রাজধানীর বাজারে মূল্য নিয়ে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মধ্যে ভোজ্য তেলের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। এর আগে আলুর দাম নির্ধারণ করে দিয়েছিল সরকার। কিন্তু বাজারে এর কোনো প্রভাব দেখা যায়নি। সপ্তাহের ব্যবধানে চাল ও তেলের দাম আরো বেড়েছে। সপ্তাহে প্রতি কেজিতে চালের দাম বেড়েছে ২-৪ টাকা। আর তেলের দাম লিটারপ্রতি বেড়েছে ৩-৪ টাকা। দাম যেভাবে বেড়ে চলেছে এর লাগাম কোনোভাবেই টেনে ধরা যাচ্ছে না। মানা হচ্ছে না কোনো নিয়ম-নীতি।
সময়ে সময়ে সরকারি দপ্তর পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু তা কার্যকর হতে দেখা যায় না খুব একটা। ক্ষেত্রেবিশেষে এই দাম ব্যবসায়ীদের পক্ষে যায় বলে কেউ কেউ মনে করেন। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে কোনো পণ্যের দাম কমলে দেশের বাজারে তা কমানোর কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না কোনো সময়ই। সাম্প্রতিক বাজার পরিস্থিতিতে ক্রেতারা অনেকটা অসহায়। সাধারণ মানুষের প্রশ্ন বাজার আসলে নিয়ন্ত্রণ করে কারা? অনেকের অভিযোগ- ব্যবসায়ীদের স্বাস্থ্য সংরক্ষণ করতে বাজার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকারা কাজ করছেন। এ কারণে সাধারণ মানুষের স্বার্থ দেখা হচ্ছে না।
গত মঙ্গলবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিপণন ও পরিবেশক বিষয়ক জাতীয় কমিটির সভায় খুচরা বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের লিটারপ্রতি দাম ১৩৫ টাকা, খোলা সয়াবিন ১১৫ টাকা ও পাম সুপার ১০৪ টাকা নির্ধারণ করে দেয়া হয়। বোতলজাত সয়াবিনের ৫ লিটারের এক বোতলের দাম ধরা হয় ৬৩০ টাকা।
কেন দফায় দফায় বাড়ছে ভোজ্য তেলের দাম, এ প্রশ্ন ক্রেতা সাধারণের। ভোক্তাদের অভিযোগ, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেশি এমন অজুহাতে একটি চক্র কারসাজি করছে ভোজ্য তেল নিয়ে। তারা দফায় দফায় দাম বাড়াচ্ছে।
খুচরা বাজারে খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১৩০-১৩৫ টাকায়। যেখানে সরকার নির্ধারণ করে দিয়েছে ১১৫ টাকা এবং প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১৪০-১৪৫ টাকায় আর সরকার নির্ধারণ করে দিয়েছে ১৩৫ টাকা। অর্থাৎ সরকারি বেঁধে দেয়া দামের চেয়ে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে সয়াবিন তেল। গতকাল সাপ্তাহিক ছুটির দিনে রাজধানীর বাজার ঘুরে এমনটি দেখা যায়।
বাড়তি দামের বিষয়ে খুচরা বিক্রেতারা জানান, আমাদের কাছে কোনো নির্দেশনা আসেনি। সরকার নির্ধারিত সয়াবিন তেলের দাম বাজারে পেতে কমপক্ষে ১৫ দিন লাগবে।
কাওরান বাজারসহ বিভিন্ন বাজারের বিক্রেতারা জানান, দোকানে যে তেল আছে তা আগের। এর পরেও এক লিটারের বোতল ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা চাওয়া হচ্ছে। ৫ লিটারের বোতলের মোড়কে লেখা সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য (এমআরপি) ৬৫৫ থেকে ৬৮৫ টাকা।
রাষ্ট্রায়ত্ত বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাব অনুযায়ী, খুচরা বাজারে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হয়েছে ১১৬ থেকে ১২০ টাকায়, যা এক সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছিল ১১২ থেকে ১১৬ টাকায়। এক সপ্তাহে লিটারপ্রতি দাম বেড়েছে ৪ টাকা। আর ৫ লিটারের বোতলজাত তেল বিক্রি হয়েছে ৫৮০ থেকে ৬৩০ টাকায়, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ৫৭০ থেকে ৬২০ টাকা। এটা সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি।
বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলী ভুট্টো বলেন, দুই সপ্তাহ আগে পরিবেশক পর্যায়ে প্রতিমণ সয়াবিন তেলের দাম ছিল ৪ হাজার ৪২০ টাকা। এখন তা বিক্রি হয়েছে ৪ হাজার ৪৮০ টাকায়। মণপ্রতি দাম বেড়েছে ৬০ টাকা। আর দুই সপ্তাহ আগে প্রতিমণ পাম তেলের দাম ছিল ৩ হাজার ৭০০ টাকা। এখন তা বিক্রি হয় ৩ হাজার ৮৫০ টাকায়। মণপ্রতি বাড়তি ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেলের টনপ্রতি ব্যবধান মাত্র ৫০ ডলার।
উল্লেখ্য, এক মাসের ব্যবধানে খুচরা পর্যায়ে সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে ৯.৫২ শতাংশ। আর বছর ব্যবধানে এ বৃদ্ধির হার ১২.২০ শতাংশ। ৮৮ টাকা লিটার দরের সয়াবিন তেল এখন বিক্রি হচ্ছে ১৩০ টাকা পর্যন্ত। দামে এতো পার্থক্যের কোনো ব্যাখ্যা কারোর কাছে নেই।
এদিকে চালের বাজার এখনো চড়া। প্রতি কেজি নাজিরশাইল চাল ৬৬ টাকা, বর্তমানে মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৬০-৬৫ টাকায়। কাটারিভোগ ৮৫ টাকা, চিনিগুড়া পোলাও চাল ৯৫ টাকা, হাছকি নাজির ৫৫ টাকা, পোলাও চাল ১০০ টাকা, আটাশ ৫২-৫৪ টাকা, পাইজাম ৫০ টাকা, জিরা নাজির ৬৮-৭০ টাকা, কাজল লতা চাল ৫৫-৫৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বাজার নিয়ন্ত্রণে ভারত থেকে বেসরকারিভাবে চাল আমদানি করা হচ্ছে। কিন্তু খুব একটা প্রভাব পড়েনি। বাজার ঘুরে অভিযোগ মিলেছে, দাম ধরে রাখতে ভারতের চাল দেশি চালের বস্তায় ভরে বেশি দামে বিক্রি করছে মিলাররা।
কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, বরাবরই দেখা যায় ব্যবসায়ীরা রমজানে পণ্যের দাম খুব কম বাড়ায়। রমজান আসার এক-দুই মাস আগেই দাম বাড়িয়ে দেয়। তাই এখনই এ বিষয়টি নিয়ে কঠোরভাবে মনিটরিং করে দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। পাশাপাশি অযৌক্তিকভাবে দাম বাড়ালে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। অন্যথায় বরাবরের মতো অসাধুরা অতি মুনাফা লুটে নিতে ভোক্তার পকেট কাটবে। এতে ভোক্তারা মহা বিড়ম্বনা পড়বে।
এদিকে গতকাল সংবাদমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে ক্যাব কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন বলেন, নির্ধারিত মূল্য কার্যকরে মাঠ পর্যায়ে যথাযথ নজরদারিতে আন্তরিকতার ঘাটতি হলে সরকারের বেঁধে দেয়া উদ্যোগের সফলতা নিয়ে সংশয় থেকে যায়।
ভোজ্য তেল ব্যবসায়ীরা আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে দেশীয় ট্যারিফ কমিশনের আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে বর্ধিত মূল্যকে প্রকারান্তরে সরকারি স্বীকৃতি প্রদান বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ভোজ্য তেল একটি আমদানিকৃত পণ্য। ট্যারিফ কমিশনের অনুমতি ব্যতিরেকে মূল্য বাড়ানো যায় না। আর যেহেতু মোড়কে বিক্রি হয়। সে কারণে মোড়কের গায়ের চেয়ে বেশি মূল্যে বিক্রি নিষিদ্ধ। তারপরও ব্যবসায়ীরা বাড়তি মূল্যে বিক্রি করছেন। সরকারের তদারকি সংস্থাগুলো নীরব দর্শক ছিল। তাই এই দাম বেঁধে দেয়ার কারণে ভোক্তা পর্যায়ে কোনো সুফল আসবে না বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, ঊর্ধ্বমুখী চালের বাজারেও দাম বেঁধে দিয়ে, শুল্ক কমিয়ে, বিদেশ থেকে চাল আমদানি করেও কোনো ভাবেই অসাধু ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়নি। চিহ্নিত অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণে সক্ষম হননি।
বিবৃতিতে বলা হয়, আসন্ন পবিত্র রমজানে ভোজ্য তেল নিয়ে যেন কৃত্রিম সংকট তৈরি না করে, সেজন্য এখন থেকে আমদানি, বিতরণ ও ভোক্তা পর্যায়ে বিপণনে কঠোর তদারকি নিশ্চিত করতে হবে। মজুতদারি ঠেকাতে আইনের কঠোর প্রয়োগ, ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম জোরদার করতে হবে।
আপনার মতামত দিন
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন