মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফর নিয়ে অভূতপূর্ব এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে এ অঞ্চলে। চীন প্রথম থেকেই এই সফরের বিষয়ে সাবধান করলেও, সফরের পর যে প্রতিক্রিয়া দেশটি দেখাচ্ছে তা অনেকটাই ধারণার বাইরে ছিল। তাইওয়ানকে অবরুদ্ধ করে সামরিক মহড়া চালাচ্ছে দেশটি। রাজধানী তাইপের ওপর দিয়ে একের পর এক মিসাইল উড়ে যাচ্ছে। আঘাত হানছে তাইওয়ানের কাছাকাছি সমুদ্রে। তাইওয়ানের সীমানায় ঢুকে চলছে গোলা ও রকেট নিক্ষেপ। শত শত যুদ্ধবিমান ও যুদ্ধজাহাজ তাইওয়ানকে ঘিরে ফেলেছে। ফলে যে কোনো সময় একটি যুদ্ধ লেগে যেতে পারে দুই পক্ষের মধ্যে এমন আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, মহড়ায় এমন তাজা গোলাবারুদ তখনই ব্যবহার করা হয় যখন একটি দেশ সত্যিকারের যুদ্ধের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে। তবে এক্ষেত্রে বেইজিং হয়তো শুধু একটি বার্তাই দিতে চাচ্ছে তাইওয়ান এবং পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোকে।
তারা দেখাতে চাচ্ছে যে, যদি যুদ্ধ লেগে যায় তাহলে তাইওয়ান দখলে তারা কী পরিমাণ শক্তি ব্যবহার করতে পারবে। বিশেষজ্ঞরা একমত যে, যুক্তরাষ্ট্র কিংবা চীন কারোরই এখনই যুদ্ধ করার কোনো ইচ্ছে নেই।
‘অস্ট্রেলিয়ান স্ট্র্যাটেজিক পলিসি ইনস্টিটিউট’-এর নির্বাহী পরিচালক জাস্টিন বাসি বলেন, চীন মূলত যুদ্ধ এড়িয়ে সামরিক মহড়ার মাধ্যমে কাজ সাড়তে চাইছে। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্র নিজেও সাবধান রয়েছে। পেলোসিকে তাইওয়ান সফরে পাঠানো হলেও তাদের স্বাধীনতার প্রসঙ্গে কোনো কথা বলেননি তিনি। চীনের দেয়া স্পষ্ট রেড লাইন অতিক্রমের সাহস দেখায়নি তারাও। যুক্তরাষ্ট্র যখনই এই সংকটে হস্তক্ষেপ করেছে, তারা সবসময় তাইওয়ানের সমর্থন দেয়ার জন্য সবথেকে সুবিধাজনক এবং নিরাপদ পদ্ধতিটি ব্যবহার করেছে। কোনো পদক্ষেপ থেকে যেন বড় সংঘাত সৃষ্টি না হয় সেজন্য একটি সঠিক ভারসাম্য বজায় রাখছে ওয়াশিংটন। এদিকে চীনের এই আগ্রাসী আচরণকে স্বাভাবিকভাবেই দেখতে চান ‘ক্রাইসিস গ্রুপ’-এর সিনিয়র বিশ্লেষক আমান্ডা হাসিয়াও। তিনি বলেন, চীনের এই সামরিক মহড়া উদ্বেগজনক হলেও এটি অপ্রত্যাশিত ছিল না। বেইজিং স্পষ্টভাবেই পেলোসির সফর নিয়ে তাদের আপত্তির বিষয়টি তুলে ধরতে চাইছে। এজন্য তারা এমন কিছু করছে যা এর আগে হয়নি।
এর আগে তাইওয়ানকে ঘিরে তাদের যে সামরিক উস্কানি ছিল তার থেকেও বড় মাপের উস্কানি তৈরি করছে বেইজিং। তবে এই মহড়ার একমাত্র উদ্দেশ্য নিজেদের সামরিক সক্ষমতা প্রদর্শন। চীনের গ্লোবাল টাইমস সংবাদপত্র জানিয়েছে, চীন চাইলেই যে তাইওয়ানকে অবরুদ্ধ করে দিতে পারে তাই দেখানো হবে এই মহড়ায়। এতে বিশেষজ্ঞরা যে মতামত লিখেছেন তাতে এ মহড়াকে ‘পুনর্মিলনের মহড়া’ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে। চীনা সামরিক বিশ্লেষক সং ঝংপিং লিখেছেন, এখন যে অভিযানের মহড়া চলছে, তা ভবিষ্যতে সামরিক সংঘাতের ক্ষেত্রে সরাসরি যুদ্ধাভিযানে পরিণত করা হতে পারে। এর আগেও ১৯৯৫ সালে নানা রকম আগ্রাসী আচরণ দেখিয়েছে চীন। ওই ঘটনা ‘তৃতীয় তাইওয়ান স্ট্রেইট ক্রাইসিস’ নামে পরিচিত। সে সময় কয়েক মাসজুড়ে নিজের সামরিক সক্ষমতা দেখিয়েছিল চীন। তাইওয়ানের বন্দরগুলো থেকে ৩৫ মাইলের মধ্যে মিসাইল ছুড়েছিল তারা। তবে এবার তাইওয়ানের আরও কাছাকাছি মিসাইল নিক্ষেপ করতে পারে দেশটি। চীনা গণমাধ্যমে সেই আশঙ্কার কথা এরইমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। চলতে পারে হাইপারসনিক মিসাইলের পরীক্ষাও। এরইমধ্যে তাইওয়ানের চারপাশে এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় সামরিক মহড়া চালাচ্ছে বেইজিং। ছোড়া হচ্ছে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। কয়েক ডজন যুদ্ধবিমান ও যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করা হয়েছে।
ফলে একটি আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে যে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধই চাইছে কিনা চীন। দেশটি স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে, নিজেদের সার্বভৌমত্ব এবং ভৌগলিক অখণ্ডতা বজায় রাখতে এ মহড়া চালানে হচ্ছে। চীনা বাহিনীর ছোড়া বেশ কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র তাইওয়ান ও জাপানের সমুদ্রসীমার এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোনে পড়েছে। বিষয়টি নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ান সতর্ক করে বলেছে, যে পরিস্থিতি চলছে, তাতে শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে হিসাব-নিকাশে ভুল হওয়া, গুরুতর বিরোধ, সরাসরি সংঘাত এবং অনিশ্চিত পরিণতির শঙ্কা রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের সাহায্য চেয়েছেন তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং ওয়েন। তবে একইসঙ্গে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য চীনকে পাল্টা দেখে নেয়ার কথাও বলেন তিনি। তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, চীন এরইমধ্যে ১১টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়েছে। এগুলো ডংফেং ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। জাপান বলছে, তাদের ইইজেড-এ কমপক্ষে পাঁচটি ক্ষেপণাস্ত্র পড়েছে।
এ কারণে তাইওয়ানগামী বিমানগুলো তাদের ফ্লাইট বাতিল করেছে। আল-জাজিরার এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, চীন তাইওয়ানে আক্রমণ করলে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যেও বড় ধরনের সংঘাত বেধে যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানকে আনুষ্ঠানিকভাবে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি না দিলেও ১৯৭৯ সালের ‘তাইওয়ান রিলেশনস অ্যাক্ট’- অনুযায়ী, দেশটি দ্বীপ অঞ্চলটিকে সহযোগিতা করতে বাধ্য। গত মে মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, চীন আক্রমণ করলে তাইওয়ানের সুরক্ষায় সহযোগিতা করবে যুক্তরাষ্ট্র। গার্ডিয়ানের এক রিপোর্টে জানানো হয়েছে, শুধু সামরিক মহড়াতেই চীনের হুমকি থেমে নেই। ফ্রান্সে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত এক টিভি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তাইওয়ান দখল করার পর সেখানকার বাসিন্দাদের নতুন করে ‘শিক্ষিত’ করা হবে। রাষ্ট্রদূত লু শায়ে তাইওয়ানের ডেমোক্রেটিক প্রোগ্রেসিভ পার্টিকে ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
তার দাবি, এই রাজনীতিকরাই তাইওয়ানের মানুষদের চীনের সঙ্গে যুক্ত হওয়া থেকে ঠেকিয়ে রেখেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী তাইওয়ান দখলে নেবে চীন? এক্ষেত্রে তাদের বেশকিছু ঝুঁকি রয়েছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ১০ হাজারের বেশি সেনা নিয়ে চীনা বাহিনীকে তাইওয়ান প্রণালী অতিক্রম করতে হবে। তখন তারা তাইওয়ানের বিমান ও জাহাজ থেকে ছোড়া বোমা হামলার শিকার হতে পারেন। সেনারা যদি তাইওয়ানের উপকূলে পৌঁছেও যায়, তারপরও তীরে নামতে তাদের বেগ পেতে হবে। কারণ, অসমতল উপকূল রেখায় তাদের সশস্ত্র সেনা, সাঁজোয়া যান, ট্যাংক ও গোলাবারুদ নামানোর মতো উপযুক্ত তীর এলাকার সংখ্যা হাতে গোনা। তাছাড়া তাইওয়ান আক্রমণ করার মানে হচ্ছে পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকি নেয়া। চীন এখনই সেই ঝুঁকি নিতে চাইবে না বলেই মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন