দেশে সোনার ব্যবসা দীর্ঘদিনের হলেও চাহিদার পরিমাণ মেটানোর জন্য চোরাচালানই ছিল সবচেয়ে বড় মাধ্যম, যা সবারই জানা। আর এই চোরাচালান বন্ধ করতেই অনুমোদিত ডিলারদের মাধ্যমে সোনা আমদানির বিধান রেখে স্বর্ণ নীতিমালা, ২০১৮-এর খসড়া অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এর মাধ্যমে সহজে রপ্তানিতেও উৎসাহ প্রদান করা হবে। নীতিমালাটি চূড়ান্ত হয়ে গেলে এ খাতটির চেহারাই পাল্টে যাবে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
নীতিমালা অনুমোদনের পরপরই বড় একটি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যার মাধ্যমে খাতটির প্রথম সংষ্কার শুরু হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব সুভাশীষ বসুকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে সোনা আমদানি ও রপ্তানিতে কী পরিমাণ মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) আরোপ যুক্তিযুক্ত হবে, তা নির্ধারণে বাণিজ্যসচিবকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। যেখানে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ের একজন করে প্রতিনিধি, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের একজন ও বাংলাদেশের ব্যাংকের প্রতিনিধি রয়েছেন।
ব্যবসায়ীদের কাছে বর্তমানে যে পরিমাণ সোনা রয়েছে এর ওপর একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ভ্যাট বা ট্যাক্স নির্ধারণ করবে। নির্ধারিত ভ্যাট বা ট্যাক্স প্রদান করে ব্যবসায়ীরা তাদের সোনা বৈধ করে নিতে পারবে। কমিটি এ বিষয়টি নিয়েও কাজ করছে। এর আগে এক প্রস্তাবে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, সোনার লেভি (ভ্যাট বা ট্যাক্স) হতে পারে প্রতি ভরিতে এক হাজার টাকা। বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস) লেভির পরিমাণ ৩০০ টাকা ধরার দাবি তুলেছিল। তবে এত কম কমের পক্ষে ছিলেন না অর্থমন্ত্রী।
এতে বড় অঙ্কের একটি রাজস্ব সরকারের কোষাগারে আসবে এবং নীতিমালা বাস্তবায়নের শুরুতেই এ খাতের ব্যবসায়ীদের কাছে থাকা সোনাগুলো নীতিগতভাবে বৈধতা পাবে নির্দিষ্ট লেভি পরিশোধের মাধ্যমে, যা এত দিন ধরে অবৈধ ছিল। এত দিন দেশে সোনা বাণিজ্যিকভাবে আমদানি না হওয়ায় ভ্যাটের বিষয়টি নিয়ে তেমন কোনো কাজ হয়নি। কমিটি ব্যাগেজ রুলসের বিষয়েও মতামত প্রদান করবে। সব কিছু বিশ্লেষণ করে অর্থমন্ত্রীর কাছে একটি প্রতিবেদন দাখিলের কথা রয়েছে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নীতিমালার প্রয়োজনীয়তা আছে এবং এটি অনেক আগে থেকেই ছিল। কারণ দেশে সোনার বাজারে একটা অব্যবস্থাপনা বিরাজ করছে।’
আমাদের দেশে সোনার চাহিদা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যেহেতু চাহিদা রয়েছে, সেহেতু আমদানি করতে হবে। আবার রপ্তানির যে সম্ভাবনা রয়েছে, সেটাকেও এখন কাজে লাগানো সম্ভব হবে। কেউ যদি ভালোমানের জুয়েলারি প্রস্তুত করে, তবে সেটা রপ্তানি করতে পারবে, সেটার বাজার রয়েছে। রপ্তানির এই পয়েন্ট অব ভিউ থেকে নীতিমালা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’
এই অর্থনীতিবিদ কঠোর নীতিমালা না করে উদার নীতির পক্ষে মত দিয়েছেন। যাতে করে এটাকে ব্যবসায়ীরা সহজে গ্রহণ করতে পারে।
এদিকে নীতিমালা তৈরির পরপরই আবার একটি নতুন সংযোজন আনা হচ্ছে আমদানির ক্ষেত্রে। অনুমোদন হওয়া খসড়া নীতিমালায় শুধু সোনার বার আমদানির বিধান রাখা হয়েছিল। নতুন করে স্বর্ণের অলংকারও আমদানির বিষয়টি যুক্ত করা হচ্ছে। এতে দেশের বাজারে সোনার দাম নির্ধারণে এক ধরনের প্রতিযোগিতাও তৈরি হবে, যাতে ক্রেতারা লাভবান হওয়ার সুযোগ বেশি থাকবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইচ্ছাতেই ‘স্বর্ণ নীতিমালা, ২০১৮’-এর খসড়ায় এই সংযোজন আনা হচ্ছে এবং দ্রুতই এ বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
দেশে বাণিজ্যিকভাবে সোনা আমদানির পথ সুগম করতে গত ৩ অক্টোবর মন্ত্রিপরিষদ সভায় ‘স্বর্ণ নীতিমালা, ২০১৮’-এর খসড়া অনুমোদন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে সোনা আমদানির পাশাপাশি রপ্তানির বিষয় নিয়েও আলোচনা হয়।
নীতিমালার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যায় মন্ত্রিপরিষদসচিব শফিউল আলম সাংবাদিকদের জানান, সোনা আমদানি সহজ করা, এ শিল্পে জবাবদিহি আনা, স্বর্ণালঙ্কার রপ্তানিতে উৎসাহ জোগানো ও স্বর্ণ খাতে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ বজায় রাখতে কার্যকর নিয়ন্ত্রণ, সমন্বয়, পরীবিক্ষণ ও তদারকিব্যবস্থা গড়ে তোলাই এর লক্ষ্য।
নীতিমালার বিষয়ে জানতে চাইলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এ খাতের স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহির কোনো জায়গা ছিল না। নীতিমালার বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি আসবে। ব্যবসায়ীরা কর ফাঁকি দিত। এটা এখন নজরদারির মধ্যে থাকবে। সর্বোপরি সরকারের একটি নিয়ন্ত্রণ আসবে এ খাতের ওপর।’
এত দিন ধরে এই সেক্টরের যারা কর্মী (গহনা তৈরির কারিগর) তাদের বিষয়টি উপেক্ষিত ছিল। নীতিমালায় তাদের বিষয়টিও তুলে আনা হয়েছে। এর মাধ্যমে তাদের জীবনমানের উন্নয়নে কাজ হবে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, ‘শুধু নীতিমালা করে রাখলেই হবে না, আগামীত দিনে যে সরকারই আসুক না কেন, তাদের উচিত হবে একটি পূর্ণাঙ্গ আইন তৈরি করা।’
জানা গেছে, নীতিমালা অনুযায়ী দ্য ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন অ্যাক্ট, ১৯৪৭-এর অধীনে বাংলাদেশ ব্যাংক সোনা আমদানির ডিলার অনুমোদন দেবে। অনুমোদিত ডিলার সরাসরি প্রস্তুতকারী বা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সোনার বার আমদানি করবে এবং তা অলংকার প্রস্তুতকারকের কাছে বিক্রি করতে পারবে। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, দেশে সোনার মান যাচাই করার উপযুক্ত কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। এ ধরনের একটি প্রতিষ্ঠান গঠনের নির্দেশনা থাকবে নীতিমালায়। এ ছাড়া ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণপত্র খুলে সোনা আমদানির ক্ষেত্রে এর দামের ন্যূনতম ৫ শতাংশ অর্থ জামানত রাখার কথা বলা থাকবে।
সোনার মান যাচাইয়ে হলমার্ক ব্যবস্থার প্রবর্তন করার কথা বলা হয়েছে নীতিতে। সোনা, স্বর্ণালংকার ক্রয়-বিক্রয়ে হলমার্ক বাধ্যতামূলক করতে হবে, খাদের পরিমাণ সুনির্দিষ্ট করতে হবে। ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য বিক্রয় ক্যাশ মেমোর সঙ্গে স্বর্ণালংকারের হলমার্ক স্টিকার বাধ্যতামূলকভাবে প্রদান করতে হবে। নীতিমালায় লাগেজ রুলের বিষয়টি ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বিমানবন্দরগুলোতে লাগেজে করে ১০০ গ্রাম পর্যন্ত সোনা বিনা শুল্কে আনা যাবে এবং শুল্ক পরিশোধ করে ২৩৪ গ্রাম পর্যন্ত সোনা আনতে পারবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন