অনলাইন প্ল্যাটফরম ব্যবহার করে প্রতারণার মাধ্যমে অন্তত ৫৮৯ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ধামাকা শপিং নামের একটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান। চমকপ্রদ বিজ্ঞাপন ও আকর্ষণীয় ছাড়ে পণ্য বিক্রির ফাঁদ তৈরি করে প্রতিষ্ঠানটি এ অর্থ আত্মসাৎ করে। এর পর অফিস বন্ধ করে লাপাত্তা। আমাদের সময়ের অনুসন্ধান বলছে, কোম্পানিটির মূল মালিক ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর (এমডি) জসিমউদ্দিন চিশতি পাড়ি জমিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে। পালিয়েছেন পরিচালনা পর্ষদের বেশিরভাগ সদস্যও। প্রতারণার মাধ্যম হিসেবে ধামাকা শপিংয়ের নাম ব্যবহার করলেও প্রতিষ্ঠানটির নামে ছিল না কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট। প্রতিষ্ঠানটির এমডি এ কাজে ব্যবহার করেছেন ইনভেরিয়েন্ট টেলিকম বাংলাদেশ লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট। তবে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিপুল অঙ্কের টাকা লেনদেন করলেও বর্তমানে ওই অ্যাকাউন্টে আছে মাত্র ৯৩ হাজার টাকা। ব্যক্তিগত ও কোম্পানিসংশ্লিষ্ট অন্য অ্যাকাউন্টগুলোতেও টাকা নেই।
রাজধানীর মহাখালীর বীরউত্তম একে খন্দকার সড়কের একোয়া টাওয়ারে দুটি ফ্লোরে ধামাকা শপিংয়ের দৃষ্টিনন্দন অফিস। তবে কোম্পানিটির এমডি জসিমউদ্দিন চিশতি যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানোর পর থেকেই
বন্ধ রয়েছে অফিসটি। প্রথমদিকে হোম অফিসের কথা বলা হলেও বর্তমানে কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ। এমনকি বন্ধ রয়েছে কাস্টমার কেয়ার সেন্টারের ফোন নম্বরও। গতকাল ধামাকা শপিংয়ের ফেসবুক পেজে এক বিজ্ঞপ্তিতে প্রতিষ্ঠানটি জানায়, অনিবার্য কারণে কাস্টমার কেয়ারের ফোন নম্বরটিও বন্ধ করা হয়েছে। তবে শপিং প্ল্যাটফরমটির কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও প্রতিসপ্তাহেই ফেসবুক লাইভে এসে গ্রাহকদের নানারকম আশ^াস দেন কোম্পানির এমডি।
চাকরি হারানো কোম্পানিটির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমাদের সময়কে বলেন, ধামাকা শপিং অন্তত চার মাস আগেই স্থায়ীভাবে ব্যবসা বন্ধ করেছে। এখন কেবল গ্রাহকদের আশ^াস দিয়ে রাখছে, যাতে তারা টাকা ফেরত পেতে আন্দোলন না করেন। তিনি বলেন, মালিকপক্ষের দেশে তেমন কোনো বিনিয়োগ নেই। সব টাকা সরিয়ে ফেলা হয়েছে। পরিচালকরাও দেশ ছেড়েছেন।
জানতে চাইলে ধামাকা শপিংয়ের চিফ অপারেটিং অফিসার (সিওও) সিরাজুল ইসলাম রানা অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে আমাদের সময়কে বলেন, বিষয়টি নিয়ে কোম্পানির এমডি কাজ করছেন। সেলার ও কাস্টমারদের সঙ্গে জুম মিটিংয়ে কথা বলছেন।
এমডি বিদেশে চলে গেছেন, সেখান থেকে কীভাবে এ সমস্যার সমাধান করবেনÑ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেশে না থেকেও তিনি কাজ করছেন।
ধামাকার বিজনেস অ্যাকাউন্ট নেই। যে অ্যাকাউন্টে লেনদেন হয়েছে সেখানে কোনো টাকা নেই; এমন অবস্থায় কীভাবে গ্রাহকদের টাকা ফিরিয়ে দেবেনÑ এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, অ্যাকাউন্টের বিষয়গুলো আমি দেখি না। এ বিষয়ে এমডি বলতে পারবেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, শত শত কোটি টাকার ব্যবসা করলেও ধামাকা শপিংয়ের কোনো সরকারি নিবন্ধন নেই। ইনভেরিয়েন্ট টেলিকম বাংলাদেশ লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠানের সাউথ ইস্ট ব্যাংকের একটি অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে লেনদেন হতো। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সর্বশেষ জুন মাস পর্যন্ত এ অ্যাকাউন্টে লেনদেন হয়। তখন পর্যন্ত এ অ্যাকাউন্টে লেনদেনের পরিমাণ ৫৮৮ কোটি ৯১ লাখ ৫ হাজার ৮৫২ টাকা। তবে এ বিপুল পরিমাণ লেনদেন হলেও বর্তমানে অ্যাকাউন্টটিতে রয়েছে মাত্র ৯৩ হাজার ৭৩১ টাকা। এদিকে অপরাধ তদন্ত সংস্থা (সিআইডি) ধামাকা শপিংয়ের অর্থ আত্মসাৎ নিয়ে অনুসন্ধানে নেমেছে।
সিআইডি থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, ধামাকা শপিং থেকে প্রতিষ্ঠানের অর্থ ওই প্রতিষ্ঠানের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা টাকা স্থানান্তর করে আত্মসাৎ করেছেন।
ধামাকা শপিংয়ের এমডি গ্রাহকদের ফেসবুকে লাইভে যে তথ্য দিয়েছেন তাতে বলা হয়েছে, এখনো প্রতিষ্ঠানটির তিন লাখ গ্রাহক রয়েছে। এর বাইরে রয়েছে ৬ হাজার সেলার।
গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পণ্যের অর্ডার করার পর নয় মাস পেরিয়ে গেলেও গ্রাহকরা তা পাচ্ছেন না। এ ছাড়া মোটরসাইকেল, টেলিভিশন, ফ্রিজ, মাইক্রোওভেন, এসিসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ পণ্য অর্ডার করেছেন ক্রেতারা। এসব পণ্যের ক্ষেত্রে ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ ছাড়ের অফার দিয়ে গ্রাহক জোগাড় করত ধামাকা শপিং।
শফিকুল ইসলাম নামের একজন গ্রাহক আমাদের সময়কে বলেন, একটি ফ্রিজ অর্ডার করেছিলাম। যেটি ধামাকা যথাসময়েই পরিশোধ করে। এর পর একটি মোটরসাইকেলসহ আরও কিছু প্রয়োজনীয় পণ্য অর্ডার করেছিলাম। কিন্তু ছয় মাসের অধিক সময় পার হয়ে গেছে। পণ্য দিচ্ছে না। কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতেও পারছি না। কাস্টমার কেয়ারের ফোন নম্বরও কেউ ধরছে না।
রকিবুদ্দিন নাজিম নামের একজন গ্রাহক বলেন, ছোট ছোট কয়েকটি পণ্য অর্ডার করে ঠিক সময়েই ডেলিভারি পেয়েছিলাম। এর পর আত্মীয়স্বজনদের কাছে কোম্পানিটির বিশ^স্ততার কথা বললে পরিচিত অনেকেই অর্ডার করে। আমার নিজেরও প্রায় সাড়ে চার লাখ টাকার অর্ডার রয়েছে। কিন্তু দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও পণ্য বুঝিয়ে দিচ্ছে না। কোম্পানির কারও সঙ্গে যোগাযোগও করতে পারছি না।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ধামাকা শপিংয়ের লেনদেনে ইনভেরিয়েন্ট টেলিকম বাংলাদেশ লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করত। সেই অ্যাকাউন্টে বর্তমানে রয়েছে মাত্র ৯৩ হাজার টাকা। তবে কোম্পানিসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর আরও ১৪টি অ্যাকাউন্টে টাকা লেনদেন হয়েছে। অনুসন্ধান বলছে, এসব অ্যাকাউন্টেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ টাকা নেই। যদিও এসব অ্যাকাউন্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ফ্রিজ করে রেখেছে। তবে সূত্র বলছে, এসব অ্যাকাউন্টেও তেমন কোনো টাকা নেই।
কোম্পানির মালিকপক্ষের বেশিরভাগ সদস্য বিদেশে পাড়ি জমালেও এখনো গ্রাহকদের নানা প্রলোভন দেখাচ্ছেন। বিভিন্ন সময়ে ফেসবুক লাইভে এসে কোম্পানিটি আবার ফিরে আসবে এমন আশ^াস দিচ্ছেন।
আখতার হোসেন নামের একজন গ্রাহক বলেন, আমাদের সব সময় আশ^াস দেওয়া হচ্ছে। এমডিসহ কোম্পানির ঊর্ধ্বতনরা ফেসবুক লাইভে বলছেন তারা ফিরে আসবেন। তাই গ্রাহকদের পক্ষ থেকে আইনি কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু জানি না কবে টাকা ফেরত পাব।
এ বিষয়ে অপরাধ তদন্ত সংস্থা (সিআইডি) বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ূন কবির আমাদের সময়কে বলেন, অনুসন্ধান করছি। এখনো বলার মতো কিছু নেই। তবে কোম্পানির এমডিসহ অনেকেই বিদেশে চলে গেছেন। যে অ্যাকাউন্টে লেনদেন পরিচালনা করা হতো, তাতে অল্প পরিমাণ টাকা রয়েছে। পাশাপাশি কোম্পানিসংশ্লিষ্ট অন্য যেসব অ্যাকাউন্ট রয়েছে তাতেও তেমন টাকা নেই।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন