জেমস জে ইউসুফ সাবেক মার্কিন সামরিক বাহিনীতে ক্যাপ্টেন পদমর্যাদায় চেপলেইন হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। কুখ্যাত গোয়েন্তানামো বে বন্দি শিবিরের ইমাম (চেপলেইন) হিসেবে দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু সন্দেহভাজন ঘটনায় অভিযুক্ত হয়ে এক সময় তিনি কারারক্ষী থেকে কারাবন্দী হয়ে পড়েন।
সম্প্রতি আল জাজিরা মুবাশিরকে দেওয়া সাক্ষাতকারে ইউসুফ বলেন, ‘আমার দায়িত্ব ছিল, বন্দি শিবিরের মসজিদে ইমামতি করা ও মুসলিম বন্দীদের ধর্মীয় বিধান পালন করছে কিনা তা দেখাশোনা করা। স্বাভাবিকভাবেই এসব দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমি বন্দীদের দুঃখ-দুর্দশাপূর্ণ কঠিন পরিস্থিতি দেখতে পাই। নির্যাতিত নিপীড়িত বন্দীদের পক্ষ থেকে একটি প্রতেবেদন জমা দেওয়ায় কারাকর্তৃপক্ষ আমার আচারণকে বন্দীদের প্রতি সহানুভূতি হিসেবে অভিহিত করে। এরপর তারা আমার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদ ও গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ দায়ের করে, যে অপরাধের শাস্তি কেবল মৃত্যুদণ্ড হতে পারে।’
ইউসুফ ইয়ে ১৯৬৮ সালে আমেরিকার নিউজার্সিতে জন্মগ্রহণ করেন। স্প্রিংফিল্ড টাওনশিপে বেড়ে ওঠেন। সেখানকার বিখ্যাত জনাথন ডেটন হাইস্কুলে পড়াশোনা করেন। ইউসুফের বাবা ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মার্কিন যোদ্ধা। তাঁর দুই ভাইও মার্কিন সামারিক বাহিনীতে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯০ সালে ওয়েস্ট পয়েন্ট থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। ১৯৯১ সালে জেমস ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে ইসলাম বিষয়ক পড়াশোনা করতে সিরিয়ায় যান। সেখানে ফিলিস্তিনি নারী হুদার সঙ্গে তার সাক্ষাত হয় এবং তাকে বিয়ে করেন। সারাহ নামের এক মেয়ের পিতা তিনি।
এরপর ইউসুফ লিসবার্গ ভার্জিনিয়ার গ্রাজুয়েট স্কুল অফ ইসলামিক অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সেস থেকে একটি সমমানের পত্র পান, যা তাকে সামরিক বাহিনীর চ্যাপলেইন হিসেবে যোগ্যতা অর্জনের সুযোগ করে দেয়। এরপর গুয়েন্তানামো বে মুসলিম বন্দি শিবিরে সুন্দরভাবে দায়িত্ব পালন করায় তিনি উর্ধ্বতনদের কাছে প্রশংসা কুড়ান।
কিন্তু ২০০৩ সালের ১০ সেপ্টেম্বর গুয়ান্তানামো বন্দি শিবিরে দায়িত্ব পালন করে ফেরার সময় তিনি ফ্লোরিডার জ্যাকসনভিলে আটক হন। সেই সময় যুক্তরাষ্ট্রের কাস্টমস এজেন্ট তার জিনিসপত্রের মধ্যে গুয়ানতানামো বন্দী ও জিজ্ঞাসাবাদকারীদের একটি তালিকা খুঁজে পান। তার বিরুদ্ধে পাঁচটি অপরাধের অভিযোগ আনা হয়: রাষ্ট্রদ্রোহ, শত্রুকে সহায়তা করা, গুপ্তচরবৃত্তি, গুপ্তচরবৃত্তি এবং সাধারণ আদেশ মানতে ব্যর্থতা।
এরপর তাকে দক্ষিণ ক্যারোলিনার চার্লসটনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার পদে বদলি করা হয়। তবে কার জন্য গুপ্তচরবৃত্তি করছে বলে সন্দেহ হয়েছিল সেই বিষয়ে সেই বিষয়ে কর্তৃপক্ষ কিছুই জানায়নি। ২০০৪ সালে ১৯ মার্চ কোর্ট মার্শালে তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ প্রত্যাহার করা হয় এবং যথাযথ দায়িত্ব পালনে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। ২০০৫ সালে তিনি সম্মানজনকভাবে মার্কিন সামরিক বাহিনীর চাকরি ছেড়ে দেন।
সামরিক বাহিনী ছেড়ে ইউসুফ নতুন জীবন শুরু করেন। ২০০৫ সালে তিনি ‘ফর গড অ্যান্ড কান্ট্রি’ বই লিখে পাঠকমহরে ব্যাপক সাড়া ফেলেন। এতে তিনি নিজের জীবনের ঘটনা ও গুয়েন্তানামো বে বন্দি শিবিরের ভয়াবহতা তুলে ধরেন।
গুয়ান্তানামো বে বন্দী শিবিরের নানা ধরনের নির্যাতনের কথা বর্ণনা করেন ইউসুফ। তিনি বলেন, ‘জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষে বন্দীদের নির্যাতন ছাড়াও সেখানে পবিত্র কোরআন অবমাননা করতে দেখতাম। পবিত্র কোরআন অবমাননার সময় বন্দীরা প্রতিবাদ করত। অনেক সময় রক্ষীরা কক্ষ তল্লাশি করত। তখন তারা কোরআন মাটিতে ফেলে দিয়ে বন্দীদের ক্ষুব্ধ করত।
তিনি আরো বলেন, ‘জিজ্ঞাসাবাদের সময় কোরআনকে মাটিতে ফেলে জিজ্ঞাসাবাদকারীরা পদদলিত করত। তারা বন্দীর সামনে সামনে কোরআনের ওপর বসে থাকত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বন্দীদের সাথে উপযুক্ত আচরণ করে থাকে। মানবাধিকার ও ইসলামিক সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বজায় রাখে।কিন্তু গুয়ানতানামোতে যা ঘটছিল তা ছিল ইসলাম ও মুসলিমদের প্রতি চরম শত্রুতার বহিপ্রকাশ। কারণ গুয়ান্তানামো বন্দি শিবিরের সৈন্যরা কারো সঙ্গে সৌজন্যমূলক আচরণ করত না। এমনকি সেখানে কর্মরত বেসামরিক মুসলিমদেরও তারা সম্মান করত না।’
গুয়ানতানামো বে কারাগারে প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুনামকে ক্ষুণ্ন করছে বলে জানান জেমস ইউসুফ। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমলে তা বন্ধ হবে বলে তিনি আশা করেছিলেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন শিগগির তা বন্ধ করবেন বলে আশা প্রকাশ করেন ইউসুফ। তিনি বলেন, আগের চেয়ে অনেক বেশি বন্দীকে এবার মুক্তি দেওয়া হয়েছে।
সূত্র : আলজাজিরা
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন