আইনি লড়াইয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অনীহার কারণে প্রভাবশালী শীর্ষ ঋণখেলাপিরা পার পেয়ে যাচ্ছেন।
আইনের ফাঁকফোকর ব্যবহার করে খেলাপিরা তালিকার বাইরে চলে এলেও বিশেষ যোগসাজশ থাকায় ব্যাংকগুলো হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকে।
সুযোগ থাকলেও পাল্টা শক্ত আইনি ব্যবস্থা নেয় না। ফলে যা হওয়ার তাই হয়। খেলাপি ঋণের টাকা পরিশোধ ছাড়াই তারা নিয়মিত গ্রাহক হিসেবে পুনরায় জায়গা করে নেন এবং প্রভাব খাটিয়ে ফের ঋণ নিতেও সক্ষম হন।
বাস্তবে খেলাপি হওয়া সত্ত্বেও কেউ কেউ সংসদ নির্বাচন করার সুযোগও পান। নির্ভরযোগ্য সূত্রে প্রাথমিকভাবে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে এ পন্থায় ৩০ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার হিসাব মিলেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, শক্তিশালী দুর্নীতিবাজ চক্র পুরো ব্যাংকিং সেক্টর গ্রাস করে ফেলছে। যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক কঠোর ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব না হবে, ততক্ষণ ব্যাংকের বিদ্যমান দুরবস্থা ঠেকানো যাবে না।
বরং ঋণ অবলোপনের খাতা ভারি হবে। জালিয়াতি করা ঋণের টাকা ভুয়া এলসির মাধ্যমে বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে এবং আরও যাবে।
তারা মনে করেন, শাস্তি শুধু জেল নয়, ঋণখেলাপিদের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কিংবা রাষ্ট্রের অনুকূলে আনতে হবে।
প্রয়োজনে ঋণ পরিশোধ না করা পর্যন্ত তার বাসার সব ইউটিলিটি সার্ভিস বন্ধ করে দিতে হবে। শুধু মামলা দিয়ে দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। কেননা মনে রাখতে হবে- যেসব টাকা বেহাত হয়ে গেছে, তা জনগণের আমানতের টাকা। এভাবে চলতে থাকলে একে একে ব্যাংকগুলো দেউলিয়া হয়ে যাবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, রিট করে অনেক খেলাপি পার পেয়ে যান। কিন্তু রিটের বিরুদ্ধে অনেক ব্যাংকই যথাযথ পদক্ষেপ নেয় না। এর সঙ্গে ঋণখেলাপি ও ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশ থাকার অভিযোগ আছে। এ অবস্থায় তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার কোনো বিকল্প নেই।
সূত্র জানায়, আইনি পদক্ষেপ নিতে ব্যাংকগুলোর শৈথিল্যের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের কেন্দ্রীয় ঋণ তথ্যভাণ্ডার বা সিআইবিতে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার ঋণ নিয়মিত হিসেবে দেখানো হচ্ছে।
এর মধ্যে আইনের ফাঁক গলিয়ে এবং ব্যাংকগুলোর নীরবতার কারণে সরকারি একটি ব্যাংকে আলোচিত একটি গ্রুপের ১ হাজার কোটি টাকার ঋণ বর্তমানে আইনি ফাঁকফোকরের প্রক্রিয়ায় নিয়মিত রাখা হয়েছে।
একইভাবে ঢাকার জনৈক সংসদ সদস্য চারটি ব্যাংকে প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকার ঋণ নিয়মিত করে রেখেছেন। এবি ব্যাংকে আরও একটি গ্রুপের প্রায় ১০০ কোটি টাকার ঋণ একই প্রক্রিয়ায় নিয়মিত রাখা হয়েছে।
এ ছাড়া সরকারি আরও একটি ব্যাংকে দেশের আলোচিত প্রভাবশালী ব্যবসায়ী তার একটি প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৩৩০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ দীর্ঘ সময় নিয়মিত রাখতে সক্ষম হন। এমনকি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় একটি সরকারি ব্যাংকে একজন প্রার্থীর প্রায় ২৫০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নিয়মিত করে রাখা হয় একই প্রক্রিয়ায়। উদ্দেশ্য ছিল প্রভাবশালী ঋণগ্রহীতাকে নির্বাচনের সুযোগ দেয়া।
বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কর্পোরেশনের দু’জন খেলাপি আইনি প্রক্রিয়ার আশ্রয় নিয়ে প্রায় ৬০০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নবায়ন করেছেন।
প্রিমিয়ার ব্যাংকে সরকারের একজন প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধির ১০২ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ এখনও নিয়মিত হিসেবে দেখানো আছে। এরকম আরও অনেক প্রভাবশালী ঋণখেলাপি আইনের ফাঁক গলিয়ে ব্যাংকারদের বিশেষ প্রক্রিয়ায় ম্যানেজ করে খেলাপি ঋণের দুর্নাম থেকে বাইরে রয়েছেন।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান আইনজীবী আজমালুল হক কিউসি গত সপ্তাহে যুগান্তরকে বলেন, ব্যাংকের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কেউ ক্ষুব্ধ হলে আইনের আশ্রয় নিতে পারেন। সেই ক্ষেত্রে ব্যাংককেও আইনের কাছে যেতে হবে। দ্রুত যথাযথ আইনি যুক্তি তুলে ধরতে হবে। এর মাধ্যমে আইনি কাঠামো ব্যাংকের পক্ষে আনার চেষ্টা করতে হবে। এখন ব্যাংক এটি না করলে সেটি ব্যাংকের দোষ।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, প্রভাবশালীদের কেউ খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার পর দ্রুত আইনের আশ্রয় নিয়ে খেলাপির তালিকা থেকে বেরিয়ে আসেন। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যাংক থেকে এর বিপরীতে শক্ত কোনো আইনি পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। ফলে ঋণখেলাপিরা অব্যাহতভাবে পার পেয়ে যাচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংক দুর্বল অবস্থান গ্রহণ করায় ঋণখেলাপিদের আটকানো যাচ্ছে না।
সূত্র জানায়, এভাবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর চরম দায়িত্বহীনতার কারণে সরকারি খাতের জনতা ব্যাংকে আড়াই হাজার কোটি টাকা, রূপালী ব্যাংকে ১ হাজার ২২২ কোটি টাকা, বেসিক ব্যাংকে ৫৩৮ কোটি টাকা, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে ৭০০ কোটি টাকা, কৃষি ব্যাংকে ২০০ কোটি টাকা, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকে ১৪৪ কোটি টাকা, সরকারি আরও দুটি ব্যাংকে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ এখন নিয়মিত দেখানো হচ্ছে। এ ছাড়া ন্যাশনাল ব্যাংকে ২ হাজার কোটি টাকার বেশি, সাউথ-ইস্ট ব্যাংকে দেড় হাজার কোটি টাকা, কমার্স ব্যাংকে ৮০০ কোটি টাকা, প্রিমিয়ার ব্যাংকে ৩০০ কোটি টাকা, ইসলামী ব্যাংকে ৬৭৫ কোটি টাকা, ফারমার্স ব্যাংকে ২৫০ কোটি টাকা, আইসিবি ব্যাংকে ৩৭৫ কোটি টাকা একই কারণে নিয়মিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। এ ছাড়াও বেসরকারি খাতের দুটি ব্যাংকে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নিয়মিত হয়ে গেছে। নতুন প্রজন্মের ব্যাংকগুলোও একই পথে হাঁটছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে কোনো ঋণ খেলাপি করা হলে সেগুলো সিআইবিতে খেলাপি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তখন ঋণখেলাপিরা নতুন ঋণ পান না বা নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন না। কেননা এসব ক্ষেত্রে সিআইবি থেকে সনদ নিতে হয়। এ কারণে খেলাপিরা বাণিজ্যিক ব্যাংক বা বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নিয়ে তাদেরকে ঋণখেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করতে বাধার সৃষ্টি করে। এই ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো এই বাধা অতিক্রম করতে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ নেয় না। বরং এভাবে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কম দেখানো সম্ভব হয়। একই সঙ্গে ঋণখেলাপিরা সমাজের সব সুবিধা পেয়ে যাচ্ছেন।
তিনি জানান, এ অবস্থায় সংকট নিরসনে বাংলাদেশ ব্যাংক শক্ত পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে। প্রাথমিকভাবে মডেল ভিত্তিতে তিনটি ব্যাংকের প্রতিটির ৫টি করে ১৫টি শীর্ষ গ্রাহকের ফাইল তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচ্চপর্যায়ের এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়। ব্যাংকগুলো হল- সরকারি খাতের জনতা ব্যাংক, বেসরকারি খাতের এবি ব্যাংক এবং ইসলামী শরিয়াহ ভিত্তিতে পরিচালিত আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক। এ জন্য তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এতে দেখা হবে, গ্রাহক রিট করে খেলাপি ঋণ নিয়মিত হিসেবে দেখানোর জন্য উচ্চ আদালতের আদেশ পাওয়ার পর ব্যাংক থেকে রিট খারিজ করাতে যথাযথ ভূমিকা বা আইনি পদক্ষেপ নিয়েছে কিনা। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকের কোনো গাফিলতি থাকলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন