দেশের জনপ্রিয় ফ্যাশন ও লাইফস্টাইল ব্র্যান্ড আড়ং অনলাইন শপের বিরুদ্ধে এবার ভুল পণ্য সামগ্রী পাঠানোর অভিযোগ তুলেছেন ক্রেতারা। অর্ডার করে দীর্ঘদিন অপেক্ষার পর পণ্যের ডেলিভারি মিললেও, প্যাকেট খুলে হতাশ হচ্ছেন তারা। কারণ অর্ডার করা পণ্য না পাঠিয়ে ভুল পণ্য পাঠিয়েছে আড়ং।
পরে বাধ্য হয়ে সেই পণ্য পরিবর্তনের জন্য কাস্টমার কেয়ারে বা ই-মেইলে যোগাযোগ করে পুনরায় হয়রানির শিকার হচ্ছেন ক্রেতারা। ভুল পণ্যটি আপাতত কোনোভাবেই পরিবর্তন করে দেওয়া হবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে আড়ং। তাদের পণ্য এক্সচেঞ্জ অপশনটি এখন বন্ধ রয়েছে।
যদিও লকডাউন শেষে এক মাসের মধ্যে ভুল পণ্যটি পরিবর্তন করে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে আড়ং। কিন্তু সেই আশ্বাসে সন্তুষ্ট নন ক্রেতারা। এ ছাড়া হঠাৎ করে স্টক আউটের নামে অর্ডার বাতিল করা, কাস্টমার কেয়ার থেকে কাঙ্খিত সেবা না পাওয়াসহ নানা রকমের হয়রানির অভিযোগ বেড়েই চলেছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে।
সম্প্রতি আড়ংয়ের অনলাইন শপে ক্রেতাদের নানা ভোগান্তি ও অনিয়মের চিত্র তুলে ধরে ‘গ্রাহকদের সঙ্গে “প্রতারণা”, ক্ষমা চাইলো আড়ং’ শিরোনামে আমাদের সময় অনলাইনে একটি সংবাদও প্রকাশ হয়েছিল। সেখানে এসব অভিযোগ স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির হেড অব ই-কমার্স।
সংবাদ প্রকাশের ১৫ ঘণ্টার মাথায় ক্রেতাদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছেন তারা। অনলাইনে গ্রাহকদের চাহিদামতো পণ্য সমসয়মতো ডেলিভারি দিতে ব্যর্থ হওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করে তাদের ফেসবুক পেজে একটি বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে আড়ং।
এদিকে কেবল পণ্য ডেলিভারিতেই হয়রানি নয়, এক পণ্যের অর্ডারে অন্য পণ্য সামগ্রী পাঠালেও, তা এখন ফেরত নিচ্ছে না আড়ং। লকডাউনের অজুহাতে সবকিছু সচল রাখলেও কেবল এক্সচেঞ্জ বন্ধ রেখেছে প্রতিষ্ঠানটি। ভুল পণ্য হাতে পাওয়া ক্রেতারা তাই রয়েছেন হয়রানির সর্বোচ্চ মাত্রায়।
এমন একাধিক ক্রেতার অভিযোগের তথ্য-প্রমাণ রয়েছে আমাদের সময় অনলাইনের কাছে। মাহিম মোস্তফিজ নামের এমনই হয়রানির শিকার এক ক্রেতা আমাদের সময় অনলাইনকে বলেন, ‘আমি চলতি মাসের ৭ তারিখে আড়ং অনলাইনে একটি ম্যানিব্যাগ অর্ডার করেছিলাম। এর কয়েকদিন পরে পণ্যটি ডেলিভারি পাই। কিন্তু আড়ং থেকে পাঠানো প্যাকেট খুলে আমি তো আশ্চর্য।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি যে মানিব্যাগটি অর্ডার দিয়েছিলাম সেটা তারা পাঠায়নি। পাঠিয়েছে ভিন্ন কালারের নিম্ন কোয়ালিটির অন্য একটি মানিব্যাগ। এরপর আমি কাস্টমার কেয়ারে যোগাযোগ করি। তারা আমাকে জানায়, মানিব্যাগটি এখন এক্সচেঞ্জ করে দেওয়া সম্ভব নয়। তাদের পণ্য এক্সচেঞ্জ বন্ধ আছে। করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট লকডাউন শেষ হলে এক মাসের মধ্যে তাদের শো-রুমে গিয়ে চেঞ্জ করে নিতে হবে।’
অন্য একটি পণ্যও অর্ডার ছিল সেটাও পাননি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘মানিব্যাগের তো যা-তা অবস্থা। একই দিন আমি আরও একটি পণ্য অর্ডার করেছিলাম। তারা মেসেজ পাঠিয়ে জানিয়েছিল ৩/৪ দিনের মধ্যেই পেয়ে যাব। কিন্তু এখনো সেটা হাতে পাইনি। কবে পাব, সেটাও জানি না।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক ক্রেতা আমাদের সময় অনলাইনের কাছে একই ধরনের অভিযোগ করেছেন। ওই ক্রেতা বলেন, ‘আমি একটি পণ্য অর্ডার করেছিলাম। সেটা ১০ দিন পরে হাতে পেয়েছি। তবুও ভালো পেয়েছি। কিন্তু প্যাকেট খুলে দেখি তারা অন্য ধরনের একটি পণ্য পাঠিয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘পরে যোগাযোগ করায় তারা সাময়িক অসুবিধার জন্য ভুল স্বীকার করেছে। এরপর লকডাউন শেষে যেকোনো শো-রুমে যোগাযোগ করে তা বদলে নিতে বলেছে। অল্প দামের জিনিস তাই বেশি আগ্রহ নেই। তবে এমন হয়রানিও মেনে নেওয়া যায় না।’
‘ফেসবুক পেজ যেন অভিযোগের পাহাড়’
আড়ংয়ে পণ্য কিনে হয়রানির শিকার হওয়া ক্রেতারা ই-মেইল এবং কাস্টমার কেয়ারে যোগাযোগ করে ব্যর্থ হয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন প্রতিষ্ঠানটির ফেসবুক পেজে।
আড়ংয়ের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে দেওয়া পোস্টগুলোর কমেন্টে হয়রানির শিকার অনেক ক্রেতা তাদের সমস্যাগুলো তুলে ধরেছেন।
আসাদ জুয়েল নামের এক ক্রেতা লিখেছেন, তিনি তার শিশুর জন্য সাতটি ড্রেস কিনেছেন। এরমধ্যে দুটি ড্রেসের সাইজ হচ্ছে না। তাই তিনি ড্রেস দুটি এক্সচেঞ্জ করতে চান।
অপর এক ক্রেতা লিখেছেন, ‘একে সময়মতো ডেলিভারি দিচ্ছেন না। এরপর আবার ভুল প্রোডাক্ট ডেলিভারি পেলাম। অভিযোগ জানালে বলে এখন সম্ভব নয় এক্সচেঞ্জ। অন্য একটি অর্ডারের খোঁজ পাচ্ছি না। অসাধারণ সার্ভিস আড়ংয়ের।’
তাসনিম নামের এক নারী ক্রেতা লিখেছেন, ‘কাস্টমার সার্ভিস কোন পর্যায়ে চলে গেছে কী বলবো। অ্যাপ দিয়ে অর্ডার করেছিলাম ১০ তারিখ। তারপর থেকে মেসেঞ্জারে হাজার খানেক নক দিয়েছি, কাস্টমার সার্ভিসের ফোন নম্বরে ২৪ ঘণ্টা ট্রাই করছি...যদি কাস্টমার সার্ভিস, মেসেঞ্জারে রিপ্লাই না দেয় তাহলে এই জিনিস রাখবে কেন?’
এমন শত শত ভুক্তভোগী ক্রেতা আড়ংয়ের ফেসবুক পেজে তাদের সমস্যাগুলোর কথা জানিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
ভোক্তা অধিকার আইনে যা বলা আছে
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের ৪৫ ধারায় বলা আছে, প্রদত্ত মূল্যের বিনিময়ে প্রতিশ্রুত পণ্য বা সেবা যথাযথভাবে বিক্রয় বা সরবরাহ না করা হলে অনূর্ধ্ব এক বছর সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের ৫৩ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো সেবাপ্রদানকারী কর্তৃক অবহেলা, দায়িত্বহীনতা বা অসতর্কতা দ্বরা সেবাগ্রহীতার অর্থ বা স্বাস্থ্যহানি ঘটানো হলে অনূর্ধ্ব তিন বছর সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা অনধিক দুই লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ডের শাস্তি হতে পারে।
অভিযোগ প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. আবদুল জব্বার আমাদের সময় অনলাইনকে বলেন, ‘এমন ধরনের ক্রেতা হয়রানি বা প্রতারণার শিকার হলে অভিযোগ দায়ের করতে পারেন। তদন্তে অভিযোগটি প্রমাণিত হলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
ই-ক্যাবের বক্তব্য
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াহেদ তমাল আমাদের সময় অনলাইনকে বলেন, ‘আমাদের কাছে লিখিতভাবে কেউ এখনো অভিযোগ করেনি। যদি কেউ অভিযোগ দায়ের করে তবে অবশ্যই যাচাই-বাছাই করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা অনলাইন শপগুলোকে কিছু নিদের্শনা দিচ্ছি। তারা যতদিনের মধ্যে অর্ডার করা পণ্য ডেলিভারি দিতে পারবে, ততদিন সময়ের কথা যেন ক্রেতাকে বলে দেয়। তাহলে ক্রেতারা এমন হয়রানির শিকার হবে না। আর এখন যেসব পণ্য তারা অর্ডার নিচ্ছে সেগুলো ঈদের আগেই ডেলিভারি যেন দিতে পারে। যদি ঈদের আগে সময়মতো ডেলিভারি দিতে না পারে তাহলে যেন সেই পরিমাণ অর্ডার না নেয়।’
তারপরও কোনো ক্রেতা হয়রানি বা প্রতারিত হলে ভোক্তা অধিকারে বা তাদের কাছে অভিযোগ দিতে পারেন বলেও জানান আবদুল ওয়াহেদ তমাল।
আড়ংয়ের বক্তব্য
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে পণ্য পরিবর্তন বন্ধ রাখার বিষয়টি স্বীকার করে আড়ংয়ের চিফ অপারেটিং অফিসার আশরাফুল আলম আমাদের সময় অনলাইনকে বলেন, ‘হ্যাঁ, এক্সচেঞ্জ বন্ধ রয়েছে। তাই এখন এক্সচেঞ্জ করার সুযোগ নেই। দেশের পরিস্থিতি ভালো হলে তখন পণ্যটা পরিবর্তন করে নিতে পারবে। তবে এক মাসের মতো একটা সময় দেওয়া থাকবে। আমাদের এখনকার যে এক্সচেঞ্জ পলিসিটা আছে সেটা তখন প্রযোজ্য হবে।’
আপনারা যেসব ক্রেতার কাছে ভুল পণ্য ডেলিভারি করেছেন তারাও হয়রানির শিকার হচ্ছেন এই দায় কার? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আসলে আমরা (এক্সচেঞ্জ) করছি না শুধুমাত্র ক্রেতাদের কথা চিন্তা করেই। সমস্যাটা হলো- এটা আমাদের জন্যও রিস্ক হয়ে যায়। কারণ যে পণ্যটা কোনো ক্রেতার কাছে গেছে সেই ক্রেতা বা তার পরিবারের সদস্যদের কারও করোনা হয়েছে কি না। সেটা আবার ফিরে এসে অন্য কারও কাছে যায় কি না। এসব কিছুই তো ঝুঁকিপূর্ণ।’
পণ্য ডেলিভারিতে সমস্যা হচ্ছে স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘আসলে আমাদের প্রস্তুতির একটা ব্যাপার ছিল। এত বেশি পণ্যের অর্ডার অনলাইনে আসবে সেটা আমরা ভাবতে পারিনি। এ জন্য কিন্তু আমরা অনলাইনে অর্ডার নেওয়া বন্ধ করেছি।’
খুব দ্রুতই সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে জানিতে আড়ংয়ের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা সব সেকশনে আমাদের অতিরিক্ত জনবল বাড়িয়েছি। যাতে ঈদের আগেই সবার অর্ডারগুলো পৌঁছে দিতে পারি। একই সাথে ক্রেতা যারা আছেন সবার সাথে নিয়মিত কথা বলে যাচ্ছি। অনেক পণ্য আসলে স্টকে নেই কিন্তু অর্ডার করেছেন সেগুলোও কখন কীভাবে ডেলিভারি দেওয়া যায় এসব বিষয়ে কথা বলছি। এতে ক্রেতাসহ সকলেই আমাদের সহযোগিতা করে যাচ্ছেন।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন