বেশ লম্বা সময় ঊর্ধ্বমুখী থাকার পর দুই সপ্তাহ ধরে বিশ্ববাজারে কমতে শুরু করেছে নানা ধরনের ভোগ্যপণ্যের দাম। সাধারণত বিশ্ববাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়লে বাংলাদেশের বাজারেও দাম বেড়ে যায়। কিন্তু এখন নিম্নমুখী প্রবণতা শুরু হলেও তার রেশ পড়েনি দেশের বাজারে। এর কারণ হিসেবে আমদানিকারক ও ট্রেডিং পর্যায়ে সরবরাহ চেইনের দীর্ঘসূত্রতাকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।
সাধারণত পণ্যবাজারের পাইকারিতে নিয়মিত ডিও (ডেলিভারি অর্ডার) সরবরাহ করে বাজার থেকে অর্থ তুলে নেন ব্যবসায়ীরা। পণ্য আমদানির পর বিভিন্ন তারিখে ইস্যু করা ডিওগুলোর বিপরীতে মিল বা কারখানা থেকে পণ্য সরবরাহ করেন তারা। এ সময়ের মধ্যে এসব ডিও পাইকারি পর্যায়ে ট্রেডিং প্রতিষ্ঠান ও ডিও ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে বিভিন্ন হাত ঘুরে প্রকৃত ক্রেতার কাছে পৌঁছে। ততদিনে নির্ধারিত পণ্যটির দাম মূল দামের চেয়ে অনেক বেড়ে যায়।
এক বছর ধরে নিয়মিত ডিও সরবরাহ হলেও গত কয়েক সপ্তাহ পাইকারি বাজারে ডিও সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো। যার কারণে বর্তমানে বৈশ্বিক বুকিং মূল্য কমলেও বাংলাদেশে পণ্যের দামে প্রভাব পড়েনি। এছাড়া বিশ্ববাজারে দাম কমার কারণে দেশের মিল মালিকরা সরবরাহ কমিয়ে দেয়ায় ভোগ্যপণ্যের দামে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন হয়নি বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
দুই সপ্তাহ ধরে দেশের প্রধান নিত্য ভোগ্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী অবস্থায় স্থির রয়েছে। অর্থাৎ সরকারি পর্যায়ে ভোজ্যতেলের দাম নির্ধারণ করে দেয়ার পর যে দাম উঠেছে, এখনো সেই দামে বিক্রি হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভোজ্যতেল। সর্বশেষ শনিবার পাইকারি বাজারে মণপ্রতি সয়াবিন বিক্রি হয়েছে (ডিও) ৫ হাজার ৪৫০ টাকায়। তবে মিলগেট থেকে সংগ্রহযোগ্য পাম অয়েল বিক্রি হয়েছে ৫ হাজার ৪৩০ টাকায়। পাম অয়েল ডিও পর্যায়ে ৪ হাজার ৯৭০ টাকায় বিক্রি হলেও প্রস্তুত পাম অয়েল বিক্রি হয়েছে ৫ হাজার টাকায়। অন্যদিকে চিনি বিক্রি হয়েছে পাইকারিতে ২ হাজার ৬৫০ টাকায়। এছাড়া ইন্দোনেশিয়া-ভারত-রাশিয়ান গম বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ২০ থেকে ১ হাজার ৩০ টাকায় এবং মণপ্রতি কানাডিয়ান ভালোমানের গম লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ৪২০ টাকা দরে। মিলগেট থেকে সরবরাহযোগ্য ডিও নিয়ে ব্যবসায়ীরা বর্তমানে মিলগেটে গেলেও ভোজ্যতেল কিংবা গমের নির্ধারিত সময়ে সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না। যার কারণে প্রতি মণ সরাসরি সরবরাহ নেয়া ভোজ্যতেল কিংবা গম নির্ধারিত দামের চেয়েও ৫০-৬০ টাকা বেশি দামে কিনছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা।
ট্রেডিং প্রতিষ্ঠান ও দেশে ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্তমানে মিল থেকে পণ্য সংগ্রহ করতে অন্তত ২০ দিন সময় লাগছে। প্রতিটি ডিও নির্ধারিত তারিখ কিংবা নির্ধারিত তারিখের পর যেকোনো দিন মিলগেটে পৌঁছলেই মিল মালিকরা পণ্য সরবরাহ করতে বাধ্য। কিন্তু চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কম থাকা, মজুদ কমে যাওয়াসহ নানা কারণে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ডিওধারী ব্যবসায়ীদের রিপোর্ট করার সময় পণ্য সরবরাহ করে না। যার কারণে ভোজ্যতেলসহ নিত্য ভোগ্যপণ্যের ডিও দামের তুলনায় নগদে কেনা পণ্যের দাম মণপ্রতি কয়েকশ টাকা বেশি থাকে। বর্তমানে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার মিলগুলোতে পণ্য সংগ্রহ করতে ট্রাকের সারি আটকে আছে। মূলত কয়েক সপ্তাহ ধরে পাইকারি পর্যায়ে চাহিদা কমলেও মিলগেট থেকে পণ্য সরবরাহ কমিয়ে দেয়ায় বৈশ্বিক বুকিং কমে যাওয়া সত্ত্বেও ভোক্তা পর্যায়ে এর প্রভাব পড়েনি। অর্থাৎ সরবরাহ চেইনে এক ধরনের দীর্ঘসূত্রতার সৃষ্টি করা হয়েছে। যার রেশ পড়েছে গোটা বাজারের ওপর।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম নিম্নমুখী। অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কমে যাওয়ায় অন্যান্য পণ্যের দামেও এর প্রভাব পড়েছে। সর্বশেষ কার্যদিবসে মালয়েশিয়ান পাম অয়েলের দামও কমেছে। মূলত অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের ভবিষ্যৎ সরবরাহমূল্য কমে যাওয়ায় বায়োডিজেল হিসেবে আকর্ষণ হারিয়েছে পাম অয়েল। যার কারণে বিশ্বের সর্বাধিক ব্যবহূত ভোজ্যতেল পাম অয়েলের দাম দীর্ঘদিন পর নিম্নমুখী বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্ধিত দামে দেশে বিপুল পরিমাণ ভোগ্যপণ্য আমদানি হয়েছে। সর্বশেষ তিন মাসে পূর্ববর্তী বছরের একই সময়ের তুলনায় বেশি ভোগ্যপণ্য আমদানি করেছেন ব্যবসায়ীরা। বর্তমানে বৈশ্বিক দাম কমে যাওয়ায় ভোগ্যপণ্যের দাম কমানো হলে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবেন আমদানিকারকরা। যার কারণে সরবরাহ চেইনে সময়ক্ষেপণের মাধ্যমে বর্ধিত দাম ধরে রাখতে চাইছে তারা।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে আট ধরনের নিত্য ভোগ্যপণ্যের অধিকাংশই আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বেশি আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে পাম অয়েল ২০২০ সালের প্রথম প্রান্তিকে আমদানি হয়েছিল ৩ লাখ ১৬ হাজার ২৪৭ টন। কিন্তু চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে পাম অয়েল আমদানি হয়েছে ৩ লাখ ৪৪ হাজার ৮৮ টন। মসুর ডাল ২০২০ সালের প্রথম প্রান্তিকে ১ লাখ ১৭ হাজার ৬৫২ টন আমদানি হলেও চলতি বছর একই সময়ে আমদানি হয়েছে ১ লাখ ৫৭ হাজার ৪৬৯ টন। ২০২০ সালের প্রথম প্রান্তিকে ১ হাজার ৯১৭ টন চাল আমদানি হলেও এ বছর আমদানি হয়েছে ২ লাখ ৫ হাজার ৬১৯ টন, ডাবলি ডাল বা অ্যাংকর ডাল ২০২০ সালের প্রথম তিন মাসে ১ লাখ ৬ হাজার ৯৮৩ টন আমদানি হলেও এ বছর তিন মাসে আমদানি হয়েছে ১ লাখ ৬২ হাজার ৩৭৫ টন, ছোলা ১৫ হাজার ৩৫৮ টন আমদানি হলেও এ বছর আমদানি হয়েছে ৪৭ হাজার ১০৬ টন।
আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী বলেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানিসহ বেশকিছু পণ্যের দাম কমতে শুরু করলেও সেভাবে ভোগ্যপণ্যের দাম এখনো কমেনি। জ্বালানির দাম কমলে পরিবহন খরচও কমবে। তখন এর প্রভাব পড়বে আমদানি মূল্যে। এক্ষেত্রে দেশের বাজারে পণ্যের দাম কিছুটা কমে আসতে পারে। আমদানিকারকরা আগামী সপ্তাহ পর্যন্ত বিশ্ববাজারের দিকে তাকিয়ে আছেন। এ সময়ের মধ্যে দাম আরো কমলে দেশের বাজারেও এর প্রভাব পড়তে শুরু করবে।
ভোগ্যপণ্যের পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, আগের মতো পর্যাপ্ত ডিও সরবরাহ না থাকা ও মিলগেট থেকে পণ্য সরবরাহে বিলম্ব হওয়ায় পণ্যমূল্য কমছে না। আগে বিশ্ববাজারে দাম বাড়লে দেশের বাজারেও এর দ্রুত প্রভাব পড়ে। কিন্তু দুই সপ্তাহ ধরে বৈশ্বিক দাম কমলেও আমদানিকারক ব্যবসায়ীদের সরবরাহ কমিয়ে দেয়ার কারণে বাজারে নিম্নমুখী প্রভাব পড়েনি। তাছাড়া ভোগ্যপণ্যের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভোজ্যতেলের দাম সরকার নির্ধারণ করে দেয়ায় বিশ্ববাজারে দাম কমলেও দেশের বাজারে দাম কমে যাওয়ার সুযোগ কম বলে মনে করছেন তারা। – বণিক বার্তা
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন