চালের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমলেও দেশের বাজারে বেশি। গতকাল সোমবার আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন চাল বিক্রি হয় ৩৬০ থেকে ৩৮১ মার্কিন ডলারে; গত বছর এ সময়ে ছিল ৩৭৪ থেকে ৪৭৭ ডলার। এ হিসাবে এক বছরে দাম কমেছে ১৫ শতাংশ।
রাষ্ট্রায়ত্ত বিপণন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ট্রেডিং করপোরেশনের (টিসিবি) হিসাবে, বর্তমানে বাজারে সরু চাল ৫৮ থেকে ৬৮ টাকা এবং মোটা চাল ৪৬ থেকে ৫৬ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
kalerkanthoচালের সবচেয়ে বড় উৎপাদক থাইল্যান্ড, ভারত, পাকিস্তানসহ অন্যান্য দেশে সব ধরনের চালের দাম গত এক বছরে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। দেশে এ সময়ে চালভেদে দাম ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
চালে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার কথা বলা হলেও সরকারি গুদামে মজুদ বাড়ানো এবং দেশের বাজারে দাম কমাতে এখন চাল আমদানি করতে হচ্ছে। আমদানির পর দাম কমবে কি না, সে প্রশ্ন থাকছে।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) বার্ষিক পণ্য মূল্য প্রতিবেদনে দেখা যায়, করোনার কারণে গত বছর দেশে সব ধরনের চালের দাম আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে গড়ে ২০ শতাংশ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২৭ শতাংশ বেড়েছে স্বর্ণা পারিজাসহ মোটা চালের দাম। মিনিকেট ও নাজিরশাইলসহ সরু চালের দাম বেড়েছে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত।
২০১৯ সালে খুচরা বাজারে গড়ে যেখানে মিনিকেটের দাম ছিল ৫৪ টাকা কেজি, গত বছর তা ৬২ টাকায় ওঠে। নাজিরশাইলের দাম ৬০ টাকা থেকে বেড়ে ৬৯ টাকা হয়। বিআর-২৮ চালের দাম ২০১৯ সালে ছিল ৩৯ টাকা ৯০ পয়সা, গত বছর বেড়ে হয় ৪৮ টাকা ১৫ পয়সা। স্বর্ণাসহ মোটা চালের দাম ছিল ৪০ থেকে ৪৩ টাকা কেজি। গত বছর করোনার সময় এসব চালের দাম বেড়ে ৫১ থেকে ৫৪ টাকায় উঠেছিল।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সেপ্টেম্বরে দেওয়া সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি বছরের জুলাই থেকে এখন পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারিভাবে সাড়ে পাঁচ লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানি করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ঋণপত্র খোলা হয়েছে প্রায় আট লাখ টনের।
রাজধানীর পাইকারি বাজার ঘুরে দেখা যায়, চাল আমদানির কারণে বাজারে দাম কিছুটা কমে এসেছে। গতকাল কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রায় সব চালের আড়তেই বেশির ভাগ আমদানি করা চাল। আগে শুধু মোটা চাল বিক্রি হলেও এখন সরু ও মোটা সব ধরনের আমদানি করা চালই রাখছেন ব্যবসায়ীরা। খুব কম আড়তই পাওয়া গেল, যাদের ৫০ শতাংশে নিচে রয়েছে আমদানি করা চাল। এই আমদানি করা চালের পুরোটাই ভারতের। অনেকের পুরো আড়তই দখল করে রেখেছে প্লাস্টিকের ২৫ কেজি চালের প্যাকেট।
বিক্রেতারা বলছেন, ভারতীয় চাল ব্যাপকভাবে আমদানির পরই মূলত দেশের বাজারে দাম কমতে থাকে। মাস দেড়েক আগের তুলনায় চালের দাম এখন কেজিপ্রতি চার-পাঁচ টাকা কম। তবে দাম কমে আসার পরও গত বছরের এই সময়ের তুলনায় বেশি রয়েছে।
গত রবিবার বাবুবাজারসহ অন্য পাইকারি বাজারে মিনিকেট চাল বিক্রি হয়েছে ৫৩ টাকা কেজি দরে। নাজিরশাইল ৬০ টাকা কেজি, আঠাশ ৪৫ টাকা কেজি, গুটি-স্বর্ণা ৪৫ টাকা কেজি এবং দেশি কাটারিভোগ ৬৩ টাকা কেজি। এ ছাড়া দেশি বাসমতী ৬৪ টাকা এবং চিনিগুড়া ৮৬ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে।
রাজধানীর খুচরা বাজারে গতকাল মিনিকেট চাল বিক্রি হয়েছে ৫৬ থেকে ৬০ টাকা, নাজিরশাইল ৬৪ থেকে ৬৮ টাকা, আঠাশ ৪৮ থেকে ৫৫ টাকা, স্বর্ণা ও গুটি ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা এবং চিনিগুঁড়া ৯০ টাকা কেজি দরে।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের তথ্য অনুসারে বর্তমানে থাইল্যান্ডের বাজরে চাল বিক্রি হচ্ছে প্রতি টন ৩৮৯ থেকে ৩৯৫ ডলার মূল্যে। গত বছর এ সময়ে দাম ছিল ৫১৫ থেকে ৫২২ ডলার। সেই হিসাবে এক বছরে দাম কমেছে ২৪ শতাংশের কিছু বেশি। তবে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমানে চাল ৩৬০ থেকে ৩৮১ ডলার মূল্যে বিক্রি হচ্ছে, যা গত বছর একই সময়ে ছিল ৩৭৪ থেকে ৪৭৭ ডলার। সেই হিসাবে আন্তর্জাতিক বাজারে চালের মূল্য কমেছে ১৫ শতাংশ। গতকাল ভারতে প্রতি টন চাল বিক্রি হয়েছে ৩৬০ ডলারে আর থাইল্যান্ডে ৩৮১ ডলারে। এ ছাড়া ভিয়েতনামে বর্তমানে প্রতি টন চাল (আতপ) বিক্রি হচ্ছে ৪২৫ ডলারে এবং পাকিস্তানে ৩৬০ ডলারে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে সর্বশেষ গত অর্থবছরে দেশে চালের উৎপাদন হয়েছে তিন কোটি ৮৭ লাখ টন। তার আগের বছর অর্থাৎ ২০১৯-২০ সালে হয়েছিল তিন কোটি ৬৬ লাখ টন। এ ছাড়া গত বছর বিপুল পরিমাণ চাল আমদানিও করা হয়েছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের গতকালের হিসাব বলছে, গত জুলাই থেকে এখন পর্যন্ত মোট আমদানি করা হয়েছে পাঁচ লাখ ৫১ হাজার টন চাল। মোট ঋণপত্র খোলা হয়েছে সাত লাখ ৮০ হাজার টনের। সেই হিসাবে পাইপলাইনে রয়েছে আরো দুই লাখ ৩০ হাজার টন। বর্তমানে সরকারের গুদামে চাল রয়েছে ১৪ লাখ ৪৫ হাজার টন চাল। এ ছাড়া ধান রয়েছে ১৯ হাজার টন।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মাথাপিছু চাল ভোগের পরিমাণ ধরা হয়েছে ৪১৬ গ্রাম। সেই হিসাবে দেশে চালের চাহিদা দুই কোটি ৫৮ লাখ টন। ২০১৯ সালে বিবিএস ১৭ কোটি জনসংখ্যা ধরে এই হিসাব করেছে। কিন্তু উৎপাদন হচ্ছে এর চেয়ে অনেক বেশি। তার পরও দাম বেড়েছে। তাহলে এত চাল গেল কোথায়? কেন আমদানি করতে হচ্ছে? অনেকের অভিমত, সরকারের কৃষি খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা চালের উৎপাদনের যে তথ্য দেন, তার সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই। এ ছাড়া অপচয়ও হিসাব করা হয় না।
অবশ্য চালের বাজার নিয়ে কৃষি গবেষণা কাউন্সিল বলছে, চালের ব্যাপক উৎপাদনের পরও দাম বৃদ্ধির বেশ কিছু কারণ রয়েছে। এগুলো হলো কৃষক এখন ধান বিক্রির ধরন পরিবর্তন করেছে। ২০১৯ সালের আগ পর্যন্ত সব কৃষকই ধান কাটার প্রথম মাসের মধ্যে বাজারজাতযোগ্য উদ্বৃত্তের একটা বড় অংশ বিক্রি করে দিতেন। কিন্তু করোনার পর থেকে কৃষকরা তাঁদের ধান মজুদ থেকে ধীরে ধীরে বিক্রি করছেন।
এ ছাড়া ব্যবসায়ী ও মিল মালিকরা করোনা পরিস্থিতির কারণে খাদ্যঘাটতির আশঙ্কা থেকে ধানের মজুদ ধরে রেখেছেন। সরকারের মজুদ কমে যাওয়া এবং প্রয়োজনীয় বাজার হস্তক্ষেপ না থাকাও দাম বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। ক্রমবর্ধমান মৌসুমি ব্যবসায়ীর চালের বাজারে প্রবেশ, বড় মিল মালিক ও ব্যবসায়ীদের আধিপত্য এবং অসম প্রতিযোগিতাও ধান-চালের দাম বাড়িয়েছে।
চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকারের গুদামে সাড়ে ১২ লাখ টন ধান ও ২৫ লাখ টন চাল মজুদ রাখা, একটি শক্তিশালী মূল্য কমিশন গঠন করা, বড় মিল মালিকদের মজুদদারি রুখতে মজুদ নীতিমালায় পরিবর্তন আনার সুপারিশ করেছে কাউন্সিল।
কয়েক দিন আগে চালের দাম বৃদ্ধি নিয়ে জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) কান্ট্রি ইকোনমিস্ট ড. নাজনীন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, দাম বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হলো বড় কম্পানিগুলো চালের ব্যবসায় যুক্ত হওয়া। তিনি বলেন, বড় মিলগুলোতে যে পরিমাণ ধান বা চালের মজুদ থাকে তাতে চাইলেই তারা বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এ জন্য ধান ও চাল মজুদের নীতিমালায় কিছু পরিবর্তন আনতে হবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন