এই প্রথম সাবেক কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফৌজদারি অভিযোগে অভিযুক্ত হলেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পকে গ্রেপ্তার হয়তো অনিবার্য, কিন্তু তাকে কি হাজতে নেওয়া হবে? তিনি কি ভোট করতে পারবেন? ট্রাম্প অভিযুক্ত হওয়ার পরপরই মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী শ্যানন বাউ ও’ব্রায়েন সবিস্তারে আলাপ করেছেন আমাদের সময়ের সঙ্গে। টেক্সাসের বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সহযোগী অধ্যাপকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সহকারী সম্পাদক জাহাঙ্গীর সুর
আমাদের সময় : ডোনাল্ড ট্রাম্পকে কি সত্যিই গ্রেপ্তার করতে চলেছে নিউইয়র্ক কর্তৃপক্ষ?
শ্যানন বাউ ও’ব্রায়েন : আমার তো মনে হচ্ছে, পরিস্থিতি সেদিকেই এগোচ্ছে। এই তো, বেশ কিছু নিবন্ধ পড়লাম রাতে; বলা হচ্ছে, তাকে অভিযুক্ত করায় ট্রাম্প নাকি বিস্মিত। কিন্তু রাষ্ট্রপতিরা তো আর রাজা নন। তারা আমাদের আইনের ঊর্ধ্বে নন। সাধারণ জনতাকে আইনের আওতায় যেভাবে জবাবদিহির মধ্যে রাখি, আমরা যদি একইভাবে আমাদের সরকারি কর্তাদের জবাবদিহির মধ্যে না রাখি, তাহলে রাষ্ট্র হিসেবে আমরা ব্যর্থ হব। প্রতিটি কর্মের জন্য প্রত্যেককে জবাবদিহি করা জরুরি। কৃতকর্মের জবাবদিহির সময়
কে কী, তা দেখে কাউকে ছাড় দেওয়া কোনো মতেই গ্রহণযোগ্য নয়। মনে রাখতে হবে, আমাদের প্রেসিডেন্টরা জনগণের জন্য এবং জনগণের দ্বারা নির্বাচিত।
আমাদের সময় : ট্রাম্পকে কি রিমান্ডে নেওয়া হবে? তাকে হাজতে রাখা হবে?
শ্যানন বাউ ও’ব্রায়েন : আমার মনে হয় না, ডোনাল্ড ট্রাম্পকে কারাগারে রাখা হবে কিংবা তাকে রিমান্ডে নেওয়া হবে। আমি মনে করি, তার ছবি তোলা হবে, আঙুলের ছাপ নেওয়া হবে এবং নিজের জিম্মায় তাকে জামিন দেওয়া হবে। তাকে কারাগারে রাখা সমস্যাজনক। আর কারাগারে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও বেশ বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। তাকে কারাগারে পুরলে, শুধু ট্রাম্পের জন্যই একজন গুপ্তচরকে সার্বক্ষণিক তার সঙ্গে রাখতে হবে।
আমাদের সময় : স্টর্মি ড্যানিয়েলসের এই মামলা ছাড়াও অদূর ভবিষ্যতে ট্রাম্পকে কি ক্যাপিটল হিলে দাঙ্গা উসকে দেওয়ার অভিযোগে বা অন্যান্য মামলায় গ্রেপ্তার করা হতে পারে?
শ্যানন বাউ ও’ব্রায়েন : ঠিক এই মুহূর্তে বোঝা যাচ্ছে না। আমি নিশ্চিতভাবে জানি না, ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ঠিক কী কী বিষয়ে তদন্ত করা হচ্ছে এবং তার বিরুদ্ধে সম্ভাব্য অভিযোগগুলো কী হতে পারে, এটিও আমার কাছে স্পষ্ট নয়। আমি যা বলতে চাচ্ছি, তা হলো, হ্যাঁ, আমি জানি কী ঘটছে, কিন্তু আমার কাছে অন্যান্য তদন্ত ও সম্ভাব্য অভিযোগ গঠন সম্পর্কে সাধারণ নাগরিকের চেয়ে বেশি তথ্য এই মুহূর্তে নেই। আপাতত, ওইসব ক্ষেত্রে কী ঘটতে পারে বা কী না হতে পারে, সে বিষয়ে মন্তব্য করতে চাই না এই আলোচনায়।
আমাদের সময় : ট্রাম্পকে গ্রেপ্তার করা হলে তার উগ্র সমর্থকরা কি সহিংসতা ও দাঙ্গা শুরু করতে পারে?
শ্যানন বাউ ও’ব্রায়েন : দেখুন, যে কেউ যেকোনো সময় যা কিছু চেষ্টা করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে শান্তিপূর্ণ সমাবেশের সাংবিধানিক অধিকার অনুমোদিত। ট্রাম্পের সমর্থকদের শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া হবে। কিন্তু তারা যদি সহিংসতা বা দাঙ্গায় লিপ্ত হয়, তাহলে তারা গ্রেপ্তারের মতো পরিণতির মুখোমুখি হবে। ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি [তার নিজস্ব] সামাজিক মাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে সরাসরি এ রকম দাঙ্গায় সমর্থকদের উৎসাহিত করেন, তা হলে এর দায় তাকেই নিতে হবে : তার বিরুদ্ধে তখন অতিরিক্ত অভিযোগ দায়ের করা হতে পারে। তার সমর্থকদের শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ সমাবেশ করতে দেওয়া হবে, তার আইনজীবীদের আদালতে তার পক্ষে তাদের সেরা যুক্তি উপস্থাপন করার সুযোগ দেওয়া হবে। যদি তারা দাঙ্গা বাধায় বা সহিংসতা চালায় এবং ট্রাম্পই তাদের এমনটা করতে বলেছে বলে তারা দাবি করে, তা হলে ডোনাল্ড ট্রাম্পকেই খেসারত দিতে হবে।
আমাদের সময় : ২০২৪ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য প্রার্থিতা ঘোষণাকারী সব প্রার্থীর মধ্যে ট্রাম্পই প্রথম। তিনি কি তার প্রার্থিতা ঘোষণা করার ক্ষেত্রে এমন তাড়াহুড়ো করেছিলেন তল্লাশি ও গ্রেপ্তার এড়াতে?
শ্যানন বাউ ও’ব্রায়েন : না, আমি মনে করি না যে, তল্লাশি ও গ্রেপ্তার এড়াতে তিনি এমন তাড়াহুড়ো করেছেন। ট্রাম্প অভিযুক্ত হওয়ার ঠিক পরপরই [মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার] কেভিন ম্যাকার্থি যে টুইট করেছেন, তা যদি দেখেন, তা হলে বুঝতে আর বাকি থাকবে না যে, ডোনাল্ড ট্রাম্প কেন এত আগেভাগে প্রার্থিতা ঘোষণা করেছেন। তড়িঘড়ি প্রার্থিতা ঘোষণা করার মাধ্যমে তিনি একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছেন, যেখানে তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা বা গ্রেপ্তারকে তার বিরুদ্ধে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নির্বাচনী হস্তক্ষেপ বলে তিনি দাবি করতে পারেন। প্রকৃতপক্ষে, এটি একটি খুব দুর্বল যুক্তি। এখনো নির্বাচনের প্রায় দেড় বছর বাকি। রাজনীতির ঘড়িতে এই দেড় বছর ১০ বছরের মতো অনুভূত হতে পারে। আগামী দেড় বছরে কত কিছু ঘটবে এবং কত কিছু বিবর্ণ স্মৃতি হয়ে যাবে। ফলে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ দায়ের করাকে নির্বাচনী হস্তক্ষেপ বলে নিন্দা করা অথৈ সাগরে খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতো মনে হয়। তাড়াতাড়ি প্রার্থিতা ঘোষণার আরেকটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে, ট্রাম্প অন্যান্য রিপাবলিকানদের দলীয় মনোনয়ন দৌড় থেকে ছিটকে ফেলতে চেয়েছিলেন।
আমাদের সময় : ট্রাম্পকে গ্রেপ্তার করা হলে, তিনি কি নির্বাচনী প্রচার চালিয়ে যেতে পারবেন এবং নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবেন?
শ্যানন বাউ ও’ব্রায়েন : হ্যাঁ, তা পারবেন। যদিও আমি শতভাগ সুনিশ্চিত নই। কিন্তু যতক্ষণ না রাষ্ট্র কাউকে ব্যালটে নিষিদ্ধ করে (এবং আমি মনে করি না, ট্রাম্পকে নিষিদ্ধ করা হবে), ততক্ষণ তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন।
আমাদের সময় : নির্বাচনে দাঁড়িয়ে ট্রাম্প যদি বিজয়ী হন, এবং একই সঙ্গে তাকে যদি জেল-সাজা দেওয়া হয়, তাহলে তিনি কি কারাগার থেকে দেশ চালাতে পারবেন?
শ্যানন বাউ ও’ব্রায়েন : এ রকম উদাহরণ তো আমাদের আছেই। কারাগার থেকে প্রেসিডেন্ট পদে ভোট করার ইতিহাস আছে : ১৯২০ সালে যেমন ভোট করেছিলেন [সোশ্যালিস্ট পার্টি অব আমেরিকার নেতা] ইউজিন ডেবস। ১৯৯২ সালে কারাগার থেকে প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন লিন্ডন লারুচে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি কারাগারে থেকে ভোট করে জয় পান, তা হলে দেখতে হবে, ডেবস ১৯২০ সালে এ বিষয়ে কী পথ দেখিয়ে গেছেন এবং তিনি কীভাবে কী করেছিলেন। তবে হ্যাঁ, তাত্ত্বিকভাবে তো কারাগার থেকে দেশ চালাতে কোনো বাধা দেখছি না।
আমাদের সময় : ট্রাম্প যদি সত্যিই আবার আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হন, তাহলে বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বের ভবিষ্যৎ কী হবে?
শ্যানন বাউ ও’ব্রায়েন : আমি মনে করি, বিশ্বমঞ্চে আমেরিকার আদর্শিক ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমরা দেখেছি, গণতন্ত্রকে আলিঙ্গন করে না, এমন দেশগুলোর নেতাদের প্রতি ডোনাল্ড ট্রাম্প অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল। ডোনাল্ড ট্রাম্প খোলাখুলিভাবে এসব দেশের প্রশংসা করেন। পুনর্নির্বাচিত হলে কীভাবে তিনি কথিত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর প্রতিশোধ নেবেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প সে সম্পর্কে একাধিক বিবৃতি দিয়েছেন। তার ন্যায়বিচারবোধ নেই। কেউ বিরোধিতা করছেন, এটা মনে করলেই তিনি প্রতিশোধপ্রবণ হয়ে ওঠেন। আমেরিকার জনগণ যদি এমন একজন ব্যক্তিত্বকে পুনরায় নির্বাচিত করে, যিনি তাদের নিজস্ব ব্যবস্থাকে প্রকাশ্যে ঘৃণা করেন, তা হলে আমরা যে নিজেদের শক্তিশালী গণতান্ত্রিক জাতি হিসেবে এতদিন বিবেচনা করে আসছি, আমাদের সেই গৌরব ক্ষুণ্ণ হবে। অতীতে কে কীভাবে তার সঙ্গে আচরণ করেছে, ধরে ধরে তাদের শাস্তি দিতে চান ডোনাল্ড ট্রাম্প। যাদের তিনি পছন্দ করেন না, এমন লোকেদেরও শাস্তি দিতে চান। তিনি যদি আবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, তা হলে আমেরিকার ওপর আস্থা হারাবে বিশ্ব। আমরা যার-তার খিস্তির সহজ শিকার হব।
আমাদের সময় : মূল্যবান সময় ও বিশেষজ্ঞ অভিমত দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানাই।
শ্যানন বাউ ও’ব্রায়েন : আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য ধন্যবাদ। আমি যতটা সম্ভব আপনার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আশা করছি, সবটা পরিষ্কার ভাষায় বলতে পেরেছি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন