আর্তনাদেই কেটেছে শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের। বছরজুড়েই পতনের ধারা থেকে বের হতে পারেনি স্টক এক্সচেঞ্জ। ফলে এক বছরের ব্যবধানে পতনের রেকর্ড গড়েছে পুঁজিবাজার। সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাজার গতিশীল করতে দৌড়ঝাঁপ করলেও কোনো ফল আসেনি। দৈনিক গড় লেনদেনের পরিমাণ ২০০ কোটি টাকার ঘরে নেমে এসেছে। শুধু গত ৭ মাসেই ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বাজারমূলধন কমে গেছে ৬৫ হাজার কোটি টাকা। ফলে বেশির ভাগ বিনিয়োগকারী পুঁজি হারিয়ে পথে বসেছে। পুঁজি হারিয়ে অধিকাংশ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী মতিঝিলে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছেন।
বাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক। কোনো বিনিয়োগকারীই পুঁজি নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারছেন না। নতুন করে বিনিয়োগ তো আসছেই না, উল্টো অনেকে বড় লোকসান দিয়ে সমুদয় শেয়ার বিক্রি করছেন। তাদের মতে, ২০১৯ সাল ছিল পুঁজিবাজারের জন্য বেদনার। আস্থাহীনতায় টালমাটাল ছিল বাজার। দেশের শেয়ারবাজারে এখন লেনদেন হওয়া মানেই আবার দরপতন। সূচক কত বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন, দরপতন কত বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ, এসব তথ্য খুঁজে বের করতে হয় প্রতিনিয়ত। পতনে পর্যুদস্ত বাজারে মূলধন হারিয়ে পুঁজিবাজার ছেড়েছে বিনিয়োগকারীরা। এদিকে লাগাতার দরপতন ঠেকাতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি, বিভিন্ন প্রভাবশালী সংস্থা, ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংককে চাপ দিয়ে শেয়ার বিক্রি বন্ধে বহু চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু তাতেও কোনো ফল হয়নি।
জানা গেছে, চলতি বছরের শুরুতে ব্যাংকগুলোকে বিনিয়োগে ফেরাতে তাদের শেয়ারবাজার এক্সপোজার সীমা সংশোধন করে সুযোগ দেয়া হলেও তারা বিনিয়োগে আসেনি। আনার চেষ্টাও দেখা যায়নি। ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের আর্থিক প্রণোদনা হিসেবে দেয়া সরকারের ৯০০ কোটি টাকা কমিশনের অব্যবস্থাপনার কারণে কাজে আসেনি। কেউ ওই ঋণ নিতে আগ্রহী ছিল না। সমপ্রতি ওই তহবিলের প্রায় ৭৬১ কোটি টাকা আইসিবিকে দেয়া হলেও এর ফল বাজারে নেই।
ডিএসই সূত্রে জানা গেছে, গত ২৭ জানুয়ারি বাজার সূচকটি ৫৯৯২ পয়েন্টে ওঠার পর যে পতন শুরু হয়েছে, তা এখন চলমান। সেই সূচকই রোববার নেমে এসেছে ৪ হাজার ৪৩৪ পয়েন্টে। ডিএসই প্রধান সূচক প্রায় ৯ মাসে কমেছে ১ হাজার ২০০ পয়েন্ট। একই সময়ের ব্যবধানে বাজার মূলধন বা শেয়ারের বাজারমূল্য কমেছে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা। ৯ মাসে সূচক কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ আর বাজার মূলধন কমেছে ১৪ শতাংশের বেশি। এছাড়া শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ৩১৯ কোম্পানির মধ্যে ৪৬টি বা প্রায় সাড়ে ১৪ শতাংশ কোম্পানির শেয়ারের দাম এখন ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের নিচে নেমে এসেছে। কারণ বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা নেই। সূচক যেমন তলানিতে, আস্থাও তলানিতে।
ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা রীতিমতো আতঙ্কিত। মুনাফার স্বপ্ন তো দূরে থাক, লসেই শেয়ার বিক্রি করছেন। কারণ অনেকের আশঙ্কা, লসের পরিমাণ আরো বাড়তে পারে। যারা ঋণ করে শেয়ার কিনেছেন, তাদের অবস্থা আরো খারাপ। রাস্তায় নেমে বিনিয়োগকারীরা উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি) দায়ী করছেন। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সংগঠনগুলোর দাবি, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাজারের দরপতন ঠেকাতে ব্যর্থ। এ অবস্থায় বিনিয়োগকারীরা বিক্ষোভ করেছেন। সমপ্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর স্মারকলিপিও দিয়েছেন তারা।
এদিকে, মন্দা পুঁজিবাজার চাঙ্গা করতে একসঙ্গে কাজ করার ঘোষণা দিয়েছে ডিবিএ এবং বিএমবিএ। এ লক্ষ্যে দুই সংগঠনের পক্ষ থেকে ১২ সদস্যের একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। এখন দেখার বিষয় বাজারের উত্থান হয় কিনা।
উল্লেখ্য, পুঁজিবাজারকে ইতিবাচক ধারায় ফেরাতে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বৈঠক করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। সভা শেষে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, দেশের অর্থনীতির মতো পুঁজিবাজারকেও একইরকম গতিশীল দেখতে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু এর পরও বাজারে গতি ফেরেনি। বাড়েনি লেনদেন ও সূচক।
বাজার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ডিএসইর সঙ্গে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সব সূচক কমেছে। একই সঙ্গে কমেছে লেনদেনে অংশ নেয়া বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট দর। তবে গতকাল প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) এবং অপর শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) মূল্য সূচকের ঊর্ধ্বমুখিতার দেখা মিলেছে। এর মাধ্যমে টানা দুই কার্যদিবস ঊর্ধ্বমুখী থাকল শেয়ারবাজার। এদিন ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক ডিএসইএক্স আগের দিনের তুলনায় ১৫ পয়েন্ট বেড়ে ৪ হাজার ৪৩৪ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। সূচক বাড়লেও ডিএসইতে কমেছে লেনদেনের পরিমাণ। দিনভর ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে ৩০০ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। আগের কার্যদিবসে লেনদেন হয় ৩০৫ কোটি ৬ লাখ টাকা। সে হিসাবে লেনদেন কমেছে ৪ কোটি ২৯ লাখ টাকা। অপর শেয়ারবাজার সিএসইর সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ২৩ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ৪৮৭ পয়েন্টে। বাজারটিতে লেনদেন হয়েছে ২৬ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। লেনদেন অংশ নেয়া ২৩২ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দাম বেড়েছে ১০৯টির, কমেছে ৮৫টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ৩৮টির।
বিনিয়োগকারী আতিক বলেন, শেয়ারবাজারে টাকা বিনিয়োগ মানেই লোকসান। দীর্ঘদিনের বিনিয়োগে লোকসান কমাতে দ্বিগুণ বিনিয়োগ করে সমন্বয়ের পরও কমছে না লোকসানের পাল্লা। গত দেড় মাস আগে ২০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে এখন ১৬ লাখ টাকায় নেমেছে। আগের লোকসান তো আছেই।
ডিএসই মুনাফা কমেছে: ডিএসই ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মুনাফা কমেছে। এফডিআর থেকে সুদ নির্ভর আয়ের ডিএসই গত চার অর্থবছরে ধরে মুনাফায় নিম্নমুখী ধারায় রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় এবারও স্টক এক্সচেঞ্জটির পর্ষদ ৫ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদের সভায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরের আর্থিক হিসাব অনুমোদন ও লভ্যাংশ ঘোষণা করা হয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের মতে, ব্যাংকিং খাত ঠিক না হলে শেয়ারবাজার ঠিক হবে না। দেশের অর্থনীতির স্বার্থে, পুঁজিবাজারের স্বার্থে ব্যাংকিং খাতের সুশাসন ফিরিয়ে আনতে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। দিন যত যাচ্ছে পুঁজিবাজার নিয়ে বিনিয়োগকারীদের হতাশা ততই বাড়ছে।
অন্যদিকে শেয়ারবাজারে লেনদেন কমে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন খোদ স্টক ব্রোকার মালিকরা। ডিএসই শীর্ষ এক ব্রোকার জানালেন, শেয়ারবাজারের মন্দায় লোকসানে চলছে প্রতিটি দিন। লেনদেন কমে যাওয়ায় রিজার্ভ থেকে গত কয়েক মাসে বেতন-ভাতা এবং নিয়মিত ব্যয় করেছেন। এখন রিজার্ভ শেষ। ফলে কর্মকর্তা-কর্মচারী চারভাগের এক ভাগে নামিয়ে এনেছেন।
ডিএসই পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, পরিস্থিতি ভালো না। অনেক ব্রোকারেজ হাউস বন্ধ হওয়ার উপক্রম।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, মূল সমস্যা সুশাসনের অভাব এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নেই।
আইপিও: গত ১১ বছরের মধ্যে ২০১৯ সালে পুঁজিবাজার থেকে সবচেয়ে কম মূলধন উত্তোলন করা হয়েছে। এ বছর পুঁজিবাজার থেকে ৫১৪ কোটি ৬৭ লাখ টাকা মূলধন সংগ্রহ করেছেন শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা। ২০১৮ সালে মূলধন উত্তোলন করা হয় ৬০১ কোটি, ২০১৭ সালে ১ হাজার ৪৪২ কোটি, ২০১৬ সালে ৯৫০ কোটি, ২০১৫ সালে ৬৭৫ কোটি ও ২০১৪ সালে ৩ হাজার ২৬৩ কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়।
বিও হিসাব: অনেকে বেনেফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) হিসাব বন্ধ করে বাজার ছেড়েছেন। গত এক বছরের হিসাবে পুঁজিবাজার থেকে বিও কমেছে ২ লাখ ৬০৭টি।
বিদেশি বিনিয়োগ: ২০১৯ সালে পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগে পিছুটান ছিল। বিদেশিরা শেয়ার কেনার চেয়ে বেশি পরিমাণে বিক্রি করেছে।
সম্প্রতি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান ড. এম খায়রুল হোসেন বলেছেন, পুঁজিবাজার পতন হয়েছে তিনটি কারণে। আর গত দুই মাসে যে পরিমাণে সূচক কমেছে তার কারণ হচ্ছে বিদেশিদের বিক্রয় এবং গ্রামীণ ফোনের ইস্যু। আরেকটা বিষয় টাকার ডিভ্যালুয়েশন। ক্যাপিটাল মার্কেট জার্নালিস্টস ফোরামের (সিএমজেএফ) কার্যালয় ও ওয়েবসাইট উদ্বোধন তিনি এ কথা বলেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন