ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশ উত্তরখণ্ডের হরিদ্বারে অনুষ্ঠিত হিন্দু ধর্মীয় নেতাদের এক সম্মেলনে দেশটিতে থাকা মুসলমানদের বিরুদ্ধে গণহত্যার আহ্বান জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যেই সম্মেলনের এই ভিডিওচিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় ভারতে তা নিন্দার ঝড় তুলেছে।
এর আগে গত ১৭ থেকে ১৯ ডিসেম্বর তিন দিনব্যাপী এই সম্মেলন উগ্র হিন্দুত্ববাদী পুরোহিত জ্যাতি নরসিংহানন্দের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে ৫০ জনের বেশি পুরোহিত ও রাজনীতিবিদ অংশ নেন।
এদিকে শুক্রবার উগ্রবাদী ঘৃণামূলক মন্তব্যের জেরে সম্মেলনের বিষয়ে অভিযোগ গঠন করেছে ভারতীয় পুলিশ। উত্তরখণ্ড পুলিশের প্রধান অশোক কুমার জানিয়েছেন, ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধ, শত্রুতা ও ঘৃণামূলক মনোভাব ছড়িয়ে দেয়ার কারণে এই অভিযোগ গঠন করা হয়েছে।
সম্মেলনের আয়োজক নরসিংহানন্দ বলেন, ‘অর্থনৈতিক বয়কটে কোনো কাজ হবে না। হিন্দু সংগঠনগুলোর নিজেদের উন্নত করে নিতে হবে। এই ক্ষেত্রে তলোয়ারই উত্তম উপায়। উত্তম হাতিয়ারের সাহায্যেই মুসলমানদের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে জয় আসবে।’
সম্মেলনে অংশ নেয়া হিন্দু মহাসভার সাধারণ সম্পাদক সদভি অন্যাপূর্ণা বলেন, মুসলমানদের হত্যার জন্য জেলে যাওয়ার বিষয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিওতে তাকে বলতে দেখা যায়, ‘অস্ত্র ছাড়া কিছুই সম্ভব নয়। আপনাদের যদি তাদের (মুসলমান) জনগোষ্ঠী নিশ্চিহ্ন করতে হয়, তাদের হত্যা করুন। তাদের হত্যা করতে প্রস্তুত হন এবং জেলে যেতে প্রস্তুত হন। যদি আমাদের মাত্র এক শ’ সৈন্যও থাকে এবং তাদের ২০ লাখকে যদি আমরা হত্যা করি, আমরা বিজয়ী হবো।’
সদভি অন্যাপূর্ণা বলেন, ‘আপনারা যদি এই মনোভাব নিয়ে অগ্রসর হন তবেই শুধু আপনারা সনাতন ধর্মকে রক্ষা করতে পারবেন।’
উত্তরখণ্ডভিত্তিক হিন্দুত্ববাদী সংগঠন হিন্দু রক্ষা সেনার প্রধান স্বামী প্রবোধানন্দ মিয়ানমারে ২০১৭ সালের রোহিঙ্গাবিরোধী জাতিগত নিধনের মতোই ভারত থেকে মুসলমান জনগোষ্ঠী নিধনের আহ্বান জানান।
সম্মেলনে ব্ক্তব্যে তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারের মতোই এই দেশের পুলিশ, রাজনীতিবিদ, সামরিক বাহিনী ও সকল হিন্দুকে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে হবে এবং আমাদের পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালাতে হবে। এর বাইরে কোনো সমাধান নেই।’
এদিকে ভারতীয় মুসলমানদের বিরুদ্ধে সম্মেলন করে এরূপ হুমকির ফলে দেশটিতে বিভিন্ন মহল নিন্দা জানিয়েছে।
ভারতীয় মুসলমানদের বৃহ্ত্তম ধর্মীয়-সামাজিক সংগঠন জমিয়তে উলামা-ই-হিন্দের প্রধান মাওলানা মাহমুদ মাদানী ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, সংখ্যালঘু বিষয়ক জাতীয় কমিটি ও উত্তরখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে চিঠি দিয়ে সম্মেলনের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি করেছেন।
চিঠিতে তিনি বলেন, ‘তারা দেশের শান্তি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিরুদ্ধে হুমকি সৃষ্টি করেছে। এই সম্মেলনের আয়োজক ও বক্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আমি দাবি জানাচ্ছি।’
ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের খ্যাতনামা আইনজীবী প্রশান্ত ভুষন এক টুইটবার্তায় জানান, ‘ভয়াবহ! এই লোকেরা যে বক্তব্য দিয়েছে, তার জন্য আইপিসি (ভারতীয় পেনাল কোড) ও ইউএপিএ (বেআইনি কার্যক্রম প্রতিরোধ আইন) আইনে তাদের গ্রেফতার করা উচিত। সুপ্রিম কোর্টের অবশ্যই এই বিষয়ে নজর দেয়া উচিত।’
অপরদিকে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সাবেক প্রধান জেনারেল বেদ মালিক টুইটবার্তায় বলেন, ‘এই ধরনের বক্তব্য জনগণের মধ্যে সম্প্রীতির ক্ষতি করে এবং জাতীয় নিরাপত্তাকে প্রভাবিত করে।’
তবে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বের কেন্দ্রীয় সরকার এখনো এই বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে ভারতের কেন্দ্রীয় শাসনক্ষমতায় রক্ষণশীল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) আসার পর থেকে দেশটিতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণামূলক মনোভাব ছড়িয়ে পড়ে। গোরক্ষা, লাভ জিহাদসহ বিভিন্ন অজুহাতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে নিপীড়ন শুরু করে হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলো।
ঘৃণামূলক মনোভাবের জেরেই গত বছর ফেব্রুয়ারিতে রাজধানী দিল্লিতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ এক দাঙ্গা সংগঠিত হয়।
সূত্র : আলজাজিরা
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন