অব্যাহত দরপতনের কবলে দেশের শেয়ারবাজার। ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক প্রায় চার বছর পর সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমে গেছে। একের পর এক প্রতিষ্ঠানের দরপতনে প্রতিনিয়ত পুঁজি হারাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। ফলে বেড়েই চলছে বিনিয়োগকারীদের হাহাকার।
গত এক মাস লেনদেন হওয়া ১৯ কার্যদিবসের মধ্যে একদিনও ডিএসইর মোট লেনদেন ৪০০ কোটি টাকার ঘর স্পর্শ করতে পারেনি
অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, পুঁজি হারা বিনিয়োগকারীরা তাদের বিনিয়োগ করা পুঁজি রক্ষার কোনো উপায় পাচ্ছেন না। এতে নীরবে তাদের রক্তক্ষরণ বেড়েই চলছে। পতনের ধাক্কায় মানসিকভাবেও ভেঙে পড়েছেন অনেক বিনিয়োগকারী। অনেকে রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারছেন না। সংসার জীবনেও অশান্তি দেখা দিয়েছে কারও কারও।
অথচ শেয়ারবাজারের এ পতন ঠেকাতে প্রায় এক বছর ধরে চেষ্টা করছে সরকার। পুঁজি হারা বিনিয়োগকারীদের আর্তনাদ আর সংশ্লিষ্টদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে পুঁজিবাজারের জন্য নেয়া হয় একগুচ্ছ পদক্ষেপ। কিন্তু কোনো পদক্ষেপই বাজারের পতন ঠেকাতে পারছে না। যে কারণে অনেক বিনিয়োগকারীর কাছে এখন পুঁজিবাজার আতঙ্কের জায়গায় পরিণত হয়েছে।
বাজার পর্যালোচনায় দেখা যায়, মঙ্গলবার দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) লেনদেনে অংশ নেয়া মাত্র ৪২টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট দাম বাড়ার তালিকায় নাম লিখিয়েছে। বিপরীতে দাম কমেছে ২৬৯টির। ৪৩টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। এতে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স আগের দিনের তুলনায় ৫০ পয়েন্ট কমে ৪ হাজার ২৮১ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। এর মাধ্যমে টানা তিন দিনের বড় পতনে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক কমেছে ১৫০ পয়েন্টের ওপর। এতে ২০১৬ সালের ১৫ মে’র পর সূচকটি সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমে গেছে।
প্রধান মূল্যসূচকের সঙ্গে প্রতিনিয়ত বড় পতন হচ্ছে অপর দুই সূচকের। এর মধ্যে মঙ্গলবার ডিএসই শরিয়াহ্ সূচক ১০ পয়েন্ট কমে ৯৭২ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। এতে সূচকটি প্রায় শুরুর অবস্থানে ফিরে গেছে। ২০১৪ সালের ২০ জানুয়ারি চালু হওয়া এ সূচক শুরুতে ছিল ৯৪১ পয়েন্টে।
কিন্তু এ অবস্থা আর কতদিন যাবে? কখন কার চাকরি যায়, সবাই সেই আতঙ্কে আছেন
২০১৩ সালের ২৭ জানুয়ারি বাছাই করা ভালো ৩০টি কোম্পানি নিয়ে যাত্রা শুরু করে ডিএসই-৩০ সূচক। ভালো কোম্পানি নিয়ে গঠিত এ সূচকটিরও এখন করুণদশা। মঙ্গলবার ১৫ পয়েন্ট পতনের মাধ্যমে সূচকটি ১ হাজার ৪৩৬ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। এর মাধ্যমে সূচকটি শুরুর থেকেও নিচে নেমে গেছে। ২০১৩ সালে শুরুর সময় সূচকটি ছিল ১ হাজার ৪৬০ পয়েন্টে।
শেয়ারবাজারের এ পতনের বিষয়ে বিনিয়োগকারী মিলন বলেন, অব্যাহত পতনের কবলে পড়ে প্রতিদিন নিঃস্ব হচ্ছি। শেয়ারবাজার থেকে টাকা তুলে নিয়ে বের হয়ে যাব, তাও পারছি না। বিনিয়োগ করা অর্থ হারিয়ে রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারছি না। ছেলের স্কুলে ভর্তি করার টাকা জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছি। সংসারে খালি নেই নেই অবস্থা। এতে এক ধরনের মানসিক অশান্তির মধ্যেও আছি। কবে এ অশান্তি থেকে মুক্তি পাব, কিছুই জানি না।
বদরুল আলম নামের আরেক বিনিয়োগকারী বলেন, শেয়ারবাজারের দিকে তাকালেই মন খারাপ হয়ে যায়। প্রতিদিন পতন আর পতন। আগে সকাল-দুপুর সবসময় শেয়ারবাজারের খোঁজ নিতাম। এখন আর বাজারের তেমন খোঁজ নেই না। যে টাকা বিনিয়োগ করা আছে, তা পড়ে থাক। বাজার ভালো হলে তারপর নতুন করে বিনিয়োগ করা যায় কি না, চিন্তা করে দেখব।
শেয়ারবাজারের দিকে তাকালেই মন খারাপ হয়ে যায়। প্রতিদিন পতন আর পতন। আগে সকাল-দুপুর সবসময় শেয়ারবাজারের খোঁজ নিতাম। এখন আর বাজারের তেমন খোঁজ নেই না
এদিকে দরপতনের সঙ্গে বাজারে দেখা দিয়েছে লেনদেন খরা। গত এক মাস লেনদেন হওয়া ১৯ কার্যদিবসের মধ্যে একদিনও ডিএসইর মোট লেনদেন ৪০০ কোটি টাকার ঘর স্পর্শ করতে পারেনি। বাজারটিতে লেনদেনের পরিমাণ ২০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার ঘরে আটকে আছে। মঙ্গলবার লেনদেন হয়েছে ৩২৭ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। এর আগের কার্যদিবসে লেনদেন হয় ৩৭৫ কোটি ৮১ লাখ টাকা। সে হিসাবে লেনদেন কমেছে ৪৮ কোটি ৩৫ লাখ টাকা।
শেয়ারবাজারের এই অব্যাহত দরপতন আর লেনদেন খরার কারণে চাকরি হারানোর শঙ্কায় ভুগছেন অনেক ব্রোকারেজ হাউজের কর্মকর্তারা। একটি ব্রোকারেজ হাউজের কর্মকর্তা আলী হোসেন বলেন, আমাদের মালিক খুব ভালো। নিজে লোকসান গুনলেও লোক ছাটাই করেননি। কিন্তু এ অবস্থা আর কতদিন যাবে? কখন কার চাকরি যায়, সবাই সেই আতঙ্কে আছেন।
ডিএসইর মতো করুণদশা বিরাজ করছে অপর শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জেও (সিএসই)। বাজারটির সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ২২৩ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ১০ পয়েন্টে। লেনদেন হয়েছে ১৪ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। লেনদেন অংশ নেয়া ২৪৮ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দাম বেড়েছে ৪১টির, কমেছে ১৮৬টির ও অপরিবর্তিত রয়েছে ২১টির।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন