ বুঝে গ্রাহকদের কাছ থেকে এর চেয়েও বেশি দাম হাঁকাচ্ছেন দোকানিরা, যা ভোক্তাদের সঙ্গে বড় প্রতারণা।
বিশ্লেষকদের ভাষ্য, আন্তর্জাতিক বাজারে বুকিং দর কমলেও দেশীয় বাজারে চিনির দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন আমদানিকারকরা। এছাড়া দেশের কারখানায় উৎপাদিত আঁখের চিনির সরকার নির্ধারিত দামের কোনো তোয়াক্কাই করছেন না ব্যবসায়ীরা।
আখের চিনি উৎপাদন ও বাজারজাতকারী সংস্থা বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) দাবি, তাদের দিক থেকে ভোক্তারা প্রতারিত হচ্ছেন না। দাম বাড়া বা কমার ওপর তাদের কোনো হস্তক্ষেপ নেই। এ কাজটি করছে মূলত পরিবেশকরা (ডিলার)। তারা চিনিকল থেকে পাইকারি দরে খোলা চিনি কিনে সেগুলো বিএসএফআইসির চিনির হুবহু নকল মোড়কে প্যাকেটজাত করে বাজারে ছাড়ছে। যেখানে প্যাকেটের গায়ে সর্বোচ্চ বিক্রয় মূল্য (এমআরপি) প্রতি কেজি ১২০ টাকা লেখা হচ্ছে। এক্ষেত্রে এমআরপি দেখে পণ্য কিনেও প্রতারিত হচ্ছে ক্রেতারা।
সরেজমিনে রাজধানীর তালতলা মার্কেট, রামপুরা বাজারসহ বেশকিছু দোকান ঘুরে এ ধরনের প্যাকেটজাত নকল চিনি মিলেছে। তবে কিছু দোকানে বিএসএফআইসি’র বাজারজাত করা ৮৫ টাকা কেজি দামের চিনিও পাওয়া যাচ্ছে।
এ বিষয়ে বিএসএফআইসির একাধিক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে জানিয়েছেন, সুপরিকল্পিতভাবে ডিলারদের একটি চক্র এ ধরনের প্রতারণা করছে। ৮৫ টাকার চিনির প্যাকেটে ১২০ টাকা মূল্য বসিয়ে অবৈধভাবে ভোক্তাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে পরিবেশকরা।
সম্প্রতি বাড়তি দাম বসানো এমন বেশ কিছু চিনির প্যাকেট বিএসএফআইসির হাতে এসেছে। তবে এখনও কোনো ডিলার, প্রতিষ্ঠান বা সংশ্লিষ্ট কাউকে চিহ্নিত করেনি সংস্থাটি। জনবল সংকটে এ চিহ্নিতকরণের কাজ ব্যাহত হচ্ছে বলে দাবি সংস্থার কর্মকর্তাদের। যদিও বাজারে আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণকারী সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ বিষয়ে জানানো হয়েছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
বিএসএফআইসি পরিচালক (বাণিজ্যিক) আনোয়ার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ৭৫ টাকা কেজি দরে চিনি বিক্রি করছি, যা পরিবেশক ও বিক্রেতার লাভসহ সর্বোচ্চ বিক্রয় মূল্য ৮৫ টাকা। বাজারে এর চেয়ে বেশি দাম নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু ৭৫ টাকা কেজি দামে চিনি কিনে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী ইচ্ছামতো প্যাকেটের গায়ে মূল্য বসিয়ে বাজারে বিক্রি করছে। আবার এ ধরনের প্রতারণার সঙ্গে কোনো কোম্পানিও সম্পৃক্ত থাকতে পারে। এ বিষয়টি সুনির্দিষ্টভাবে আমার জানা নেই।
বিএসএফআইসির প্রধান বিপণন কর্মকর্তা মাযহার উল হক খান বলেন, কীভাবে এটি হচ্ছে তা এখনও আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। তবে এ ধরনের অভিযোগ আমাদের কাছে রয়েছে। জনবল স্বল্পতার কারণে আমরা সেটা রোধ করতে পারছি না। বিষয়টি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন বাজার তদারকি সংস্থাকে জানানো হয়েছে।
সংস্থাটির একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাগো নিউজকে জানিয়েছেন, কয়েক মাস ধরে চিনির মূল্যের ঊর্ধ্বগতির পর থেকে এ নতুন প্রতারণা শুরু হয়েছে। এটা করছে বিএসএফআইসির ডিলাররা। তারাই ৭৫ টাকায় খোলা চিনি কিনে বিএসএফআইসির হুবহু প্যাকেট নকল করে বিক্রি করছে। এটি সংস্থার সবার জানা। তবে কিছু কর্মকর্তা ডিলারদের মদত দেওয়ার কারণে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।
সাধারণ ভোক্তা পর্যায়ে আখ থেকে উৎপাদিত চিনির ব্যাপক চাহিদা থাকায় এ সুযোগ নিয়ে বাড়তি দামেও সেগুলো বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে প্যাকেটের গায়ে বাড়তি দাম লেখা থাকলেও এমআরপিতে আস্থা রেখেই চিনি কিনে প্রতারিত হচ্ছেন ক্রেতারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সারাদেশে বিএসএফআইসির পাঁচ হাজার ডিলার রয়েছে। তবে নিয়মিত চিনি ওঠান দুই হাজার ২০০ জনের মতো। তাদের বেশিরভাগই কয়েক মাসের বরাদ্দের চিনি একসঙ্গে তুলে পাইকারিতেই বিক্রি করছেন। তাদের কাছ থেকে চিনি সংগ্রহ করছে এসব সিন্ডিকেট।
একজন ডিলার প্রতি মাসে ৫০০ কেজি চিনি বরাদ্দ পাচ্ছেন। কয়েকজন ডিলারের চিনি একসঙ্গে করে সেগুলো নকল প্যাকেটজাত করে ইচ্ছামতো দাম বসিয়ে বাজারে ছাড়া হচ্ছে। তবে এ ধরনের প্রতারণার অভিযোগ অস্বীকার করছেন ডিলারদের অনেকে।
আবুল কাশেম নামের এক ডিলার বলেন, এমন কে বা কারা করছে আমার জানা নেই। আমরা যেটুকু বরাদ্দ পাই সেটা নিয়ম মেনে নির্ধারিত দামেই বিক্রি করি।
নকল প্যাকেটে বাড়তি দাম যুক্ত করা চিনি যারা বিক্রি করছেন তাদেরই একজন শফিকুজ্জামান। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, খাবার ডেলিভারি করে এমন কিছু তরুণ ও শিক্ষার্থী তাকে এ চিনি সরবরাহ করেন। তারা ডিলারদের থেকে ১০৫ টাকা দরে প্যাকেটজাত চিনি কিনে ১১০ টাকায় দোকানে বিক্রি করেন।
আখ থেকে উৎপাদিত খোলা চিনিও পাওয়া যাচ্ছে বাজারে। খুচরায়ও নির্ধারিত দাম প্রতি কেজি ৮৫ টাকা হলেও বাজারে খোলা চিনির কেজি ন্যূনতম ৯৫ টাকা। আবার কিছু দোকানি ও প্রতিষ্ঠান সেগুলো নতুন প্যাকেটে ভরে ১০০ টাকা কেজি দরেও বিক্রি করছেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন