তুরস্কে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধে আইনের দাবিতে দীর্ঘ এক লড়াই জেতার সব আশা নারী আন্দোলনকারীরা যখন ছেড়েই দিয়েছিলেন, তখন ২০০৪ সালে অপ্রত্যাশিতভাবে তাদের দাবি পূরণ হয়।
কঠিন সেই সংগ্রামের কাহিনি বলতে গিয়ে সেই আন্দোলনের পুরোভাগে থাকা এক নারী পিনার ইক্কারাজান বিবিসিকে বলেন তুরস্কের শতাব্দী প্রাচীন আইন বিংশ শতাব্দীতেও বহাল থাকায় নারীরা ছিলেন চূড়ান্তভাবে বৈষম্যর শিকার।
তুরস্কে ফৌজদারি আইনের ধারাগুলি ছিল ১৯২০ এর দশকে প্রণীত আইন। সেখানে যৌন নিপীড়নের সংজ্ঞা ব্যাখ্যা করা ছিল না। ফলে আইনের চোখে নারীদের ওপর যৌন সহিংসতা কী, তা নির্ধারণে আইনের সাহায্য চাওয়ার কোন উপায় মেয়েদের ছিল না। আইনের চোখে মেয়েরা ছিলেন অবহেলিত।
পিনার ইক্কারাজান বলছেন, একজন নারী স্বামী ছাড়া কারো সাথে সহবাস করতে পারবে না, এটাই ছিল বিধান। আইন অনুযায়ী, যৌন সম্পর্কে শারীরিক বা মানসিক অনুভূতির ক্ষেত্রে পুরুষের ইচ্ছাই প্রধান। সেখানে নারী গৌণ, তার আলাদা কোন সত্ত্বা নেই। বিবাহিত সম্পর্কেও পুরুষের ইচ্ছাই আসল।
কিন্তু নারী আন্দোলনকারীদের জন্য একটা আশার আলো ছিল, সেসময় তুরস্ক ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হবার জন্য আলোচনা চালাতে উদ্যোগী হয়েছে। আর ইইউ বলেছে সদস্যপদ পেতে হলে তুরস্ককে যেসব সংস্কার সাধন করতে হবে তার মধ্যে একটি হল নারীর অধিকার নিশ্চিত করতে ফৌজদারি আইনের সংস্কার।
ইইউর দাবি
ইউরোপীয় ইউনিয়নের দাবি ছিল ইইউ-তে যোগদানের পূর্ব শর্ত হিসাবে তুরস্কের সরকারকে সে বছর ৬ই অক্টোবরের মধ্যে দেশটিতে নারীর সুরক্ষা বিষয়ে নতুন আইন পাশ করতে হবে।
কিন্তু তুরস্ক সরকারও ইতোমধ্যেই ব্রাসলসকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিল যে দেশটির অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে তারা যেন নাক না গলায়।
ইইউ-র দাবি মেটাতে তুরস্ক এর আগের পাঁচ বছরে বেশ কিছু বড়ধরনের রাজনৈতিক ও আইনি সংস্কার এনেছিল। কিন্তু নারীর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এই ফৌজদারি আইনটি প্রণয়নে তুরস্কের টালবাহানায় ইইউ-র মধ্যে তখন হতাশা বাড়ছিল।
ইইউর বক্তব্য ছিল এই ফৌজদারি দণ্ডবিধির প্রণয়ন তুরস্কের সংস্কার প্রক্রিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। কারণ এই দণ্ডবিধির সংস্কার তুরস্কের মানুষের মৌলিক স্বাধীনতা, মতপ্রকাশ ও সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা, এবং নারীর অধিকার নিশ্চিত করার জন্য আবশ্যক।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশ হতে হলে তুরস্ককে আশি বছরের বেশি প্রাচীন দণ্ডবিধির সংস্কার করে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
কিন্তু নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে তুরস্ক অন্য অনেক শর্ত পূরণ করলেও নারী সুরক্ষার বিষয়টি তখনও তাদের সংস্কার তালিকার বাইরেই থেকে গিয়েছিল।
রক্ষণশীল ও আধুনিক মনস্কদের মধ্যে টানাপোড়েন
তুরস্কের নারী আন্দোলনকারীরাও তখন এই আইন প্রণয়নে তাদের দাবি জোরদার করতে পথে নেমেছেন। বিক্ষোভ করছেন আঙ্কারার রাস্তায়, পার্লামেন্ট ভবনের বাইরে।
আমরা অবশ্যই চিন্তিত ছিলাম যে এই আইন নিয়ে সংসদে বিতর্ক শুরু হলে সরকার হয়ত আইন আংশিকভাবে পাশ করবে, কিংবা হয়ত পুরোটাই নাকচ করে দেবে বলেন পিনার ইক্কারাজান।
তারা পার্লামেন্ট ভবনের বাইরে বড় জমায়েত করে সরকারকে দেখাতে চেয়েছিলেন যে এই দাবি হাতে গোনা আধুনিকমনস্ক কিছু নারীর দাবি নয়, তাদের পেছনে রয়েছে ভিন্ন শ্রেণী, পেশা ও ভিন্ন মতের নারীদের ঐক্যবদ্ধ সমর্থন।
সাংবিধানিকভাবে তুরস্ক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হলেও দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান। দেশটিতে রক্ষণশীল ও আধুনিক মনস্কদের মধ্যে টানাপোড়েন দীর্ঘদিনের।
নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে তুরস্কের কয়েকটি নারী সংগঠন বড়ধরনের কিছু আইনি পরিবর্তনের জন্য লড়াই চালিয়ে প্রথম সাফল্য পায় যখন দেওয়ানি আইনে নারী ও পুরুষকে সমান মর্যাদা দেয়া হয়। ওই আইনে বাসস্থান ও সন্তানদের ব্যাপারে নারীর সিদ্ধান্তকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল এবং তালাকের ব্যাপারেও নারীকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার দেয়া হয়েছিল।
সেই সাফল্যের আলোকে পিনার ইক্কারাজানের মত নারী অধিকার কর্মীরা নারীর সুরক্ষা নিয়ে ফৌজদারি দণ্ডবিধিতে সংস্কারের দাবিতে প্রথম আন্দোলনের পথে নামেন।
পিনার বলছিলেন তিনি এবং তার সহ-আন্দোলনকারীরা পুরনো আইন যখন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পড়ে দেখেছিলেন, তখন আইনের যে বিধানটি তাদের সবচেয়ে হতবাক করেছিল সেটা হল, একজন নারীকে যদি ধর্ষণ করা হয়, তারপর সেই ধর্ষক যদি ওই নারীকে বিয়ে করে, তাহলে ধর্ষককে কোন সাজা পেতে হবে না।
পিনার ইক্কারাজান বলেন, সেই নারীর পরিবার যদি আদালতে মামলাও করতে চাইত, তাহলে ধর্ষকের পরিবার থেকে তাকে প্রচণ্ড চাপের মুখে পড়তে হতো। দেখা গেছে আইনের কারণে সেই চাপের মুখে মেয়ের পরিবার মাথা নোয়াতে বাধ্য হয়েছে এবং মেয়েটি না চাইলেও তার ধর্ষককেই শেষ পর্যন্ত তাকে বিয়ে করতে হয়েছে।
এই আইন বদলের আন্দোলনে পিনার ও তার সঙ্গীরা তাদের পাশে পেয়েছিলেন কিছু আইনজীবীকে, সহানুভূতিশীল কিছু রাজনীতিক এবং বিশেষ করে সাবেক একজন নারী বিচার মন্ত্রীকে।
এদের নিয়ে তারা গড়ে তুলেছিলেন ২২ জনের একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ। ১৮ মাস ধরে কাজ করে ফৌজদারি আইনের ধারাগুলো তারা নতুন করে লিখেছিলেন- নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে।
আমরা এমন নিখুঁতভাবে ধারাগুলোকে সংশোধন করেছিলাম, যাতে কেউ সেগুলো নাকচ করে দিতে না পারে।
পিনার বলেন শুধু শহুরে নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে এই সংশোধনী প্রস্তাব তারা তৈরি করেননি।
ছোট ছোট শহরগুলোতে, এমনকি গ্রাম এলাকায়ও বহু সংগঠন আমাদের সাথে একযোগে কাজ করছিল। তারা ছোট ছোট প্যানেল গঠন করে, অসংখ্য কর্মশালার মাধ্যমে মতামত জরিপের কাজ করেছিল, স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোও জনমত যাচাই করতে কাজ করেছিল।
সকলের সহযোগিতায় এই নারী গোষ্ঠী আইনের সম্পূর্ণ নতুন যে কাঠামো গড়ে তুলেছিলেন সেটাই ছিল নতুন চেহারার ফৌজদারি আইন।
সেখানে বাদ দেয়া হয়েছিল নারীর জন্য শারীরিক পবিত্রতা ও কুমারীত্ব রক্ষা এবং সম্মানের বিষয়গুলো প্রয়োগের বিধান। বিবাহিত সম্পর্কের মধ্যেও ধর্ষণ যাতে অপরাধ হিসাবে গণ্য করা যায়, অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল তার বিধানও।
নারীকে ধর্ষণ করার পর সাজা থেকে মুক্তি পাবার জন্য তাকে বিয়ে করার বিধান বাদ দেয়া হয়েছিল।
কিন্তু ২০০২ সালের শেষ নাগাদ তারা যখন সব কিছু নিয়ে তৈরি, তখন তুরস্কের রাজনৈতিক অঙ্গনে ঘটল বিশাল এক পালাবদল।
অপেক্ষাকৃত নতুন রাজনৈতিক দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি বা সংক্ষেপে একে পার্টি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে নির্বাচনে বিজয়ী হল।
নির্বাসিত ধর্মীয় নেতা ও ইসলামী চিন্তাবিদ ফেতুল্লা গুলেনের আদর্শে অনুপ্রাণিত এই দলের নেতা রেজেপ তাইয়েপ এরদোয়ান দেশটির প্রধানমন্ত্রী হলেন।
জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি বা সংক্ষেপে একে পার্টি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ২০০২ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হলে দেশটির প্রধানমন্ত্রী হন রেজেপ তাইয়েপ এরদোয়ান
পিনার বলছেন তারা বুঝলেন রক্ষণশীল এই সরকারের শাসনামলে তাদের প্রস্তাবিত আইনি সংস্কার আর আলোর মুখ দেখবে না।
আমরা অবিলম্বে ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক ডাকলাম। আমার মনে আছে আমাদের গোষ্ঠীর বেশিরভাগ এবং আমাদের সহযোগী সংগঠনগুলো বলল- ব্যাস্ - এখানেই সবকিছু শেষ। মনে আছে আমার শেষ বাক্যটা ছিল- হয়ত তোমরা ঠিকই বলছো- আর এগোনোর হয়ত মানে হয় না। কিন্তু তারপরেও চলো - আমরা এগিয়ে যাই।
তিনি বলেন, তার মনে হয়েছিল তাদের মেয়েরা, নাতনিরা একদিন পেছনের ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে যাতে অন্তত এটা বলতে পারে ওরা চেষ্টা তো করেছিল।
এরদোয়ান সরকারের নতিস্বীকার
নতুন রক্ষণশীল সরকারের মন্ত্রীরা প্রথমদিকে তাদের সাথে দেখা করতে অস্বীকার করেন। কিন্তু নারীদের ওই দলটি আইন বদলাতে তাদের আন্দোলন চালিয়ে যান- প্রকাশ্যে এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে।
এর মধ্যে তুরস্ক ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেবার ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক আলোচনার প্রক্রিয়া শুরু করে।
ইইউ-র কর্মকর্তারা বলেন নারীর অধিকার নিশ্চিত করতে ফৌজদারি আইনের সংস্কারের ব্যাপারে তারা পিনার ও তার সহকর্মীদের সাহায্য করতে রাজি আছেন। কিন্তু তাদের সাহায্যের প্রস্তাব পিনারদের দল প্রত্যাখান করে।
পিনার ইক্কারাজান বলেন, আমরা বলেছিলাম আপনারা এর মধ্যে ঢুকবেন না। আপনারা নাক গলালে সব কিছু ভেস্তে যাবে। জেডিপি সরকার এবং বিরোধী দল দুজনেই বলবে পশ্চিমা দেশগুলো এসব চাপিয়ে দিতে চাইছে। এসব ইউরোপীয়ানদের চাওয়া।
তুরস্কের ইইউতে যোগদানের জন্য আলোচনা শুরুর শর্ত হিসাবে যে দণ্ডবিধি সংস্কারের দাবি জানিয়েছিল ইইউ সেই আইন তুরস্কের সংসদে ওঠে জরুরি বিতর্কের জন্য ২৬শে সেপ্টেম্বর ২০০৪ সালে।
নারী গোষ্ঠীর সংস্কার প্রস্তাব শেষ পর্যন্ত তুরস্কের সংসদে ওঠে ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বিতর্কের জন্য। যদিও প্রধানমন্ত্রী এরদোয়ান এই বিতর্ক বাতিল করে দেবার চেষ্টা করেছিলেন।
তিনি দাবি করেছিলেন প্রস্তাবিত আইনে ব্যভিচারকে অপরাধ গণ্য করে একটি ধারা এতে আগে যোগ করতে হবে। কিন্তু তার দাবি শেষ পর্যন্ত ধোপে টেকেনি। সম্ভবত ইউরোপীয় ইউনিয়নের চাপে তাকে মত বদলাতে হয়েছিল।
আইনের প্রস্তাবিত সংস্কার নিয়ে এরদোয়ান যখন ব্রাসেলসে ইইউর কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করেন তখন তিনি সেখানে ব্যভিচারকে অপরাধ হিসাবে গণ্য করার বিষয়টি কোন সময়ই উল্লেখ করেননি।
এরদোয়ান দেশে ফেরার পর তুরস্কের সংসদ নারী আন্দোলনকারীদের প্রতিটি সংস্কার প্রস্তাব অনুমোদন করে।
দীর্ঘ প্রতিকূলতা পেরিয়ে সেটা ছিল নারী আন্দোলনকারীদের জন্য বিরাট একটা বিজয়।
পিনার খবরটি শুনেছিলেন ইন্দোনেশিয়ায় বসে। তিনি সেখানে গিয়েছিলেন একটা প্রশিক্ষণে যোগ দিতে।
আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলাম। আমার জীবনের এটাই বোধহয় ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন।
তুরস্কের নতুন আইনি সংস্কার কার্যকর হয় ২০০৫ সালের জুন মাসে। ওই বছরই শেষ দিকে তুরস্কের ইইউতে যোগদান নিয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হয়। যদিও ২০১৬ সালে এই আলোচনা স্থগিত হয়ে গিয়েছিল।
জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি এখনও তুরস্কের ক্ষমতায়। পিনার এখন থাকেন জার্মানিতে। তিনি মনে করেন আইনে নারীর অধিকার নিশ্চিত করা হলেও তুরস্কে বিচারহীনতার সংস্কৃতি নারীদের জন্য এখনও বড় একটা ঝুঁকি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন