হিন্দু-মুসলিম বিয়ে ঠেকাতে ভারতের উত্তরপ্রদেশ সরকার রাতারাতি যে অর্ডিন্যান্সটি এনেছে, সেটিকে ভারতে অনেকেই নাৎসি জার্মানির নেতা হিটলারের আনা ইহুদী-বিরোধী আইনের সঙ্গে তুলনা করছেন।
১৯৩৪ সালে নাৎসি জার্মানিতে ইহুদীদের সঙ্গে তথাকথিত 'এরিয়ান' বা আর্য বংশোদ্ভূতদের বিয়ে ও যৌন সম্পর্ক নিষিদ্ধ ঘোষণা করে একটি আইন আনা হয়েছিল।
ভারতের সুপরিচিত বামপন্থী নেত্রী ও অ্যাক্টিভিস্ট বৃন্দা কারাট বলছেন, "হিটলারের ওই আইনে দোষী সাব্যস্ত হয়ে অনেক ইহুদীকে জেলে যেতে হয়েছিল, যাদের অনেকে শেষ পর্যন্ত কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে প্রাণ হারান।"
"শুধুমাত্র ভিন্ন ধর্মে বিয়ে করার অপরাধে দশ বছর পর্যন্ত কারাদন্ডের বিধান রেখে উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকার মঙ্গলবার রাতে যে অর্ডিন্যান্স এনেছে, সেটিও ঠিক একই ধরনের পদক্ষেপ বলেই আমরা মনে করি", বলছেন মিস কারাট।
ভারতীয় সংবিধানের আর্টিকল ২১ যে ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার দিয়েছে, এই অর্ডিন্যান্স তার গুরুতর লঙ্ঘন বলেও অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন।ভারতের 'স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট ১৯৫৪' যে ভিন্ন ধর্মের নারী-পুরুষের মধ্যে বিয়েকে স্বীকৃতি দেয়, সে কথাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন বংশজ জৈনের মতো একাধিক সংবিধান বিশেষজ্ঞ।
এর আগে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েদের মধ্যে আন্ত:-ধর্মীয় বিয়ে ঠেকানোর লক্ষ্য নিয়ে ভারতের উত্তরপ্রদেশ সরকার একটি অর্ডিন্যান্স পাশ করে, যে ধরনের আইনি উদ্যোগ ভারতে প্রথম।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাজ্য ক্যাবিনেটের জরুরি বৈঠকে এই অর্ডিন্যান্সটি পাস করানো হয়, যাতে বলা হয়েছে শুধুমাত্র একটি মেয়ের ধর্ম পরিবর্তনের উদ্দেশ্য নিয়ে দুই ধর্মের মধ্যে কোনও বিয়ে হলে দোষী ব্যক্তির দশ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড হতে পারবে।
'উত্তরপ্রদেশ বিধিবিরুদ্ধ ধর্ম সম্পরিবর্তন প্রতিষেধ অধ্যাদেশ ২০২০' নামের এই অর্ডিন্যান্সটিতে আরও বলা হয়েছে, এই ধরনের ধর্মান্তরণের প্রমাণ পাওয়া গেলে সেই বিয়ে 'শূন্য' বা বাতিল বলে বিবেচিত হবে।
যারা সেই ধর্মান্তরণ করাবেন, সেই দোষী ব্যক্তিদের আর্থিক জরিমানা ও সর্বোচ্চ দশ বছর পর্যন্ত কারাদন্ডও হবে।
উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ এর আগেই প্রকাশ্য হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, হিন্দু মেয়েদের ইজ্জত নিয়ে অন্য ধর্মের কেউ খেললে তাদের অন্তিম যাত্রার ব্যবস্থা করা হবে - তার সেই হুমকির কয়েকদিনের ভেতরেই এই অর্ডিন্যান্সটি এল।
অর্ডিন্যান্সটিকে সাধারণভাবে 'লাভ-জিহাদ বিরোধী' আইন বলেই বর্ণনা করা হচ্ছে - যদিও লাভ জিহাদ শব্দবন্ধটি অর্ডিন্যান্সের খসড়াতে কোথাও ব্যবহার করা হয়নি।
ভারতে মুসলিম যুবকরা যখন কোনও হিন্দু মেয়েকে ভালবেসে বিয়ে করতে যান, সেটাকে বিজেপি ও দেশের বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী অনেকদিন ধরেই 'লাভ জিহাদ' বলে বর্ণনা করে আসছে।
ভারতের উত্তরপ্রদেশ ছাড়াও একাধিক বিজেপি-শাসিত রাজ্য সম্প্রতি ঘোষণা করেছে, তারা লাভ জিহাদের বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন করার উদ্যোগ নিচ্ছে।এই তালিকায় রয়েছে হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ, কর্নাটক, আসামের মতো অনেক রাজ্যই - তবে উত্তরপ্রদেশই প্রথম লাভ-জিহাদের বিরুদ্ধে আইন করল।
এই বিল আনার জন্য জন্য যোগী অদিত্যনাথের সরকার রাজ্য বিধানসভার অধিবেশন পর্যন্তও অপেক্ষা করেনি, তার আগেই মন্ত্রিসভার বৈঠকেই সংশ্লিষ্ট অর্ডিন্যান্সটি পাস করিয়ে নিয়েছে।
প্রসঙ্গত, এ সপ্তাহেই এলাহাবাদ হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ একটি মামলার রায়ে বলেছে, দুজন প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে-মেয়ে নিজেদের সম্মতিতে বিয়ে করলে তাদের ধর্মীয় পরিচয়, তারা হিন্দু না মুসলিম সেটা কখনওই বিচার্য হতে পারে না।
এই রায় আসার পর অনেক আইন বিশেষজ্ঞই মনে করেছেন, লাভ জিহাদের বিরুদ্ধে আইন করার চেষ্টা এরপর কঠিন হয়ে পড়বে।
"কিন্তু হাইকোর্টের ওই রায়কে উপেক্ষা করে রাতারাতি অর্ডিন্যান্স আনার মধ্যে দিয়ে যোগী আদিত্যনাথের সরকার একটা পরিষ্কার পলিটিক্যাল স্টেটমেন্ট দিতে চেয়েছে যে আমরা হিন্দু-মুসলিম বিয়ে রুখবই", বিবিসিকে বলছিলেন লখনৌতে রাজনৈতিক ভাষ্যকার রঘুনন্দন ত্রিপাঠী।
উত্তরপ্রদেশ সরকারের সিনিয়র ক্যাবিনেট মন্ত্রী ও মুখপাত্র সিদ্ধার্থনাথ সিং অবশ্য দাবি করেছেন, রাজ্যে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতেই তাদের সরকার তাড়াহুড়ো করে এই অর্ডিন্যান্স আনতে বাধ্য হয়েছে।
"সাম্প্রতিক সময়ে রাজ্যে এরকম শতাধিক ঘটনা আমাদের নজরে এসেছে, যেখানে হিন্দু মেয়েদের জোর করে ধর্মান্তরণ করে ভিন্ন ধর্মে বিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং তাকে কেন্দ্র করে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হয়েছে।"
সেই ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি ঠেকাতেই এই অর্ডিন্যান্স আনা হয়েছে বলে যোগী আদিত্যনাথ সরকারের বক্তব্য।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন