কয়েক দশকের স্থিতিশীলতার ‘বিকন’ বা বাতিঘর, জনগণের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ আর নেই। ৯৬ বছর বয়সে বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় বিকালে বালমোরাল ক্যাসেলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। এ সময় তার পাশে ছিলেন প্রিন্স চার্লস সহ তার সব সন্তান, রাজপরিবারের বেশির ভাগ সদস্য। তাদের সামনে শান্তিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন রানী। বাকিংহাম রাজপ্রাসাদ থেকে এ খবর নিশ্চিত করা হয়েছে। ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় সিংহাসনে থাকার ঐতিহাসিক রেকর্ড সৃষ্টি করে তিনি শুধু বৃটেন নয়, সারাবিশ্বের মানুষের কাছে ভীষণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তার মৃত্যুর খবরে বৃটেনের সঙ্গে কাঁদছে পুরো বিশ্ব। ওদিকে তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বৃটেনের নতুন রাজা হয়েছেন রানীর বড় ছেলে প্রিন্স চার্লস। ফলে তিনি এখন আর প্রিন্স চার্লস নন, তিনি এখন রাজা তৃতীয় চার্লস। মায়ের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন নতুন রাজা।
নিজের এবং পরিবারের সব সদস্যের জন্য এই মুহূর্তকে তিনি সবচেয়ে বেদনার বলে বর্ণনা করেছেন। গভীর শোক জানিয়েছেন নতুন প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস। তিনি ডাউনিং স্ট্রিটের সামনে দেয়া বিবৃতিতে বলেছেন, আমরা সবাই বিধ্বস্ত হয়ে গেছি। রানীর মৃত্যু দেশ এবং পুরো বিশ্বের জন্য হতাশার। প্রয়াত রানীর মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন বিশ্ব নেতৃবৃন্দ। এর মধ্যে আছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রন, বেলজিয়ামের প্রধানমন্ত্রী আলেকজান্দার ডি ক্রো, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কি প্রমুখ।
এর আগে রানীর শারীরিক অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন চিকিৎসকরা। এ নিয়ে বিবৃতি দেয় বাকিংহাম রাজপ্রাসাদ। বৃটিশ মিডিয়া বলছে, রানীর স্বাস্থ্যগত বিষয়ে রাজপ্রাসাদের বিবৃতি উচ্চমাত্রায় অস্বাভাবিক। এ থেকে আন্দাজ করা যায়, অবস্থা খুবই গুরুতর। খবর পেয়ে রানীর সব সন্তান, নাতি প্রিন্স উইলিয়াম ও রাজপরিবারের সদস্যরা ছুটে যান স্কটল্যান্ডের বালমোরাল ক্যাসেলে। সেখানে রানীর শয্যাপাশে অবস্থান নেন তারা। রানীর চিকিৎসকরা ছুটে যান প্রাসাদে। তাকে রাখা হয় তাদের নজরদারিতে। এ খবরে তাৎক্ষণিক টুইট করেন প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস। ওই সময় পার্লামেন্টে জ্বালানি ইস্যুতে বিতর্ক চলছিল। অসুস্থতার খবর শুনে রানীর জন্য প্রার্থনা জানান আর্চবিশপ অব ইংল্যান্ড। খবর জানার পর উদ্বিগ্ন দেশবাসী ছুটে যান বালমোরাল প্রাসাদের বাইরে। তারা কান্নায় ভেঙে পড়েন। কমপক্ষে ৭০ বছর বৃটিশ সিংহাসনে রাজত্ব করেছেন রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ। এ সময়ে তিনি ১৫ জন প্রধানমন্ত্রীকে নিয়োগ করেন। দেশের সংকটময় সময়গুলোতে সরকারকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। তার সেবার জন্য দেশজুড়ে, দেশের বাইরে অস্বাভাবিক জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। বিশেষ করে কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোতে তিনি যেন নয়নের মণি।
গতকাল স্বাস্থ্য নিয়ে ‘উদ্বেগ’ প্রকাশ করে চিকিৎসকরা রানীকে মেডিকেল নজরদারির মধ্যে রাখার সুপারিশ করেন। বাকিংহাম রাজপ্রাসাদ থেকে এ তথ্য জানানোর পর রানীর স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ বৃদ্ধি পাচ্ছিল ক্রমশ। খবর পাওয়ার পর সিংহাসনের পরবর্তী উত্তরাধিকারী প্রিন্স চার্লস সহ রানীর সব সন্তান রুদ্ধশ্বাসে ছুটে যান বালমোরালে। এর মধ্যে আছেন প্রিন্স অ্যানড্রু, প্রিন্সেস অ্যান এবং প্রিন্স এডওয়ার্ড। দাদি ও রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথকে দেখতে ছুটে যান প্রিন্স উইলিয়াম। সন্তানদের দেখভালের জন্য বাকিংহামে থেকে যান প্রিন্সেস কেট মিডলটন। ওদিকে প্রিন্স হ্যারি ও তার স্ত্রী মেগান মার্কেল বালমোরালে পৌঁছার কথা। রানীর স্বাস্থ্যের অবনতির খবর দিনের শুরুতে রাজপরিবারের সব সদস্যকে জানিয়ে দেয়া হয়। ফলে পরিবারের সদস্যরা রানীর শয্যাপাশে অবস্থান নিতে ছুটে যান।
রানী এলিজাবেথ অবস্থান করছিলেন স্কটল্যান্ডের বালমোরাল ক্যাসেলে। বছরের এ সময়টাতে তিনি সেখানে অবস্থান করেন। গতকাল যখন হৃদয় ভেঙে যাওয়ার মতো খবর প্রকাশ পায়, তখন বালমোরালে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছিল। যেন শোক জানিয়ে গলে গলে পড়ছিল মেঘ। প্রকৃতিকে ভিজিয়ে শোকের এক আবহ রচিত হয় চারদিক। এই বালমোরাল ক্যাসেল থেকেই ৬ই সেপ্টেম্বর রানী নতুন প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসকে নিয়োগ করেন। তখন তাকে বেশ হাসিখুশি দেখা যায়। তিনি গ্রিনরুমে স্বাগত জানান ট্রাসকে। এর আগে তিনি বিদায় জানান বরিস জনসনকে। এএফপি লিখেছে, গত বছর অক্টোবর থেকেই স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছিলেন রানী। এসব সমস্যার কারণে তার হাঁটতে এবং দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হয়। তাকে বিশ্রামে থাকতে বলার পর বুধবার রাতে সিনিয়র রাজনৈতিক উপদেষ্টাদের সঙ্গে পরিকল্পিত প্রাইভি কাউন্সিলের বৈঠক বাতিল করতে বাধ্য হন রানী। ভার্চ্যুয়ালি জুমের মাধ্যমে এই বৈঠক করার কথা ছিল। বাকিংহাম প্যালেস থেকে তার স্বাস্থ্য সম্পর্কে গতকাল বিবৃতিতে বলা হয়, বৃহস্পতিবার সকালে আরও মূল্যায়নের পর রানীর চিকিৎসকরা তার স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা তাকে আরও মেডিকেল তত্ত্বাবধানে থাকার সুপারিশ করেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। সবাইকে কাঁদিয়ে চিরবিদায় নিলেন তিনি।
চিকিৎসকদের সতর্কতার পর পরই প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস এবং তার পার্লামেন্টারি টিমের সিনিয়র সদস্যদের কাছে নোট পাঠানো হয়। এতে দ্রুত তাদেরকে চেম্বার ছেড়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করা হয়। তখন জ্বালানি ইস্যুতে পার্লামেন্টে বিতর্ক চলছিল। এ সময় প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসের কাছে ওই নোট হস্তান্তর করেন নাদিম জাহাবি। চলমান অধিবেশনের মধ্যেই এ নিয়ে তাদের দু’জনকে কথা বলতে দেখা যায়। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস টুইট করেন। তিনি লিখেছেন, বৃহস্পতিবার মধ্যাহ্নভোজের সময় বাকিংহাম প্রাসাদ থেকে যে খবর পাওয়া গেছে, তাতে পুরো দেশ গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। এই সময়ে রানী ও তার পরিবারের প্রতি আমাদের এবং পুরো বৃটেনের মানুষের প্রার্থনা।
দুপুরের দিকে হাউজ অব কমন্সে নতুন সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়ে চমৎকার বিতর্ক চলছিল। এমন সময় প্রধানমন্ত্রীর কাছে নাদিম জাহাবি রানীর স্বাস্থ্যগত উদ্বেগের কথা তুলে ধরেন। এরপরই এসএনপি ওয়েস্টমিনস্টারের নেতা ইয়ান ব্লাকফোর্ডের বক্তব্যে ছেদ ঘটান স্পিকার স্যার লিন্ডসে হোইলি। তিনি এমপিদের জ্বালানি নিয়ে বিতর্কের মধ্যে জানান- পুরো হাউজের পক্ষ থেকে আমি কথা বলছি। রানীর শুভ কামনা করছি আমরা। এই মুহূর্তে তিনি এবং রাজ পরিবারের প্রতি আমাদের প্রার্থনা।
এ নিয়ে বৃটিশ মিডিয়ায় উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে। সব মিডিয়াই তাদের নিয়মিত খবর পরিবেশনের পরিবর্তে এই খবরকে প্রাধান্য দিয়েছে। সংবাদের শীর্ষ শিরোনাম হয়েছেন রানী। নিয়মিত প্রোগ্রামের সম্প্রচার স্থগিত করে বিবিসি ওয়ান। বালমোরালে রানী মেডিকেল তত্ত্বাবধানে আছেন, রাজপরিবারের সদস্যরা তার কাছে রুদ্ধশ্বাসে ছুটে যাচ্ছেন- এমন ঘোষণার পর পরই বিবিসি তাদের নিয়মিত প্রোগ্রাম স্থগিত করে দেয়। এর পরিবর্তে তারা সম্প্রচার করে বিবিসি নিউজ স্পেশাল। এতে উপস্থাপক হিউ এডওয়ার্ড কালো পোশাক পরে উপস্থিত হন। তার গায়ে সাদা শার্ট। গলায় কালো টাই। যখন রাজ পরিবারের কোনো সদস্য মারা যান, তখন বিবিসি এমন পোশাক কোড ব্যবহার করে। এর মধ্য দিয়ে মৃত ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়।
চার্চ অব ইংল্যান্ডের প্রধান আর্চবিশপ অব ক্যান্টারবারি বলেছেন, রানীর জন্য পুরো দেশবাসীর প্রার্থনা আছে। জাস্টিন ওয়েলবি টুইটে বলেছেন, রানীর সঙ্গে আছে আমার, পুরো চার্চ অব ইংল্যান্ড এবং দেশবাসীর প্রার্থনা। ঈশ্বর তাকে, তার পরিবারকে এবং যারা বালমোরালে রানীর সেবা করছেন, তাদেরকে শক্তি এবং স্বস্তি দিন।
বিবিসি’র রাজপরিবার বিষয়ক সাবেক প্রতিনিধি রিচার্ড সামনার বলেছেন, রাজপ্রাসাদ থেকে দেয়া বিবৃতিতে সতর্কতার সঙ্গে শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এতে বোঝা যায় মারাত্মক কিছু ঘটছে। আশা করছি এটি একটি ক্ষণস্থায়ী ঝড়, যা কাটিয়ে উঠা যাবে। কিন্তু অবশেষে তা আর হলো না। ডেইলি মেইল লিখেছে, গত বছর অক্টোবরে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে সার্ভিসে রানী হাঁটার সময় লাঠি ব্যবহার করেন। বড় কোনো অনুষ্ঠানে তিনি প্রথমবার এমনটা করেন। এর এক সপ্তাহ পরে তাকে বিশ্রামে থাকার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা এবং উত্তর আয়ারল্যান্ড সফর বাতিল করার পরামর্শ দেন। তার প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য গোপনে হাসপাতালে ভর্তিও করা হয়। একই বছর তিনি হাসপাতালে প্রথম রাত কাটিয়েছেন ২০শে অক্টোবর। পরের দিন তিনি উইন্ডসরে নিজের টেবিলে হাজির হন। হালকা ধরনের কাজ চালিয়ে যান।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন