ভাষান্তর : শফিকুল ইসলাম শান্ত
মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো সৈন্য প্রত্যাহারের পর আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘ ২০ বছরের অর্জন ভেঙে পড়েছে তাসের ঘরের মতোই। যা দেখে মার্কিনীরা তো বটেই, বিস্মিত হয়েছে বিশ্ববাসী। এর নেপথ্যে দেশটির নীতি নির্ধারকদের ভুল সিদ্ধান্ত থাকলেও দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এর দিকেই বেশি উঠছে অভিযোগের আঙুল।
কাবুল নিয়ন্ত্রণে তালেবানের সক্ষমতার পূর্ভাস দিতে ব্যর্থ হওয়ায় সেই অভিযোগের পালে আরও হাওয়া দিয়েছে। ফলে, মার্কিন মুল্লুকে তো বটেই সিআইএর সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে আন্তর্জাতিক মহলেও।
বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম সিএএনএন’র সঙ্গে কথা বলেছেন প্রখ্যাত মার্কিন লেখক ও সাংবাদিক টিম ওয়েইনার। যিনি সাংবাদিকতার সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘পুলিৎজার’ বিজয়ী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাকারি বি উলফ। আর ভাষান্তর করেছেন শফিকুল ইসলাম শান্ত।
প্রশ্ন- মার্কিন সমর্থিত আফগান সরকার তালেবানের বিরুদ্ধে কত দিন পর্যন্ত প্রতিরোধ গড়তে পারবে, এ বিষয়ে সম্পূর্ণ ভুল তথ্য দিয়েছে সিআইএ। আপনি একে কীভাবে দেখেন?
ওয়াইনার : দেখুন, গোয়ান্দা সংস্থার কাছে ভবিষ্যৎ দেখার কোনো যন্ত্র নেই। তারা কেবল অতীত ও বর্তমান ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ করে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য হামলা বা হুমকির বিষয়ে অনুমান করতে পারে। সুতরাং এই বিপর্যয়ের জন্য আপনি সিআইএ-কে দোষারোপ করতে পারেন না। কারণ, আজকের আফগান পরিস্থিতি চারজন প্রেসিডেন্ট ও দেশটিতে থাকা সেনা কমান্ডারদের কর্মকাণ্ডের ফল, যারা তাদের ভুলভাবে ব্যবহার করেছে।
আরও নির্দিষ্ট করে বলা যায়- ২০২০ সালে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের পতনের দ্বার উন্মোচন করেছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পে। তখনই যুক্তরাষ্ট্রের পতন নিশ্চত হয়ে যায়। এরপর শুধু অপেক্ষা ছিলো- কত দ্রুত তা ঘটবে!
প্রশ্ন- প্রাক্তন সিআইএ পরিচালক ডেভিড পেট্রিয়াসের একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘কোনো ব্যর্থ নীতিকে গোয়েন্দা ব্যর্থতা হিসেবে দেখা ওয়াশিংটন প্রশাসনের একটি দীর্ঘদিনের চর্চা।’ আপনিও কী তাই মনে করেন? আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয়ের মূল কারণগুলো কী?’
ওয়াইনার : কিছু ক্ষেত্রে তাই। আর আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয়ের অনেকগুলো কারণ রয়েছ। এরমধ্যে তিনটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, মার্কিন নীতি-নির্ধারকরা আফগানিস্তানের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং ভৌগলিক স্বতন্ত্রতা সম্পর্কে না জেনেই সেখানে যুদ্ধে জড়িয়েছেন। চেঙ্গিস খান, তৈমুল লং, ব্রিটিশ সেনাবাহিনী এমনকি সোভিয়েত ইউনিয়নও সেখান থেকে বিজয়ী হয়ে ফিরতে পারেনি। তারা শুধু শুধুই আফগানিস্তানকে ‘সম্রাজ্যের গোরস্তান’ বলেনা। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকরা ইতিহাস থেকে সেই শিক্ষা নেননি।
দ্বিতীয়ত, আফগানিস্তানে পশ্চিমা সমর্থিত শাসকগোষ্ঠীকে সমর্থন এবং বাকি জনগোষ্ঠীকে উপেক্ষা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। যাদের সমর্থন করা হয়েছে, তাদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের কোন সম্পর্ক ছিলো না। আর মার্কিন বাহিনী নিজেদের বিজয় নিশ্চিত করেতে হাজারো বেসামরিক মানুষের প্রাণহানি ঘটিয়েছে। যে কারণে আফগান শাসকগোষ্ঠী অথবা যুক্তরাষ্ট্র, কোন পক্ষকেই বিশ্বাস করতে পারেনি সাধারণ আফগানরা। এই সুযোগে তালেবানের নিরব বিপ্লব ঘটে গেছে। আদতে যুক্তরাষ্ট্র সেখানে জয়ী হতে চেয়েছিলো কিন্তু আফগানদের মন জয় করতে পারেনি।ফলে তাদের মারাত্মক পরিণতি বরণ করতে হয়েছে।
তৃতীয়ত, আফগানিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন সেনা কর্মকর্তাদের একটি অংশ সেখানে জাতিগঠনের নামে ঠিকাদরির ব্যবসা খুলে বসেছিলেন। যুদ্ধটা তাদের জন্য মুনাফায় পরিণত হয়েছিলো। এই সংক্রমণ এতটাই মহামারির আকারণ ধারণ করেছিলো যে, মার্কিন কংগ্রেসে সেই প্রতিবেদন জমা দেওয়া হলেও সেখানেও দুর্নীতির কারণে মারাত্মক তথ্যগত গড়মিল ছিলো। ফলে, বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে থাকলেও দেশটিতে এতদিন মার্কিনীদের সম্ভাব্য বিজয় দেখানো হয়েছিলো। কিন্তু কাগজে কলমে মার্কিনীদের শক্তির ছড়াছড়ি থাকলেও সেনা প্রত্যাহার শুরু হওয়ার পরেই তাদের ভগ্নদশা বের হতে শুরু করে।
প্রশ্ন- কাবুল থেকে সব মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এখন সিআইএ-ও কী সেখানে তাদের উপস্থিতি সীমিত করবে?
ওয়াইনার : কাবুলের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির মধ্যে গত সপ্তাহে সিআইএ তাদের সবশেষ গোয়েন্দা ঘাটি ‘ঈগল বেস’ গুড়িয়ে দিয়েছে। দূতাবাস কিংবা সামরিক ঘাঁটি না থাকলে দেশটিতে তাদের গোয়েন্দা তৎপরতা অব্যাহত রাখা খুবই দুরূহ কাজ হবে।
জানাতে চাই, আফগান-সোভিয়েত যুদ্ধের সময় (১৯৭৯-১৯৮৯) মার্কিন গোয়েন্দারা গোপনে আফগান গেরিলাদের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র সরবরাহ করেছিলো। দেশটি থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটার পর সেখানে তালেবানের জন্ম হয়। পরে তালেবান সেই অস্ত্র ধরলো যুক্তরাষ্ট্রের বুকেই! এরপর পশ্চিমা মিত্রদের নিয়ে তালেবানকে শিক্ষা দিতে ২০০১ সাল থেকে শুরু হলো যুক্তরাষ্ট্রের আফগান মিশন। কিন্তু দীর্ঘ দুই দশক পরে তারাও সেখান থেকে ব্যর্থ মনোরথে ফিরে এলো।
ফলে, ২০ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্র যেখান থেকে শুরু করেছিল, ২০ বছর পর নীতি-নির্ধারকদের ভুলে দেশটি আবারো সেখানেই চলে এলো! মাঝখানে তালেবানের মতো গোষ্ঠীর হাতে আবারো গেল তাদের অত্যাধুনিক সব সামরিক সরঞ্জাম। ফলে, বাড়লো বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের উচ্চঝুঁকি। কিন্তু সেই হুমকি মূল্যায়ন করার জন্য দেশটিতে থাকবে হাতে গণা কয়েকজন গোয়েন্দা!
প্রশ্ন- সম্প্রতি সন্ত্রাস দমন ও আধা সামরিক অভিযানের বদলে সিআইএ চীন ও রাশিয়ার মতো দেশে পাল্টা গুপ্তচরবৃত্তি এবং গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের দিকে বেশি মনোনিবেশ করছে। সেই পদক্ষেপে কী যুক্তরাষ্ট্রের আফগান পরিণতির প্রভাব পড়ার শঙ্কা রয়ছে?
ওয়াইনার : অবশ্যই! দেখুন, ৯/১১ প্রজন্মের সন্ত্রাস দমন কর্মকর্তা এবং বিশ্লেষকরা সিআইএ-তে চাকরি করছেন ২০ বছর ধরে। আমার সন্দেহ তারা এতে ক্লান্ত এবং শেষ পরিণতি দেখে মারাত্মক হতাশ হয়ে পড়েছেন। তাদের পরিবর্তে সিআইএ’র নতুন প্রজন্মকে সামনে আনতে হবে।
এই কাজে যুক্তরাষ্ট্রের অনেকটা সময় লেগে যাবে। ফলে, চীন ও রাশিয়ার মতো দেশে সিআইএ পাল্টা গুপ্তচরবৃত্তি এবং গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের দিকে বেশি মনোনিবেশ করতে পারবে না।
প্রশ্ন- সিআইএ’র ব্যর্থতার দীর্ঘ তালিকা রয়েছে- ৯/১১ এর ঘটনা, ইরাক থেকে যুক্তরাষ্ট্র চলে আসার পর আইএস এর মতো সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর উত্থানের তথ্য না দেওয়ার ব্যর্থতা। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের তথ্য দিতেও ব্যর্থ হয়েছে সিআইএ। তাদের ব্যর্থতার বিপরীতে উল্লেখ করার মতো আসলেই কী কোন সাফল্য আছে?
ওয়াইনার : অবশ্যই আছে। কৌশলগত কারণে গোয়েন্দা সংস্থার সব সফল্য প্রকাশ্যে আনা যায় না। কিন্তু তাদের ব্যর্থতা সবার নজরে আসে এবং সমালোচনার বস্তুতে পরিণত হয়। আসলে ব্যর্থতা এবং ভুল মানুষেরই সহজাত বৈশিষ্ট্য, গোয়েন্দারা এর ঊর্ধ্বে নয়।
আর যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা অনুশীলনের ইতিহাস খুব সমৃদ্ধ নয়। মাত্র ৭৫ বছর হলো তারা এ পথে হাটছে। অথচ যাদের সঙ্গে সে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে তাদের মধ্যে রাশিয়া ৩০০ বছর ধরে গোয়েন্দা কার্যক্রম চালাচ্ছে। আর চীনের তো প্রায় ৫০০ খ্রিস্টপূর্ব থেকেই এই চর্চা করে আসছে।
আর গোয়েন্দারা কোনো আগাম তথ্য দিলো মানে এ নয় যে, প্রেসিডেন্ট বা সেনাবাহিনী তা রুখে দিবে। আর পূর্ব সতর্কতা সবসময় বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে না। সিআইএ’র সতর্কতা উপেক্ষা করেছিলেন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ, কিন্তু বিন লাদেন তার লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন। ফলে, ৯/১১ এর মতো ভয়াবহ ট্রাজেডি তৈরি হয়েছে।
সম্প্রতি কাবুল বিমান বন্দরে বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছে। সেখানেও হামলার আগাম বার্তা দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও হামলা রোধ করা সম্ভব হয়নি। আসলে গোয়ন্দা কর্মকাণ্ড একই সঙ্গে কঠিন, নোংরা এবং বিপজ্জনক একটি কাজ। যখন সফল হয়, হাজারো জীবন বাঁচে। কিন্তু পেছনের সাফল্য কেউ দেখে না। আর যখন ব্যর্থ হয় তখন সমালোচনা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে তা আরও বেশি হয়। বিপরীতে নীতি-নির্ধারকরা থেকে যান সমালোচনার ঊর্ধ্বে, ভালো মানুষটি হয়ে!
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন