আঞ্চলিক বিষয়ে সমন্বয় এবং পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে সৌদি আরব এবং তুরস্ক স্বাভাবিক সম্পর্কের নতুন যুগে প্রবশে করতে পারে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে তা নির্ভর করছে নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসনের প্রত্যাশিত পররাষ্ট্রনীতির পরিবর্তন এবং সৌদি প্রশাসনে ওয়াশিংটনের প্রভাবের ওপর।
মিডল ইস্টার্ন স্যাটেজিক স্ট্যাডিজের (ওআরএসএএম) প্রধান আহমেদ উসাল তুর্কি সংবাদমাধ্যম ডেইলি সাবাহকে বলেন, নতুন মার্কিন প্রশাসন যদি প্রত্যাশিত নীতি গ্রহণ করে, সৌদি আরব যদি যৌক্তিকভাবে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করে তাহলে সৌদি-তুরস্ক সম্পর্কের নতুন যুগ আমরা প্রত্যাশা করতে পারি।
‘আঞ্চলিক দুই শক্তির মধ্যে সংঘাতের কোনো প্রয়োজন নেই। সৌদি আরব তার অযৌক্তিক অবস্থান থেকে সরে আসলে আঞ্চলিক অনেক বিষয়ে একে অপরকে সহায়তা করতে পারে।’
দু’দেশের ইচ্ছা এবং দৃষ্টিভঙ্গির ওপর সবকিছুই নির্ভর করছে। তুরস্ক এ ধরনের সহযোগিতার জন্য প্রস্তুত। বলেন উসাল।
কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইবনে খালদুন সেন্টারের সহকারী অধ্যাপক আলি বাকের বলেন, সৌদি-তুরস্ক সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী অনুমান এ মুহূর্তে কঠিন। তবে গেল দু’মাসে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নতি ইতিবাচিক ইঙ্গিত দেয়। রিয়াদ-আঙ্কারা বিষয়ে বাইডেনের নীতি অন্যদিকে ওয়াশিংটনের সঙ্গে তেহরানের সম্ভাব্য চুক্তিসহ সৌদি-তুরস্ক সম্পর্ক আরও অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে।
উসাল বলেন, ২০১১ সালে আরব বসন্তের পর দু’দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। তবে বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিক আল সৌদের শাসনামলে তুলনামূলকভাবে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নত হয়েছে।
তারপর ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে সম্পর্ক উন্নয়নের ধারাকে ব্যাহত করেন। যখন সৌদির শাসনভার ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের (এমবিএস) হাতে ন্যস্ত করেন, আঞ্চলিক নতুন একটি ক্ষমতা কেন্দ্র তৈরি হয়, তখন তুরস্ক থেকে আবারও সৌদি আরব দূরে সরে যায়।
উলদাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রধান তাইয়ার আরি উল্লেখ করেন, ২০১৭ সালে সৌদি প্রশাসনে কিছু উলটপালট হয়। ট্রাম্পের সমর্থনে একক ক্ষমতার অধিপতি হয়ে ওঠেন এমবিএস। তখন একপাশে পড়ে যান বাদশাহ। তিনি বলেন, এমবিএস’র বিদেশ পরিকল্পনার সঙ্গে বাদশাহ সালমানের নীতির ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে।
‘এমবিএস ক্ষমতা পেয়ে সৌদি পররাষ্ট্রনীতিতে আমূল পরিবর্তন শুরু করেন। মুসলিম ব্রাদারহুডসহ আরব বসন্ত সমর্থনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক বৈরী পদক্ষেপ নেন। সহমর্মিতা প্রকাশ করেন ইসরাইলপন্থীতের প্রতি।’ বলেন আরি।
এ নীতিগুলো বাস্তবায়নে সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং মিশরকে নিয়ে জোট গঠন করে সৌদি আরব। আরি বলেন, তুরস্ক তখনও কর্তৃত্ববাদী এমবিএস’র শাসন এবং নীতিকে উপেক্ষা করে সৌদি বাদশাহ সালমানকে দেশটির বৈধ শাসক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে আসছিল।
দু’দেশের মধ্যকার আন্তরিকতা শূন্য সম্পর্ক সত্ত্বেও গেল মাসের মাঝামাঝিতে সৌদি বাদশাহ সালমানের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইপ এরদোয়ান। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নে বিভিন্ন উপায় নিয়ে আলোচনা করেন তারা। ভাগাভাগি করেন নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি। ২০১৮ সালে ইস্তাম্বুলে সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যার পর দু’নেতার মধ্যে এটাই সরাসরি প্রথম কথপোকথন।
দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়ন এবং সংকট সমাধানে আলোচনা অব্যাহত রাখতে একমত হন তুর্কি প্রেসিডেন্ট এবং সৌদি বাদশাহ।
পররাষ্ট্রনীতি এবং আঞ্চলিক বিভিন্ন ইস্যুতে বেশ কয়েক বছর ধরে সৌদি আরব এবং তুরস্কের মধ্যে সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। ইস্তম্বুলের সৌদি কনস্যুলেটে জামাল খাশোগি হত্যা পরিস্থিতিকে আরও উস্কে দেয়। খাশোগি হত্যার ঘটনা বিশ্বব্যাপী তীব্র নিন্দার জন্ম দেয়। বৈশ্বিকভাবে ভাবমূর্তি সংকটে পড়েন এমবিএস।
তুর্কি কর্মকর্তারা জানান, খাশোগিকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। টুকরো টুকরো করা হয় তার মরদেহ। কনস্যুলেটের ভেতরে নৃশংস এ কাজে অংশ নেয় সৌদি খুনি দলের ১৫ সদস্য। খাশোগির দেহাবশেষ এখনও পাওয়া যায়নি।
এরদোয়ান বলেন, সৌদি সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে খাশোগিকে হত্যা করা হয়েছে।
গেল বছর সৌদি আদালত হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকায় ৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন। সেপ্টেম্বরে সেই রায় বাতিল করেন সৌদির উচ্চ আদালত। একতরফা চলে এ বিচার কাজ। অভিযুক্তদের সাজা কমিয়ে ২০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
২৪ নভেম্বর খাশোগি হত্যায় জড়িত সন্দেহে নতুন করে ৬ সৌদি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে তুরস্কের বিচার বিভাগ। বিচার চলাকালে আদালত জানান, হত্যাকাণ্ডের সত্য ঘটনা উন্মোচন করা প্রয়োজন। ওইদিন মামলার দ্বিতীয় শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। চারমাস আগে প্রথম শুনানি হয়। বর্তমানে ২৬ সৌদি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে খাশোগি হত্যার অভিযোগে তাদের অনুপস্থিতিতে বিচার কাজ চলছে।
২১ নভেম্বর রয়টার্স জানায়, এক বিবৃতিতে সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফয়সাল বিন ফারহান আল সৌদি জানান, তুরস্কের সঙ্গে সৌদি আরবের ভালো এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে।
২১ থেকে ২২ নভেম্বর সৌদি আরবে জি-২০ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ভার্চুয়ালি এ সম্মেলন অংশ নেয় তুরস্কও। সম্মেলনে তুর্কি পণ্য বর্জনের বিষয়টি অস্বীকার করেন সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
অক্টোবরে সৌদি এবং আমিরাতের সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীরা তুর্কি পণ্য বর্জের আহ্বান জানায়। যদিও তাদের এ আহ্বানে তুর্কি পণ্য বাজারে খুব একটা প্রভাব পড়েনি বলে জানায় আঙ্কারা।
সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলনে জানান, নিরাপত্তা উদ্বেগ নিরসনের মাধ্যমে কাতারের সঙ্গে চলমান সংকট সমাধানের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে সৌদি আরব।
২০১৭ সালে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন এবং মিশর কাতারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। দেশটির বিরুদ্ধে স্থল, জল এবং আকাশপথে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তাদের অভিযোগ, দোহা সন্ত্রাসবাদে সহযোগিতা করছে। বরাবরই এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে আসছে কাতার।
নিষেধাজ্ঞা চলাকালে কাতারকে দেয়া সহায়তা জোরদার করে তুরস্ক। বর্জনের কারণে কাতারের জনগণের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিশ্চিতে খাদ্যসহ নানান সামগ্রী পাঠায় আঙ্কারা। এ সময় দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্য বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। সই হয়েছে বেশ কয়েকটি প্রকল্প।
এক বছরের বেশি সময় ধরে সৌদি এবং তুরস্কের কিছু ব্যবসায়ী গুঞ্জন ছড়িয়েছেন, অনানুষ্ঠানিকভাবে আঙ্কারার পণ্য বর্জন করছে রিয়াদ। গেলে মাসে তুরস্কের ব্যবসায়ী নেতারা বাণিজ্য সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য সৌদি আরবের প্রতি আহ্বান জানান।
খাশোগি হত্যার প্রভাব:
আরি বলেন, আসন্ন দিনগুলোতে রাজনৈতিক পূর্বাভাস হলো, বাইডেনের সময়ে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হবে। বাইডেন এবং তার দল ডেমোক্রেট পার্টি ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতির কঠোরভাবে বিরোধিতা করেছে। প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তারা ট্রাম্পের নীতি পরিবর্তন করবে।
তিনি আরো বলেন, নতুন প্রশাসনে পররাষ্ট্রনীতির অন্যান্য পরিবর্তনগুলোর মধ্যে একটি হবে সৌদি আরব ইস্যু। মার্কিন প্রশাসন হয়তো, মোহাম্মদ বিন সালমানকে বাদ দিয়ে বাদশাহ সালমানকে সৌদি আরবের প্রতিনিধি হিসেবে আবারও গণ্য করা শুরু করবে। খাশোগি হত্যায় মূলহোতা হিসেবে এমবিএসকে বিবেচনা করা হয়। জিক-২০ সম্মেলনে তার ইঙ্গিত বলেও মনে করেন তিনি। মার্কিন গণমাধ্যম এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় খাশোগি হত্যায় জড়িত থাকার কারণে এখনো এমবিএসকে বিভিন্নভাবে চাপে রাখছে।
আরি বলেন, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনে সৌদি আরবের প্রতিনিধিত্ব করেন বাদশাহ সালমান। ২০১৮ এবং ২০১৯ সালের সম্মেলনে রিয়াদের প্রধান প্রতিনিধি ছিলেন এমবিএস।
উসাল বলেন, খাশোগি হত্যা উপসাগরীয় জোটের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করেছে। এমবিএস যে সংস্কারক নন, বরং খুনি তাও প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছে। জি-২০ সম্মেলনে সেটি আবারও দৃশ্যমান হলো।
মার্কিন প্রশাসনের সম্ভাব্য পরিবর্তন তুলে ধরে উসাল বলেন, স্বাধীন গণমাধ্যম এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় খাশোগি হত্যার বিষয়ে খুবই সরব। যা বাইডেনকে সঠিক পথে এগোতে চাপ তৈরি করবে।
বাকের বলেন, ইয়েমেন, উপসাগরীয় সংকট, ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক এবং খাশোগি হত্যাকাণ্ডে সৌদি আরবের ভূমিকার কারণে বাইডেন প্রশাসন রিয়াদের ওপর কঠোর চাপ প্রয়োগ করবে। সৌদি সেই দৃশ্য মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি নিতে চায়। তাই আঙ্কারার দিকে ঝুঁকছে রিয়াদ।
সৌদি-তুরস্কের মধ্যে কেমন সম্পর্ক চান, এমন প্রশ্নের জবাবে আরি বলেন, স্বাভাবিক এবং ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক প্রত্যাশা করি, ব্যাপক কোনো পরিবর্তন নয়। বলেন, ব্যাপকভাবে তুরস্ক ইস্যুতে সৌদি তার নীতি পরিবর্তন করলে সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশরসহ অন্য আঞ্চলিক সদস্যরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
‘বাদশাহ সালমানের প্রশাসনের কাছ থেকে স্বাভাবিক, হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক চাই আমরা। সৌদি আরবের প্রতি তুর্কি প্রেসিডেন্ট খুবই গুরুত্বশীল এবং স্পর্শকাতর। নতুন যুগে পরিবর্তন যাই হোক তার ইতিবাচক পরিবর্তন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে প্রতিফলিত হবে; এমটাই চাওয়া।’ বলেন আরি।
আরি বলেন, নতুন সময়ে এমবিএস চাপে থাকবে। সৌদি আরব তার নীতিতে আরও স্বাভাবিক হতে পারেব। অন্যদিকে সৌদি ইস্যুতে তুরস্ক তার আগের অবস্থানে রয়েছে।
বাকের বলেন, সৌদি-তুরস্ক ভালো সম্পর্ক শুধু দেশ দুটির জন্য নয় বরং পুরো মধ্যপ্রাচ্যের জন্য ইতিবাচক। রিয়াদ এবং আবুধাবির মধ্যেও এ জাতীয় বিরোধ রয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
মূল লেখক: এরাপ ইয়ারার, আল সাবাহ।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন