হলমার্কের জন্য ব্যাপকভাবে আলোচিত সোনালী ব্যাংকের নাম। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের যোগসাজশে নামে-বেনামে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে হলমার্ক গ্রুপ। এ ছাড়া কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কর্তাদের পকেটে হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে দিয়েছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকটি। নাম সোনালী হলেও দুর্নীতি-জালিয়াতি, খেলাপি ঋণ এবং মূলধন ঘাটতির মতো নেতিবাচক অবস্থার কারণে ব্যাংকটির বর্তমান ও ভবিষ্যৎ অনেকটাই ধূসর।
সোনালী ব্যাংক সূত্র জানায়, গত বছর শেষে ব্যাংকটির সংগৃহীত আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১১ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা। আগের বছর ছিল ১ লাখ ৪ হাজার ১০৯ কোটি টাকা। আমানত সংগ্রহ বেড়েছে মাত্র ৭ শতাংশের কিছু বেশি। সংগৃহীত আমানতের মধ্যে মাত্র ৪৪ শতাংশ ঋণ হিসেবে বিতরণ করেছে। বাকি অর্থ দুর্বল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে রেখেছে। সেই অর্থ ঠিকমতো আদায় করতে পারছে না। ফার্স্ট ফাইন্যান্স, পিপলস লিজিং, বিআইএফসি, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, এফএএস ফাইন্যান্সের মতো বন্ধপ্রায় প্রতিষ্ঠানের কাছে অর্থ রেখে তা আদায় করতে পারছে না।
ব্যাংকটির গত বছর শেষে ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৮ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা। আগের বছর ছিল ৪০ হাজার ১৫৪ কোটি টাকা। বিতরণ করা ঋণের মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ২১ দশমিক ৬৩ শতাংশ বা ১০ হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা। আগের বছরের তুলনায় খেলাপি ঋণ কমেছে ব্যাংকটির। ২০১৮ সালে বিতরণ করা ঋণের ৩০ দশমিক ৩৫ শতাংশ বা ১২ হাজার ১৮৮ কোটি টাকা খেলাপি
ছিল। এই খেলাপি কমাতে সোনালী ব্যাংকের নিজস্ব কোনো তৎপরতা ছিল না। সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গণছাড়ের আওতায় খেলাপিদের ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে। গত বছর পুনঃতফসিল করা হয় ১ হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা। অথচ নগদ আদায় হয়েছে মাত্র ৮২০ কোটি টাকা। আগের বছর যা ছিল ১ হাজার ৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ খেলাপিদের কাছ থেকে নগদ আদায় কমে গেছে ব্যাংকটির।
খাতাকলমে যে পরিমাণ খেলাপি ঋণ দেখানো হচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ অনেক বেশি। অবলোপন করা ৭ হাজার ৪৯ কোটি ও পুনঃতফসিল করা ঋণ যোগ করলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৭ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা। এর বাইরে মোট ১৮ হাজার ৯০০টি মামলায় ২৮ হাজার ৭০৬ কোটি টাকা রয়েছে।
সোনালী ব্যাংক জিম্মি হয়ে পড়েছে শীর্ষ খেলাপি ও ঋণগ্রহীতাদের কাছে। ব্যাংকটির ১০ হাজার ৫৬৭ কোটি টাকা খেলাপি ঋণের মধ্যে ৩ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা রয়েছে শীর্ষ ২০ খেলাপির পকেটে। মোট খেলাপি ঋণের মধ্যে ৩১ শতাংশ গেছে ২০ জনের পকেটে। নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়েও শীর্ষদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করতে পারছে না। গত বছর শীর্ষ খেলাপিদের কাছ থেকে মাত্র ৩১ কোটি টাকা আদায় করতে পেরেছে। আগের বছর আদায় করে ১২০ কোটি টাকা। শীর্ষদের কাছ থেকে আদায় চার ভাগে নেমে এসেছে।
নিয়মনীতি না মেনে ঝুঁকিপূর্ণ খাতে ঋণ বিতরণ করায় এ ব্যাংকের মূলধন ও প্রভিশন ঘাটতি ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। গত বছর শেষে ৬১ হাজার ২৪৯ কোটি টাকার ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে ব্যাংকটির ৬ হাজার ১২৫ কোটি টাকা মূলধন সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু ব্যাংকটি তা করতে ব্যর্থ হওয়ায় মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৯২২ কোটি টাকা। আগের বছর ৫৩ কোটি টাকা মূলধন উদ্বৃত্ত ছিল। খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে ৭১৭ কোটি টাকা। মূলধন ও প্রভিশন ঘাটতি থাকার অর্থ ব্যাংকটির আর্থিক স্বাস্থ্য ও জনগণের আমানত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
আগের বছর বড় একটি ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানের ঋণ পুনঃতফসিল হওয়ায় ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা ২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। গত বছর পরিচালন মুনাফা কমে হয়েছে ১ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা। প্রভিশন ও করপরবর্তী প্রকৃত মুনাফা দাঁড়িয়েছে ২৭১ কোটি টাকা। আগের বছর ছিল ২২৬ কোটি টাকা।
ব্যাংকটির দুর্বল সূচকগুলোর ব্যাখ্যায় সম্প্রতি ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আতাউর রহমান প্রধান বলেন, সরকারি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি নিয়ে বিভিন্ন কথা হয়। মনে রাখতে হবেÑ এ দেশের শিল্পায়ন, কৃষির উন্নয়নে এ ব্যাংকগুলো মূল ভূমিকা রেখেছে। ’৮০-এর দশকে যারা সরকারি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে শিল্প উদ্যোক্তা হয়েছিলেন, তারাই আজ বেসরকারি ব্যাংকের মালিক। এর মধ্যে অনেকে খেলাপি হয়ে ব্যাংকের বোঝা বাড়িয়েছে। এর পরও এ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে মূল ভূমিকা সরকারি ব্যাংকগুলোর।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন