অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড জেরুসালেমের শেখ জাররাহ মহল্লা থেকে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদে ইসরাইলি নিম্ন আদালতের রায়ের আপিলে সুপ্রিম কোর্টের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করছেন আপিল করা ফিলিস্তিনি বাসিন্দারা।
সোমবার সুপ্রিম কোর্টে আপিল শুনানিতে বিচারকরা তাদের প্রস্তাব দেন, ইসরাইলি বসতি স্থাপনকারী সংস্থাকে ভাড়ার বিনিময়ে তারা 'সুরক্ষিত বাসিন্দা' হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করতে পারেন।
এর আগে শেখ জাররাহ থেকে উচ্ছেদে ইসরাইলি নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে মহল্লার বাসিন্দা চার ফিলিস্তিনি পরিবার আল-কুর্দ, জাওনি, আবু হাসনা ও আসকাফি আপিল করেন। গত ১০ মে আপিলের শুনানি হওয়ার কথা থাকলেও ওই সময় উদ্ভুত পরিস্থিতিতে তা স্থগিত করা হয়।
সোমবারের শুনানির পর সুপ্রিম কোর্ট এই বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত কোনো আদেশ দেয়নি। আপিল শুনানি স্থগিত করে আদালত জানান, তারা এই বিষয়ে পরে চূড়ান্ত আদেশ দেবেন। তবে এর জন্য কোনো তারিখ নির্ধারণ করেননি তারা।
সুপ্রিম কোর্ট যদি ফিলিস্তিনিদের আপিল প্রত্যাখান করেন, তবে চার পরিবারের প্রায় ৭০ ফিলিস্তিনি বাসিন্দা নিজেদের বাড়ি থেকে উচ্ছেদের শিকার হবেন।
আইজ্যাক আমিত, নোয়াম শোলবার্গ ও ড্যাফনি বারাক-ইরেজের তিন বিচারকের আপিল প্যানেলের প্রস্তাবে বলা হয়, শেখ জাররাহ মহল্লার ফিলিস্তিনি বাসিন্দাদের 'সুরক্ষিত বাসিন্দার' স্বীকৃতি দেবে ইসরাইল। তাদেরকে ওই মহল্লা থেকে কখনোই উচ্ছেদ করা হবে না। তবে এর জন্য তাদেরকে 'ভাড়াবাবদ সামান্য অর্থ' ইসরাইলি বসতিস্থাপনকারী সংস্থা নাহালাত শিমনকে দিতে হবে।
আলজাজিরার প্রতিনিধি হুদা আবদুল হামিদ পশ্চিম জেরুসালেমে ইসরাইলের আদালত চত্ত্বর থেকে জানান, আদালত আপিল করা ফিলিস্তিনি পরিবারগুলোকে এই বিষয়ে একটি দলিলে স্বাক্ষর করার প্রস্তাব দেয়।
দলিলে শেখ জাররাহ মহল্লায় নিজেদের বাড়িতে ইসরাইলি মালিকানার অধীনে ভাড়ার বিনিময়ে তিন প্রজন্ম পর্যন্ত তাতে থাকার শর্ত নির্ধারিত ছিল বলে জানান হুদা আবদুল হামিদ।
আপিলকারীরা এই প্রস্তাব প্রত্যাখান করেছেন।
শেখ জাররাহর বাসিন্দা মোনা আল-কুর্দ সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আইকে বলেন, 'তারা আমাদের একটি আপসমূলক চুক্তিতে যেতে চাপ দিচ্ছে যা বসতি স্থাপনকারীদের সন্তুষ্ট করবে। কিন্তু আমরা তা প্রত্যাখ্যান করেছি।'
অপরদিকে ফিলিস্তিনিদের অভিযোগে ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে আশাবাদী নন বলে জানান মোনার ভাই মোহাম্মদ আল-কুর্দ।
সাংবাদিকদের তিনি বলেন, 'আমি মনে করি না, এই কাঠামোতে নিরপেক্ষ বা ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে। পুরো দেশটিই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ফিলিস্তিনিদের ভূমি আত্মস্মাৎ ও বাড়ি দখল করে।'
শেখ জাররাহের অপর বাসিন্দা আলা সালাইমা মিডল ইস্ট আইকে বলেন, আপিলকারী পরিবারগুলো সম্পূর্ণভাবে এই আপসে যেতে অস্বীকার করেছে।
তিনি বলেন, 'যে মুহূর্ত থেকে আমাদের বাড়ির জন্য ভাড়া দেবো, ওই মুহূর্ত থেকেই আমাদের মালিকানা থাকবে না। এটি কোনো সমাধান নয়। এই বাড়িগুলোর মালিক আমরাই।'
এদিকে আপিল করা ফিলিস্তিনি পরিবারগুলোর আইনজীবী সামি ইরশিদ আলজাজিরাকে বলেন, ইসরাইলি আদালতের এই প্রস্তাব অগ্রহণযোগ্য।
তিনি বলেন, 'এখনো পর্যন্ত আমরা এমন কোনো প্রস্তাব শুনিনি যা যথেষ্ট নিরপেক্ষ এবং বাসিন্দাদের অধিকার রক্ষা করছে। সুতরাং, আমরা কোনো আপসে যাচ্ছি না।'
তবে তিনি এই শুনানিকে 'শুভ অগ্রগতি' হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, 'বিচারকরা জানিয়েছেন তারা আমাদের দ্বিতীয় এক শুনানিতে ডাকবেন। তারা আমাদের আপিল এখনো প্রত্যাখ্যান করেননি; এটি উত্তম ইঙ্গিত।'
তিনি বলেন, 'আমরা আশা করি বিচারকরা আমাদের যুক্তি অব্যাহতভাবে শুনবেন এবং আমাদের দাখিল করা নতুন দলিল বিবেচনায় নিবেন। সর্বশেষে শেখ জাররাহর বাসিন্দাদের অনুকূলে রায় দেবেন।'
এদিকে আদালতের বাইরে বিপুল বিক্ষোভকারী জড়ো হয়ে শেখ জাররাহের ফিলিস্তিনি বাসিন্দাদের সমর্থনে বিক্ষোভ করেছেন বলে বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে।
বিক্ষোভকারীরা শেখ জাররাহে ইসরাইলি বসতি স্থাপনের বিরুদ্ধে স্লোগান দেন এবং প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করেন।
এর আগে গত এপ্রিলে জেরুসালেমের ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট (ইসরাইল পরিচালিত) শেখ জাররাহ মহল্লা থেকে ছয় ফিলিস্তিনি পরিবারকে উচ্ছেদের আদেশ দেয়। ভুক্তভোগী পরিবারগুলো রায়ের বিপক্ষে ইসরাইলি সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে।
শেখ জাররাহ মহল্লা থেকে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদের প্রতিবাদে পশ্চিম তীর, গাজাসহ ইসরাইলের অভ্যন্তরের ফিলিস্তিনিরা বিক্ষোভ শুরু করেন। জেরুসালেমের মসজিদুল আকসাসহ বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত ফিলিস্তিনিদের এই বিক্ষোভে ইসরাইলি বাহিনী হামলা চালায়। মসজিদুল আকসার ভেতরে ইসরাইলি হামলার জেরে গাজা নিয়ন্ত্রণকারী স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে জড়ায়। ১০ মে থেকে টানা ১১ দিনের সংঘর্ষের পর ২১ মে থেকে দুই পক্ষের মধ্যে মিসরের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৪৮ সালে ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব জেরুসালেম জর্দানের নিয়ন্ত্রণে আসে। ওই সময় ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনের বিভিন্ন স্থান থেকে উচ্ছেদ হওয়া বাসিন্দাদের ১৯৫৬ সালে শেখ জাররাহ মহল্লায় আবাসন করে জর্দান সরকার।
১৯৬৭ সালে ছয় দিনের আরব-ইসরাইলের যুদ্ধে পুরো জেরুসালেমের নিয়ন্ত্রণ নেয় ইসরাইল। ১৯৭২ সালে ইসরাইলি বসতিস্থাপনকারী কিছু সংগঠন শেখ জাররাহে জমির মালিকানা দাবি করে ইসরাইলি আদালতে মামলা করে।
২০০২ সালে প্রথম ৪৩ ফিলিস্তিনি বাসিন্দাকে শেখ জাররাহ থেকে উচ্ছেদ করা হয়। পরে ২০০৮ ও ২০১৭ সালে আরো কিছু পরিবারকে এই মহল্লা থেকে উচ্ছেদের আদেশ দেন ইসরাইলি আদালত।
সূত্র : আলজাজিরা,
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন