নিরাপত্তার নামে যে চুক্তিতে একদল হলো যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়া, এতে বিতর্কিত দক্ষিণ চীন সাগরের জল আরও ঘোলা হলো বলে। ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি বলছে, এমনকি পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন তৈরির এ চুক্তির কারণে আশঙ্কা বাড়ছে, এ ক্রোধান্বিত চীন পাছে না যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।
অস্ট্রেলিয়া, ইউকে, ইউএস- তিন দেশের নামের অদ্যাক্ষর নিয়ে এ চুক্তির নাম রাখা হয়েছে অকুস। এ চুক্তির আওতায় প্রথম দেশটিকে অপর দেশদ্বয় পারমাণবিক সাবমেরিন বানানোর প্রযুক্তি দেবে। ২০১৬ সালে অস্ট্রেলিয়া এ রকম একটি চুক্তি করেছিল ফ্রান্সের সঙ্গে, নতুন চুক্তির কারণে ওই চুক্তি বাতিল করেছে স্কট মরিসনের সরকার।
চীন এরই মধ্যে কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। বেইজিং বলেছে, এ চুক্তি আসলে চরম দায়িত্বজ্ঞানহীন ও ক্রোধ উদ্দীপক হস্তক্ষেপ। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের আচরণে বেজায় বিরক্ত ফ্রান্সও। প্যারিস বলছে, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতোই আচরণ করছেন তার উত্তরসূরি জো বাইডেন।
এদিকে আল জাজিরা গতকাল এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, দক্ষিণ চীন সাগরের আন্তর্জাতিক জলসীমায় চীনা ও মার্কিন জাহাজের উপস্থিতি দেখে নৌ-টহল বাড়িয়েছে ইন্দোনেশিয়া। অন্যদিকে, সাউথ চীনা মর্নিং পোস্ট এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ক্ষুব্ধ বেইজিং জার্মান এক যুদ্ধজাহাজকে নোঙর করতে দেয়নি সাংহাই বন্দরে।
তিন দেশের প্রধান নেতা- যথাক্রমে জো বাইডেন, বরিস জনসন ও স্কট মরিসন- বুধবার এ চুক্তি ঘোষণার সময় চীনের নাম উল্লেখ করেনি। কিন্তু বিবিসি বলছে, দক্ষিণ চীন সাগরে বেইজিংয়ের প্রভাব কমিয়ে আনতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়া এ পদক্ষেপ নিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এ চুক্তির আওতায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, কোয়ান্টাম প্রযুক্তি ও সাইবার সংক্রান্ত বিষয়গুলোর তথ্যও একে অপরের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে পারবে দেশ তিনটি। ৫০ বছরের মধ্যে প্রথম দেশ হিসেবে অস্ট্রেলিয়াকে পারমাণবিক সাবমেরিন তৈরির প্রযুক্তি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এর আগে কেবল যুক্তরাজ্যকে এ প্রযুক্তি দিয়েছিল ওয়াশিংটন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দক্ষিণ চীন সাগর ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকা ভূরাজনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং সেখানে উত্তেজনাও অনেক বেশি বিদ্যমান থাকে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ার নিরাপত্তা চুক্তির বিষয়ে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান বলছেন, ‘এই চুক্তির মাধ্যমে আঞ্চলিক শান্তি ধ্বংসের বড় ধরনের ঝুঁঁকি তৈরি করেছে ওই দেশগুলো। একই সঙ্গে এ ধরনের কর্মকা-ের মাধ্যমে অস্ত্র প্রতিযোগিতাও বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।’
চীনকে মোকাবিলায় এ ধরনের মনোভাবকে ‘অপ্রচলিত শীতল যুদ্ধ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন লিজিয়ান। একই সঙ্গে এ ধরনের কর্মকা-ের মাধ্যমে ওই তিনটি দেশ নিজেদের স্বার্থকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে বলেও হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন তিনি। এদিকে চার হাজার কোটি মার্কিন ডলারের চুক্তি বাতিল হওয়ায় ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যঁ-ইভেস লে ড্রিয়ান বলেছেন, ‘এ রকম নিষ্ঠুর, একতরফা ও হুটহাট সিদ্ধান্ত আমাকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। তিনি এমন সিদ্ধান্ত নিতেন।’
এ সিদ্ধান্তের ফলে আমি ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত। এ রকম আচরণ মিত্রদের সঙ্গে করা যায় না।’ তিনি বলেন, ‘এর মাধ্যমে পেছন থেকে ছুরি মারা হয়েছে। আমরা অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে একটি বিশ্বাসের সম্পর্ক স্থাপন করেছিলাম। অস্ট্রেলিয়া সেই বিশ্বাস ভেঙে দিয়েছে।’
দক্ষিণ চীন সাগর
# অস্ট্রেলিয়া-যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্রের চুক্তি চরম দায়িত্বজ্ঞানহীন ও ক্রোধ উদ্দীপক হস্তক্ষেপ : চীন
# ট্রাম্পের মতো আচরণ করছেন বাইডেন : ফ্রান্স
# জলসাগরে চীনা ও মার্কিন জাহাজ, নৌটহল বাড়াল ইন্দোনেশিয়া
# জার্মান যুদ্ধজাহাজের প্রবেশে বাধা বেইজিংয়ের
‘বেইজিংবিরোধী’ বাণিজ্যিক জোটে যোগ দিতে চীনের আবেদন
এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর অংশীদারত্বমূলক বাণিজ্য চুক্তি সিপিটিপিপিতে যোগ দিতে আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন করেছে চীন। গত বৃহস্পতিবার চীনা বাণিজ্যমন্ত্রী ওয়াং ওয়েন্তাও নিউজিল্যান্ডের বাণিজ্যমন্ত্রী ও সিপিটিপিপির বর্তমান ডিপোজিটরি ড্যামিয়েন ও’কনরের কাছে জোটে যোগদানের জন্য লিখিত আবেদন করেছেন।
চীনা সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল টাইমসের খবর অনুসারে, বৈশ্বিক বাণিজ্যে নেতৃত্বদানকারী ভূমিকা পাকাপোক্ত করা এবং যুক্তরাষ্ট্রের ওপর চাপ বৃদ্ধির লক্ষ্যে সিপিটিপিপিতে যোগ দিতে চায় চীন।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার এশিয়ানীতির অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগেই ২০১৫ সালে ১২টি দেশের মধ্যে সই হয় বহুল আলোচিত ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) চুক্তি। তবে ক্ষমতায় আসার মাত্র এক বছর পরই এটি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নাম প্রত্যাহার করে নেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্র সরে যাওয়ার ফলে কার্যত অচল হয়ে পড়ে টিপিপি। তবে বাকি দেশগুলোর আগ্রহে কম্প্রিহেনসিভ অ্যান্ড প্রোগ্রেসিভ অ্যাগ্রিমেন্ট ফর ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ বা সিপিটিপিপি নামে কোনোরকমে টিকে থাকে চুক্তিটি। যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে এ চুক্তিতে সই করা বাকি ১১টি দেশ হচ্ছে- অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ব্রুনেই, কানাডা, চিলি, মালয়েশিয়া, মেক্সিকো, নিউজিল্যান্ড, পেরু, সিঙ্গাপুর ও ভিয়েতনাম।
চুক্তি অনুসারে সিপিটিপিপি সদস্য দেশগুলোর মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধার কথা উল্লেখ রয়েছে। চীন যুক্ত হওয়ার পর সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে তাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন